কোথায় গেল কাপড়ের ব্যানার?
বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা প্রায় সমস্ত আন্দোলন-প্রতিবাদের ছবি দেখা হলে ব্যানার-ফেস্টুনের ছবি চোখে পড়বেই। আর এগুলোর সবগুলোই তৈরি কাপড় দিয়ে। কাপড়ের ওপর রঙ-তুলি দিয়ে লেখা এই ব্যানারগুলো একদিকে যেমন ছিল নান্দনিক, অন্যদিকে অনেকের কাছেই ছিল রুটি-রুজির উপায়। কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি এসে এই রঙ-তুলিতে দক্ষ ব্যানার শিল্পীদেরকে সরিয়ে সে জায়গা দখল করে নিয়েছে, সহজলভ্যতা আর অন্য সুবিধার পাশাপাশি ডেকে নিয়ে এসেছে পরিবেশ দূষণকেও।
রাস্তা-ঘাট পোস্টার আর ব্যানারে ঢেকে গেলেও কাপড়ের তৈরি ব্যানারগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। একইসাথে চাপা পড়েছে এর পেছনে থাকা ব্যানারশিল্পীদের কথাও। বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে এই শিল্প?
ব্যানার শিল্পীদের সন্ধানে
১৯৯৮ সালে জীবিকার সন্ধানে ঢাকায় এসেছিলেন ২০ বছর বয়সী সুমন দে। নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেট তখন জমজমাট। ব্যানার বলতে তখন কাপড়ের ব্যানারই চিনতো লোকে। তাই আঁকিয়েদের চাহিদাও আকাশ সমান। তাকে থাকার জায়গা দিলেন উদয় সাইনের মালিক, একইসাথে চললো ব্যানার আঁকার দীক্ষাও। সেই যে শুরু, তারপর থেকে গত ২৫ বছর ধরে কাপড়ের ব্যানার এঁকে চলেছেন সুমন। দেখেছেন এই শিল্পের সোনালী সময় থেকে বর্তমান সময়ের প্রায় বিলুপ্তি অবস্থা পর্যন্ত সবকিছুই।
"যখন কাজ শুরু করি, তখন নীলক্ষেত থেকে কাঁটাবন এলাকার মধ্যে ৪০-এরও বেশি ব্যানারের দোকান ছিল। কাজ করে কুলিয়ে ওঠা যেত না। অন্য জায়গা থেকে লোক ভাড়া করে নিয়ে আসা হতো কাজের জন্য," সোনালী অতীতের কথা মনে করেন সুমন।
কিন্তু সে দিন ফুরিয়েছে খুব দ্রুত। ২০০০-এর দশকের প্রথমভাগে ধীরে ধীরে ডিজিটাল প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটে। মার্কেটে একটি দুটি করে ডিজিটাল প্রিন্টের দোকান চালু হতে শুরু করে। কিন্তু সাথে সাথেই যে ডিজিটাল প্রিন্টের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়েছিল তা নয়। এর অবশ্য কারণও ছিল।
সুমনের মুখ থেকে জানা যায়, ২০০৩-০৪ সালের দিকে একটি সাধারণ আকারের (১২ ফুট বাই ৪ ফুট বা ৪৮ স্কয়ার ফুট) কাপড়ের ব্যানার তৈরিতে খরচ পড়তো তিনশত থেকে সাড়ে তিনশত টাকা। এর বিপরীতে ডিজিটাল প্রিন্টে খরচের পরিমাণ ছিল স্কয়ারফুট প্রতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা। অর্থাৎ, একই আকারের একটি ব্যানার ডিজিটাল প্রিন্টের মাধ্যমে তৈরিতে খরচ পড়তো প্রায় ১০ থেকে ১২ গুণ। ফলে সাধারণ ব্যবহারের জন্য কাপড়ের ব্যানারের গণ্ডিতেই আটকে থাকলো সবাই।
কিন্তু সময়ের চাকা যত গড়িয়েছে, কাপড়ের ব্যানার আর ডিজিটাল প্রিন্টের খরচ দুইদিকে প্রবাহিত হয়েছে। ডিজিটাল প্রিন্টের জন্য মেশিনারিজ আরও উন্নত হয়েছে, ব্যানার প্রিন্টিংয়ের কাঁচামালের দামও হয়ে উঠেছে সস্তা আর সহজলভ্য। যে কারণে এখন স্কয়ারফিটপ্রতি মাত্র ১৬ থেকে ১৮ টাকা দিয়েই খুব দ্রুত পিভিসি ব্যানার বানিয়ে নেওয়া সম্ভব।
নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটের ঐ গলিতেই ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন নুরুল ইসলাম। অ্যাড সাহারা নামের দোকানটিতে এখনো পিভিসি ব্যানারের ছোঁয়া লাগেনি, যেটি হয়েছে অন্যান্য বেশিরভাগ দোকানেই। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকেই বাধ্য হয়েছেন পিভিসির দিকে সরে আসতে। কিন্তু অ্যাড সাহারার দোকানে এখনো ঝুলছে কাপড়ের ব্যানার।
নুরুল ইসলাম জানান, এক কৌটা রঙ দিয়ে ৫০টার মতো ব্যানার তৈরি করা যায়। ২০০০ সালের দিকে এক কৌটা প্লাস্টিক রঙের দাম ছিল ১৫০ টাকা, এখন সে কৌটার দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫০ টাকায়। কাপড়ের দামও বেড়েছে ৮-১০ গুণ। "আগে কম খরচ করলেও লাভ হতো প্রচুর। এখন বেশি টাকা খরচ করেও লাভের পরিমাণ খুবই কম। অর্ডারও আসে না বললেই চলে। প্রতি ২-৩ দিনে হয়তো এক-দুইটা ব্যানারের অর্ডার আসে।"
এই অর্ডার কম আসার পেছনে মূল কারণ ক্রেতার চাহিদা। ক্রেতারা সাধারণত তাদের জন্য সুবিধাজনক জিনিসই অর্ডার করেন। খরচের পাশাপাশি সময় আর ডিজাইনের ফ্লেক্সিবিলিটির সুবিধাও ডিজিটাল প্রিন্টের ব্যানারে পাওয়া যায়, যেটি পাওয়া যায় না কাপড়ের ব্যানারের ক্ষেত্রে।
সুমন জানান, "ব্যানার মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। র্যালি-মিছিল অথবা সভা-সেমিনারের জন্য। র্যালি- মিছিলের ব্যানারে লেখা কম থাকে, সময়ও লাগে বড়জোর এক ঘণ্টা। কিন্তু সভা-সেমিনারের ব্যানারে লেখা বেশি থাকে, ডিজাইনের ক্ষেত্রেও সতর্ক থাকতে হয়। সময় লাগে আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টা। খরচও বেড়ে যায় এতে, দেড় থেকে দুই হাজার টাকা । কিন্তু পিভিসি ব্যানারের ক্ষেত্রে কোনো ঝামেলা নেই। লেখা কম হোক বা বেশি, সময় লাগে প্রায় একই।"
ব্যানার তৈরির অর্ডারের একটি বিশাল অংশ রাজনীতি বা নির্বাচনকেন্দ্রিক। আর এখানেই চলে আসে ডিজাইনের বিষয়টি। রাজনীতির প্রচারণার জন্য তৈরি ব্যানার-ফেস্টুনগুলোতে নেতাদের ছবি ব্যবহার করা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আর কাপড়ের ব্যানারে চেহারা এঁকে ফুটিয়ে তোলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর এ জায়গাতেই ডিজিটাল প্রিন্টের পিভিসি ব্যানারগুলো টেক্কা দিয়েছে কাপড়ের ব্যানারকে। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে কাপড়ের ব্যানার তৈরি করা ডিএম এন্টারপ্রাইজ দোকানের মালিক দাউদুল ইসলাম জানান, "প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যানারেই কমপক্ষে ৩-৪ জনের ছবি ব্যবহার করা হয়। এই ছবির কারণেই ব্যানারের চাহিদার বড় একটি অংশ পিভিসি ব্যানারের দিকে ঝুঁকে গিয়েছে।"
কাপড়ের ব্যানারের ক্রেতা কারা?
ক্রেতাদের জন্য পিভিসি ব্যানার অনেক সুবিধা এনে দিলেও কারা এখনো কাপড়ের ব্যানারের ব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছেন? নুরুল ইসলামের সাথে কথা বলে জানা যায়, মূলত বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এবং বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের দোকানের নিয়মিত গ্রাহক।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো কাপড়ের ব্যানার ব্যবহারের কারণ পরিবেশের ওপর পিভিসির ক্ষতিকর প্রভাব। পিভিসি মূলত একধরনের প্লাস্টিক যা পরিবেশের সাথে সহজে মিশে যেতে পারে না। তাছাড়া এগুলো একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন লাইফ সোসাইটির পরামর্শক সাকির ইব্রাহিম মাটি জানান, "ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও আমাদের প্রাণ, প্রকৃতি কে ভালো রাখার জন্য আমরা সব সময় চেষ্টা করি প্লাস্টিক, পিভিসির পরিবর্তে পরিবেশ বান্ধব কাপড় বা পাটের চট দিয়ে ব্যানার বানানোর।"
এদিকে পরিবেশ রক্ষা ছাড়াও নিজস্বতা ও ডিজাইনের সুবিধার কথা উল্লেখ করেন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ। "কাপড়ের ব্যানার অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের হাতেই করি। তাতে লেটারিংয়ের ক্ষেত্রে নিজস্বতার ছোঁয়া থাকে। আবার ইভেন্টের ধরনভেদে, যেমন, প্রতিবাদী সমাবেশ বা নবীনবরনের জন্য আলাদা আলাদা অক্ষর ব্যবহার করা হয়। বাংলা টাইপফেস অনেক সীমিত হওয়ায় প্রিন্টে উপযুক্ত ভাবপ্রকাশ করা যায় না। তাই আমরা রঙতুলি আর হাতের ওপরেই নির্ভর করি।"
এই দুই ধারার সংগঠন ছাড়াও বেশ কিছু স্কুল-কোচিং রাস্তার ওপরে স্থায়ীভাবে লাগিয়ে রাখার জন্য কাপড়ের ব্যানার ব্যবহার করে। তবে সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম বেঁধে দেওয়ায় এ ধরনের ব্যানারের অর্ডারও কমে এসেছে বলে জানা যায়।
আর এই সামগ্রিক চাহিদা কমার ধাক্কা লেগেছে ব্যানার আঁকিয়েদের ওপর, যে কারণে অনেকেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। সুমন জানান, "ব্যানার আর্টিস্টদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন এই হাতেগোণা ৩-৪টি দোকানই বাকি আছে। কেউ গ্রামে চলে গিয়েছে, কেউ বিদেশে গিয়েছে। পরিচিত আর্টিস্টদের অনেকেই রিকশা চালানো থেকে শুরু করে মুদি দোকান পর্যন্ত খুলেছে। পুরনো ব্যানারগুলোর কথা মনে পড়লে রঙধনু আর্ট বা সাইন আর্টের নাম চোখে পড়ার কথা। এর সবগুলোই হয় বন্ধ হয়েছে, অথবা আমার মতো ব্যবসা পরিবর্তন করে ডিজিটাল প্রিন্টে যেতে বাধ্য হয়েছে।"
একই বক্তব্য নুরুল ইসলামেরও। তিনিও জানান, ডিজিটাল প্রিন্টের সুবিধার সাথে পাল্লা দিয়ে কাগজের ব্যানারকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আশেপাশের বহু দোকান বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছেন। যে অবস্থা চলছে, তাতে খুব দ্রুতই তাকে অন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে।
কাপড়ের ব্যানারের ভবিষ্যৎ নিয়েও একইভাবে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ১৯৯২ সাল থেকে কাপড়ের ব্যানার নিয়ে কাজ করা দাউদুল ইসলাম, "আমার মতো আর ৩-৪ জন আর্টিস্টই এই মার্কেটে এখনো কাজ করে যাচ্ছে। হোসেনী দালানের ওখানে আরও দুয়েকজন থাকতে পারে। কিন্তু আমরাই শেষ। কাপড়ের ব্যানার এঁকে আয় নেই বলে নতুন কেউ এটি শিখতেও আগ্রহী হচ্ছে না। আমরা চলে গেলে পেশাদার ব্যানার আর্টিস্ট হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।"