ফুটপাতের শীতের হরেক পিঠা: বেড়েছে দাম, ছোট হয়েছে পিঠার আকার!
'গ্রামে আমাদের ছিল গেরস্ত বাড়ি। নিজেদের জমির ধান। শীতের মৌসুমে তাই পিঠা তৈরি হতো নানান রকমের। যেদিন পিঠা বানানো হবে, সেদিন মনে হতো উৎসব। একদিন আগে থেকে চলতো প্রস্তুতি। গুড়, চালের গুড়ো, সব ঠিকঠাক করে মা, দাদি বসতেন পিঠা বানাতে। আমরা সব লাইন ধরে পিঁড়ায় বসতাম। গরম গরম পিঠা উঠতো, ফুঁ দিয়ে দিয়ে চালান করে দিতাম মুখে। রীতিমতো কম্পিটিশন চলতো। বাবা যদি বলতেন ২০টা খেয়েছি, কাকা বলতেন ৩০টা। প্রতিবেশী বাচ্চারাও এ আনন্দে থেকে বাদ যেত না। সেসব কী দিন ছিলো!,'– শীতের পিঠা খাওয়া নিয়ে নিজের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করছিলেন ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি কাঁটাবন কনকর্ড টাওয়ারের সামনের ফুটপাতে এসেছেন চিতই পিঠা কিনতে। বললেন, 'গ্রামের বাড়ি যাওয়া হয় না তা ২-৩ বছর হয়ে গেলো। পিঠার স্বাদ নিতে হলে এই ফুটপাতে চলে আসি।'
দেখতে দেখতে ঢাকা শহরেও চলে এসেছে শীত। সকালগুলোতে দিব্যি পাওয়া যাচ্ছে শীতের আমেজ। এরমধ্যেই শহরের ব্যাস্ততম ফুটপাতগুলো সেজে উঠেছে বাহারি পিঠার সাজে। সন্ধ্যা হলেই হরেক রকমের পিঠার পসরা সাজিয়ে বসে পড়ছেন দোকানিরা। যেকোনো ভোজনরসিক বাঙালির কাছে শীতের বড় এক অনুসঙ্গের নাম পিঠা। গ্রাম হোক কিংবা শহর, গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠা ছাড়া শীত যেন ঠিক জমে ওঠে না। আর তাই শীত আসতে না আসতেই হরেক রকমের পিঠার স্বাদ নিতে মানুষ ছুটে আসছেন ফুটপাতে। আর তাতেই শুরু হয়ে গেছে পিঠা বিক্রেতাদের ব্যস্ততা।
শীত এলেই জমে পিঠা বিক্রি
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোর একটি নিউমার্কেট। এ জায়গাকেই তাই পিঠা বিক্রির স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছেন শফিকুল ইসলাম। তার বাড়ি নোয়াখালী অঞ্চলে। ১৪ বছর যাবত ঢাকার ফুটপাতে নানান রকম ব্যবসা করে আসছেন তিনি। অন্য সময়ে যে কাজই করেন না কেন, শীত আসলেই তিনি বনে যান পিঠা বিক্রেতা। স্টার হোটেলের সামনে নিজের ছেলেকে সাথে নিয়ে হরেক রকম পিঠা বিক্রি করেন তিনি।
একপাশে গ্যাসের চুলায় ছোট ছোট ৬টি কড়াই; তৈরি হচ্ছে চিতই। অন্যপাশে শফিকুল একে একে বানিয়ে চলেছেন ভাপা পিঠা। সামনে রাখা কাচের বাক্সে সাজানো রয়েছে কুসুম কুলি, পাটিসাপটা, মাল পোয়া ও কুলি পিঠা। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠাগুলো রাখা হচ্ছে আলাদা পাত্রে। ব্যস্ততম এলাকা হওয়ার গরম পিঠাগুলো বেশিক্ষণ পড়ে থাকছে না ঝুড়িতে। চুলা থেকে উঠানোর সাথে সাথেই তা চলে যাচ্ছে খদ্দেরের প্লেটে।
এ এলাকায় পিঠার দোকান রয়েছে অসংখ্য। মানুষের আনাগোনা বেশি হওয়ায় দোকানগুলোতে বিকিকিনিও বেশি। বিকেলের দিকে শুরু হয়ে অনেক রাত পর্যন্ত চলে পিঠা বিক্রি। বৃদ্ধ আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রীর দোকানটি এলিফ্যান্ট রোডের জাহানারা ইমাম সরণীতে। একপাশে বসে স্ত্রী বানাচ্ছেন পিঠা, স্বামী বসে বিক্রি করেছেন সেগুলো। আনোয়ার জানালেন, 'বেচাকেনা আপাতত ভালোই। শীত যত বেশি পড়বে, পিঠা বেচাও বাড়বে। এখনও তো ভালোই গরম। তাও বানাইয়া সারতে পারি না।'
কাঁটাবন কনকর্ড টাওয়ারের সামনে ভ্যান ভর্তি করে হরেক রকমের পিঠা সাজিয়ে বসেন মোহাম্মাদ মনসুর। ফুটপাতে বেশিরভাগ দোকানগুলো চিতই আর ভাপা পিঠা বিক্রি করলেও তিনি বিক্রি করেন নানান ধরনের মিষ্টি পিঠা। তার ভ্যানটিকে দেখলে প্রথমে মনে হবে বুঝি কোনো পিঠার মেলা। আলাদা আলাদা ঝুড়িতে সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো পিঠাগুলো ঢেকে রেখেছেন পলিথিন দিয়ে। নিজের হাতে পিলিথিনের দস্তানা পড়ে তবেই এসব পিঠা বিক্রি করেন তিনি। পিঠার নামগুলোও বাহারি। পাটিসাপটা, বালুসা, নকশা, খাজা, শাপলা, মালপোয়া, পাকন, পুলি, পোয়া সহ মোট ১২ ধরনের পিঠা বিক্রি করেন তিনি।
মনসুরের বাড়ি চট্টগ্রাম, তাই পিঠা সম্পর্কে বেশ ভালো জানাশোনা তার। জিজ্ঞেস করতে বললেন, সব জায়গাতে চিতই আর ভাপা, তিনি তাই এসব মিষ্টি পিঠার দিকে ঝুঁকেছেন।
সন্ধ্যার মুখে ক্রেতার ভীড় ক্রমশ বাড়তে দেখে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তিনি। ইতোমধ্যে দোকানে চার বন্ধুর এক দল এসে হাজির। তারা একে একে চেখে দেখতে লাগলেন কয়েক ধরনের পিঠা। মনসুরও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ১৬০ টাকা বিল পরিশোধ করে যখন চলে গেলেন তারা, তখন আবার মুখ খুললেন তিনি। দৈনিক কত পিঠা বিক্রি করেন জানতে চাইলে বললেন, 'ঠিক নাই, দৈনিক ৩৫০-৪০০ পিঠা বিক্রি হয়। মানুষজন খুব ভালো পছন্দ করে। কেউ এক-দুইটা খায়, কেউ বাড়িতে নিয়ে যায়।'
পিঠার টানে ফুটপাতে
পৌষ কিংবা মাঘের সন্ধ্যা। গ্রামে শীত জেঁকে বসেছে। এমনই দিনে মা চুলোর পাড়ে বসে বানাচ্ছেন গরম গরম পিঠা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর এবারই প্রথম এই দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শেখ মেহেদী হাসান৷ মায়ের হাতে পিঠা এখনও খাওয়া হয়নি, তাই পিঠার টানে ছুটে এসেছেন ফুটপাতে। বললেন, 'ক্যাম্পাসে থাকাকালীন মন চাইলেও তো মায়ের হাতে পিঠা খাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাতে যে পিঠাগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোই খাচ্ছি। তৃপ্তি সহকারেই খাচ্ছি।'
শহরে শীত আসতে না আসতেই মেহেদীর মত অনেকেরই চলে এসেছেন পিঠা খেতে। কেউ রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন, কেউ নিয়ে যাচ্ছেন বাসার জন্য। ফুটপাতের এই পিঠাকে আহামরি স্বাদের কিছু মনে না করলেও পিঠা বানানোর আয়োজন ছাড়াই পিঠা খাওয়া যাচ্ছে, এটিকেই বড় পাওয়া হিসেবে দেখছেন অনেকেই। শর্মি আক্তার ও তার স্বামী এসেছেন পিঠা কিনতে। বললেন, 'এই পিঠাগুলো ঘরে বানানো পিঠার মতো অবশ্যই না। তবে মানুষ এখন আর ঘরে এত সব ঝামেলা করতে চায় না। পিঠা বানানোর প্রচলন ঢাকা শহর থেকে প্রায় উঠেই গেছে। তবে আমাদের খেতে তো হবে! তাই ফুটপাতে আসা।'
ফুটপাতে বাহারি পিঠা থাকলেও সবচেয়ে বেশি কদর চিতই পিঠার। দাম কম এবং হরেক রকমের ভর্তা আয়োজন থাকে বলেই এ পিঠার দিকে ঝোঁক সকলের। ধনেপাতা, চিংড়ি, শুটকি, বাদাম, কালোজিরা ভর্তার দেখা মেলে প্রায় সব দোকানে। ভর্তার সংখ্যা নিয়ে দোকানিদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে বলে জানালেন এক বিক্রতা। শুধু পিঠা নয়, ক্রেতারা যে ভর্তার টানেও আসেন, একথাও স্বীকার করলেন তিনি। তবে ঝাল পিঠার পাশাপাশি মিষ্টি পিঠাগুলোর সংখ্যাও বেড়েছে আগের তুলনায়।
পলাশী মোড়ের পিঠা বিক্রতা মোহাম্মাদ জামাল জানালেন, তার দোকানে সবচেয়ে বেশি চলছে পাটিসাপটা আর মালপোয়া। 'যার যেটা ভালো লাগে, সেটাই খায়। এমনও কাস্টমার আছে সবগুলো একপিস একপিস নেয়। টেস্ট কইরা দেখে।'
দাম বেড়েছে, কমেছে মান
গতবছর ভাপা পিঠা বিক্রি হয়েছে প্রতি পিস ১০ টাকা দরে। তবে এবার তা ২০ টাকা। চালের গুড়ো ও ময়দা মিশ্রিত চিতই পিঠা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা করে, যা আগে পাওয়া যেত অর্ধেক দামে। তবে পিঠাগুলোর দাম দ্বিগুণ হলেও, মান তেমন বাড়েনি বলে অভিযোগ ক্রেতাদের।
তারা জানালেন, 'পিঠার সাইজ তো আগের মতই আছে। নারকেল, গুড় সবই অল্প অল্প। আগে এই পিঠাই দশ টাকা ছিল। এবার সবকিছুর দাম বাড়ছে, তা ঠিক, কিন্তু তাই বলে পিঠার দাম দ্বিগুণ বাড়লে তো সমস্যা।'
'সব কিছুর দাম বাড়ছে। তবে আমি আগের রেটেই বিক্রি করি, লাভ খুব কম হয়। চিনি ছিল গতবছর ৫২ টাকা কেজি, এ বছর ১৩০ টাকা কেজি। তেলের দামও বেশি। পিঠার সাইজ আগের মত আছে। খরচ বেশি, লাভ কম,'– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন মোহাম্মাদ মনসুর।
তার মত অনেক বিক্রতাই দাম বাড়ানো ও মান কমানোর কথা অস্বীকার করলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আকারে কমেছে চিতই কিংবা পোয়া পিঠা, অন্যদিকে দাম বেড়েছে ভাপা, পাটিসাপটার মতো পিঠাগুলোর। তবে এমনটি মূল্যস্ফীতির জন্য হতে পারে বলে মত দিলেন কোনো কোনো ক্রেতা।
এরা সব মৌসুমি পিঠা বিক্রেতা
ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেলো, তাদের বেশিরভাগই এ পেশাকে বেছে নেন খণ্ডকালীন হিসেবে। শীতের ৩-৪ মাস বাদে বাকি সময়টাতে তাদের বেছে নিতে হয় অন্য পেশা। এদের কেউ কেউ ঢাকা শহরেই অন্যান্য ব্যবসা করলেও অনেকেই শীত শেষে চলে যান গ্রামের বাড়ি। যেখানে যুক্ত হন স্থানীয় কাজকর্মের সাথে।
মোহাম্মদ মনসুর পেশায় মূলত মাঠা বিক্রতা। কাঁটাবন মোড় থেকে নীলক্ষেত যাওয়ার পথে ফুটপাতে সারাবছর বিক্রি করেন সিরাজগঞ্জের ঠাণ্ডা মাঠা। তবে শীত আসলেই শুরু হয় মনসুরের পিঠার ব্যবসা। শীতে পিঠার চাহিদা ও বিক্রি বেশি বলেই তিন মাসের জন্য পেশা বদল করেন তিনি।
মনসুরের পাশেই রাজুদের ভাপা ও চিতই পিঠার দোকান। তার বাবা ও সে সাত বছর ধরে একই জায়গায় দোকান চালাচ্ছেন। এমনিতে রাজুর পেশা দিনমজুরি। গরমের সময়ে নিজের জেলা কুড়িগ্রামে কৃষিকাজও করেন তারা। তবে শীতের মৌসুমে তারা শুধুই পিঠে বিক্রেতা। বললেন, 'এসব তো শীতের পিঠা, শীত চলে গেলে আর চলে না। শীতের পরে আমরা চলে যাই, অন্য কাজে। যেমন– ধান কাটা, পাট কাটার মতো আঞ্চলিক কাজগুলো করি। শীতের তিনমাস, জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত চলে পিঠার ব্যবসা।'
যে ভ্যানে পিঠা বিক্রি করেন শহিদুল ইসলাম, সে ভ্যানেই গরমে বিক্রি করেন শরবত। জানালেন, সুবিধা বুঝে পেশা বদল করতে হয় তাকে। তবে এবার শীত শেষে কোনো স্থায়ী পেশা বেছে নেওয়ার ইচ্ছা আছে তার। পিঠা বিক্রি করে এ বছর কত আয় করতে পারেন, তার ওপরেই নির্ভর করছে তার ভবিষ্যৎ পেশা।