ভারতকে কাঁদিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া
নীল সমুদ্রে পরিণত হয়েছিল আহেমদাবাদের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম। ১ লাখ ৩০ হাজার ধারণ ক্ষমতার স্টোডিয়ামের যেকোনো গ্যালারিতে চোখ রাখলেই দেখা যাচ্ছিল নীল সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। ভারতের এককেটি সাফল্যে ফেটে পড়ছিল গ্যালারি। কিন্তু সময় গড়ায়, পাল্টায় চিত্র। অস্ট্রেলিয়ার নায়ক ট্রাভিস হেড, মার্নাস লাবুশেনরা একটা করে বাউন্ডারি মারেন, আর নিরবতা নেমে আসে পুরো স্টেডিয়ামে।
ম্যাচ শেষে তা পিন-পতন নিরবতা, পুরো স্টেডিয়াম যেন হয়ে ওঠে মৃত্যুপূরী। নীলের মাঝে যে কিঞ্চিত হলুদের আভা দেখা গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত সেই হলুদেই লেখা হলো বিশ্বজয়ের মহাকাব্য। অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা ভারতকে হারিয়ে আরও একবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া, আরও একবার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অজিদের মাথায়। উড়তে থাকা ভারতকে মাটিয়ে নামিয়ে বিজয়ের উল্লাসে মাতলো তারা।
রোববার বিশ্বকাপ ফাইনালে ভারতকে উড়িয়ে ৬ উইকেটের বড় জয় তুলে নেওয়া অস্ট্রেলিয়া উড়াল বিজয় নিশান, নামের পাশে আবারও যোগ করলো অতিমূল্যবান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শব্দযুগল। এ নিয়ে রেকর্ড ষষ্ঠবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপের শিরোপা জিতলো অজিরা, আর কোনো দলের তিনটি শিরোপাও নেই। ২০০২ সালে পর আরও একবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ফাইনাল হেরে হৃদয় ভাঙলো ভারতের।
ফাইনালের আগে ভারতের পক্ষেই বেশিরভাগ বাজি ছিল। বিশ্বকাপের আয়োজক দেশটি রীতিমতো অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠিছিল। জয়ে শুরু করার পর কেবল জিতেই গেছে তারা। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের রানের ফোয়ারা আর মোহাম্মদ শামি, জাসপ্রিত বুমরাহদের পেস আক্রমণে একের পর এক ম্যাচ জেতে ভারত। লিগ পর্বের ৯ ম্যাচের সবকটিতে জিতে সেমিতে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারায় দুইবারের চ্যাম্পিয়নরা।
টানা ১০ ম্যাচ জিতে আসল জায়গাতে অজি বাধায় আটকে গেল তারা। প্রথমবারের মতো হারের স্বাদ নিতে হলো, তাই ঘরের মাঠে স্বপ্নের মতো টুর্নামেন্ট কাটানোর পরও সোনালী শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হলো না ভারতের। অথচ অজিদের বিশ্বকাপ শুরু হয়েছিল এই ভারতের বিপক্ষেই হার দিয়ে, পরের ম্যাচেও সঙ্গী হয় হার। তৃতীয় ম্যাচ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো দলটি এরপর জয়ের মালা বড় করে গেছে। আর ফাইনাল মানেই যে তাদের দাপট, আগের আরও পাঁচবারের মতো আবারও সবাইকে তা মনে করিয়ে দিল ক্রিকেটের এই 'মোড়ল' দেশ।
টস হেরে আগে ব্যাটিং করতে নামে ভারত। পুরো আসরজুরে রাজত্ব করে আসা দলটি শিরোপার লড়াইয়ে এসে যেন 'চোক' করে বসে। ৫০ ওভারে ১০ উইকেটে ২৪০ রান তোলে তারা। তাদের পাঁচজন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কের রান করেন। বাকিদের কেউ ৯ রানের বেশি করতে পারেননি। জবাবে ৪৭ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে শঙ্কায় পড়লেও চতুর্থ উইকেটে দারুণ জুটি গড়ে অজিদের জয় এনে দেন তৃতীয় অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে বিশ্বকাপে ফাইনালে সেঞ্চুরি করা হেড ও লাবুশেন। ৭ ওভার হাতে রেখেই জয়ের নিশান ওড়ায় তারা।
মাঝারি লক্ষ্যে তেড়েফুরে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। জাসপ্রিত বুমরাহর করা প্রথম ওভারে ৩টি চার ও ৩ রানে ১৫ রান তোলেন ট্রাভিস হেড ও ডেভিড ওয়ার্নার। যদিও পরের ওভারে ঝড় থেমে যায়। ওয়ার্নারকে ফিরিয়ে দেন এবারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ ২৪ উইকেট শিকার করা মোহাম্মদ শামি। ৩ বলে ৭ রান করে বিদায় নেন বিশ্বকাপে দারুণ সময় কাটানো ওয়ার্নার।
উইকেট হারানোর পরও দ্বিতীয় ওভার থেকে অবশ্য ১৩ রান আসে শামির অতিরিক্ত রান খরচার কারণে। ২ ওভারে ২৮ রান তুলে উড়তে থাকা অস্ট্রেলিয়া ৪ ওভারে ৪১ রান তোলে। পঞ্চম ওভারে গিয়ে আঘাত হানে ভারত, ১৫ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ১৫ রান করা মিচেল মার্শকে সাজঘর দেখিয়ে দেন বুমরাহ। এখান তেকেই অজিদের চেপে ধরে ভারত।
রান তুলতে সংগ্রাম করতে থাকা অজিরা সপ্তম ওভারের শেষ বলে হারায় স্টিভ স্মিথকে, এবারও আঘাত হানেন বুমরাহ। ৯ বলে ১ রান করা স্মিথ এলবিডব্লিউর ফাঁদে পড়ে বিদায় নেন স্মিথ। প্রথম ৪ ওভারে ৪১ রান করা অজিরা পরের ৪ ওভারে মাত্র ৬ রান তোলে মার্শকে হারিয়ে প্রচন্ড চাপে পড়ে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া। ৪৭ রানে তিন উইকেট হারানো দলের হাল ধরেন ওপেনার হেড ও মার্নাস লাবুশেন।
দশম ওভারে শামিকে দুটি চার মেরে কিছুটা চাপ কাটান হেড। এরপর তাদের রান তোলার গতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়, পাওয়ার প্লের ১০ ওভারে ৬০ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া। বিপর্যয়ে পড়া দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে সাবলীল ব্যাটিং করতে থাকেন হেড ও লাবুশেন। একটা সময়ে শাসন করে খেলতে থাকেন তারা। চতুর্থ উইকেটে ২১৫ বলে ১৯২ রানের জুটি গড়েন অজি এই দুই ব্যাটসম্যান, যা বিশ্বকাপে চতুর্থ উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় সেরা জুটি।
বিশাল জুটি গড়ার পথে সেঞ্চুরি তুলে নেন হেড, ওয়ানডেতে এটা তার ষষ্ঠ ও বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেঞ্চুরি। জয় থেকে ২ রান দূরে থাকতে আউট হন বাঁহাতি এই ওপেনার। এর আগে ১২০ বলে ১৫টি চার ও ৪টি ছক্কায় ১৩৭ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেন তিনি। বিশ্বকাপের ফাইনালে এটা চতুর্থ সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। বিশ্বকাপ ইতিহাসের সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসেবে ফাইনালে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়লেন অজিদের ফাইনাল জয়ের এই নায়ক। তাকে সঙ্গ দিয়ে মহাকার্যকর ইনিংস খেলা লাবুশেন ১১০ বলে ৪টি চারে ৫৮ রানে অপরাজিত থাকেন। ভারতের বুমরাহ ২টি এবং শামি ও সিরাজ একটি করে উইকেট পান।
এর আগে দাপুটে শুরু করলেও দলীয় ৩০ রানে উইকেট হারায় ভারত, ফিরে যান ওপেনার শুভমান গিল। যদিও তাকে হারানোর চাপ সহজেই কাটিয়ে তোলেন অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও কোহলি। কিন্তু ৭০ পেরিয়ে হঠাৎ দিক হারায় ভারত। দলীয় ৭৬ রানে ম্যাক্সওয়েলের বলে ক্যাচ তুলে আউট হন ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ৩১ বলে ৪টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৪৭ রান করা রোহিত।
৫ রান পরই ফিরে যান শ্রেয়াস আইয়ার। শেষ দুই ম্যাচে টানা দুই সেঞ্চুরি করা ভারতের এই ব্যাটসম্যান ৩ বলে ৪ রান করেন। ৫ রানের মধ্যে দুই উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া ভারতকে এগিয়ে নিতে থাকেন কোহলি ও রাহুল। চাপে পড়ে যাওয়ায় ধীর-স্থির ব্যাটিং করতে থাকেন তারা। চতুর্থ উইকেটে ১০৯ বলে ৬৭ রানের জুটি গড়েন এ দুজন। এই জুটি ভেঙে ভারতের চাপ বাড়ান অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক প্যাট কামিন্স।
দলীয় ১৪৮ রানে সাজঘরে ফেরেন কোহলি। অফ স্টাম্পের বাইরে কামিন্সের করা বুক সমান ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়ে ইনসাইড এজে বোল্ড হন আগের ম্যাচে ওয়ানডের সর্বোচ্চ সেঞ্চুরিতে শচিন টেন্ডুলকারকে ছাড়িয়ে রেকর্ড গড়া ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ৬৩ বলে ৪টি চারে ৫৪ রান করেন কোহলি। ওয়ানডেতে এটা তার ৭২তম হাফ সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপের ১২তম।
কিছুক্ষণ পরই বিদায় নেন ২২ বলে ৯ রান করা জাদেজা। ২০০ পেরিয়ে স্টার্কের দুর্বার এক ডেলিভারিতে উইকেটের পেছনে ধরা পড়েন রাহুল। ১০৭ বলে একটি চারে ইনিংস সেরা ৬৬ রান করেন ডানহাতি এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান। এরপর অজিদের শাসন করা বোলিংয়ে সামনে সূর্যকুমার কিছু রান করেন। ২৮ বলে একটি চারে ১৮ রান করেন তিনি।
স্টার্ক সর্বোচ্চ ৩টি উইকেট নেন। ২৮ ম্যাচে ৬৫ উইকেট হলো তার, যা বিশ্বকাপ ইতহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ। কামিন্স ১০ ওভারে ৩৪ রানে ২টি উইকেট নেন। হ্যাজেলউডের শিকারও ২ উইকেট, ১০ ওভারে তার খরচা ৬০। একটি করে উইকেট পান জ্যাম্পা ও ম্যাক্সওয়েল। এই উইকেটে এবারের আসরে ২৩ উইকেট হলো জ্যাম্পার। যৌথভাবে মোহাম্মদ শামির সঙ্গে শীর্ষে আছেন তিনি।