‘মনে হচ্ছিল ভারত বলে নো বল দিলো’
৩৯তম ওভার, চতুর্থ ডেলিভারিটি করলেন রুবেল হোসেন। ফুল টস ডেলিভারিটি উড়িয়ে মেরে সীমানা ছাড়া করতে ব্যর্থ ভারতের ওপেনার রোহিত শর্মা। বল গিয়ে জমা হলো ডিপ মিড উইকেটের ফিল্ডার ইমরুল কায়েসের হাতে। সবচেয়ে বড় হুমকিকে ফিরিয়ে দেওয়ার খুশিতে বাংলাদেশ শিবিরে তখন গগন বিদারী চিৎকার। কিন্তু হায়, এ কী! আম্পায়ার নো বল ডেকেছেন!
আম্পায়ারের নো বলের সিগন্যাল দেখে বোলার রুবেলের বিশ্বাস হচ্ছিল না, ক্যাচ নেওয়া ইমরুল কায়েসও তখন ঘোরে। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার কাছেও মনে হয়নি নো বল। ছুটে যান ফিল্ড আম্পায়ার আলিম দার ও ইয়ান গোল্ডের কাছে। আবেদন জানান সিদ্ধান্ত বিবেচনার। কিন্তু ফল আর পক্ষে আসেনি। ৯০ রানে জীবন ফিরে পেয়ে রোহিত খেলেন ১৩৭ রানের ইনিংস।
২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের সেই দৃশ্য এখনও অনেক ক্রিকেটভক্তকে ক্ষেপিয়ে তোলে। মনের অজান্তেই ভারতের মুন্ডুপাত করেন তারা। সেই ম্যাচে নো বলের পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের আউটটিও ছিল বিতর্কিত। ওই দুই বিতর্কের পর প্রতিপক্ষ ভারত হয়ে ওঠে 'ঘোরশত্রু।' ওর পর থেকে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ মানেই বিশেষ কিছু, ঝাঁঝালো এক লড়াই।
মেলবোর্নে ১০৯ রানে হেরে যাওয়া ম্যাচে নো বলের সেই ঘটনাটি দাগ কেটে আছে ক্রিকেটারদের মনেও। এখনও চোখ বুজলে সেই হতাশার দৃশ্য দেখতে পান রুবেল হোসেন, ইমরুল কায়েস, তাসকিন আহমেদরা। নো বল ডাকায় রোহিতকে ফেরাতে পারেননি রুবেল। পরে ভারত ওপেনারের স্টাম্প উপড়ে তাকে সাজঘর দেখিয়ে দেন তাসকিন। পাঁচ বছর আগের বিতর্কিত সেই বল নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন এই তিন ক্রিকেটার।
রুবেল হোসেন
আমার কাছে যতটুকু মনে হয়েছে, নো বল হয়নি। ওই সময় যখন আমরা জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখলাম, দেখে মনে হলো এটা নো বল না দিলেও পারতেন আম্পায়ার। কারণ ওটা আসলে নো বল ছিল না। খুবই খারাপ লেগেছে। কারণ রোহিত শর্মার মতো একজন ক্রিকেটার, যে কিনা প্রতিপক্ষের বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে। একাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে, সে এমন একজন ক্রিকেটার।
এরপর আবার বিশ্বকাপের মতো জায়গা। এই ধরনের ইভেন্টে সারা পৃথিবীর মানুষের চোখ থাকে। তো নিজের কাছে খারাপ লাগছিল। জেদ হচ্ছিল, এই বলটা নো বল দিয়ে দিল! এটা ভেবে খারাপ লাগছিল সত্যি বলতে।
ক্রিকেট মাঠে এমন হলে তো কিছু করার নেই। আর ভারতের সাথে আমাদের অনেক কিছুই হয়। সেটা আমরা সব সময়ই দেখি। ওদের বিপক্ষে ভাগ্যও আমাদের সাথে থাকে না, কেমন যেন পারিও না। সব দিক থেকেই পিছিয়ে থাকতে হয় আমাদের।
ওই সময় আম্পায়ারের সাথে কথা হচ্ছিল। অধিনায়কসহ আরও দুই-একজন সিনিয়র ক্রিকেটার এগিয়ে গিয়ে কথা বলছিলেন। জানতে চাচ্ছিলেন কীভাবে এটা নো বল হলো। এটা তো প্রশ্ন করবেই। আমরা বাংলাদেশ বলে অনেক সুবিধা পাই না। ওখানে যদি অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোনো দল থাকতো তাহলে অনেক হিসাব-নিকাশ ছিল।
এটার জন্য আইসিসির কাছে আম্পায়ারদের হয়তো জবাবদিহিও করতে হতো। অন্য পর্যায়ে যেত। বড় দল হলে আম্পায়াররাও সিদ্ধান্তগুলো খুব সতর্কতার সঙ্গে দেন। আমরা বলে বড় দলের বিপক্ষে ম্যাচে আম্পায়াররা খুব সহজেই বড় সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারেন। এটা আমাদের জন্য এক ধরনের দুর্ভাগ্য।
আমি আর ইমরুল ভাই-ই বেশি হতাশ হয়েছি, এটা বলতেই হয়। আমি বল করছিলাম। কিন্তু কী আর করা যাবে। এটা নিয়ে এখনও দেখি নিউজ হয়। আমাদের অনেক মানুষও দেখি অনেক মন্তব্য করেন। টক শোতেও এটা উঠে আসে।
রোহিত শর্মা আউট হলে বড় কিছু হতো, তেমন নয়। তবে একটা দলের মোমেন্টাম পরিবর্তন হয়। ও যেমন ব্যাটসম্যান, পাওয়ার ক্রিকেট খেলে, ডমিনেট করে খেলে। ও শেষ পর্যন্ত খেললে যেকোনো দলের খারাপ সময় যাবে। ও তখন আউট হলে কিছুটা হলেও বাংলাদেশের পক্ষে মোমেন্টাম আসতো বা রান আরেকটু কম হতে পারতো। নতুন ব্যাটসম্যান এসে ওর মতো হিট করতে পারতো না। অনেক ব্যাপারই থাকে।
ইমরুল কায়েস
আম্পায়ার যখন নো বল বল কল করেন, মাঠের মধ্যে ফিল্ডার হিসেবে তখন খারাপই লাগে। তো ওটাও তেমন। রিপ্লেতে যখন দেখিয়েছে, মনে হয়েছে এটা নো বল হয় না। এটা নিয়ে রোহিত শর্মাও কিছুদিন আগে তামিমের ইন্টারভিউতে কথা বলেছে। আমরা মাঠে অনেক সময় অনেক এক্সাইটেড হয়ে যাই, অনেক সমালোচনা হয়।
কিন্তু আম্পায়াররাও অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে করেন না, ভুলবসত হয়ে যায়। ইচ্ছাকৃতভাবে এমন করেছেন, আমার তেমন মনে হয় না। আম্পায়াররা দিয়ে ফেলেছেন আর কি। এমন অনেক হয়। আমাদের দেশের আম্পায়ারদেরও এমন হয়। সবাই মানুষ, এমন ভুল হতেই পারে।
ওই সময় ভারত একটু চাপে ছিল। রোহিত শর্মা আউট হয়ে গেলে ভারত এত রান করতে পারতো না। না করতে পারলে দৃশ্য অন্যরকম হতে পারতো। ওই সময় আমরা মনে করেছিলাম, আম্পায়ার ওদের দিকে টানছে। মনে হচ্ছিল ভারত বলে নো বল দিলো, ভারত বলে আউট দিল না; আমাদের মধ্যে এমন প্রশ্ন এসেছে। কিন্তু দিনশেষে হিসাব করলে দেখা যাবে প্রতি ম্যাচেই আম্পায়ার কম-বেশি ভুল করেন। এমন না যে কোনো দিকে সমর্থন দিচ্ছে।
ক্যাচ নেওয়ার পর যখন দেখলাম নো বল, তখন ভীষণ হতাশ হয়েছি। কারণ আমরা সবাই তখন চিন্তা করছিলাম, রোহিত শর্মাকে আউট করতে পারলে আমরা খেলার মধ্যে চলে আসব। ভারত তখনও খুব বেশি রান করেনি। রোহিত শর্মা একমাত্র ব্যাটসম্যান ছিল, যে ওই সময় ভালো হিট করছিল। বাকিরা পারছিল না। ওর আউটটা তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
ওই নো বলের পরে ও আরও ৪৭ রান করে। ওই ৪৭ রানে খেলা অনেক পরিবর্তন হয়ে যায়। না হলে ওরা ২৫০ রানও করতে পারতো। ওরা ৩০২ রান করেছিল। ওখান থেকে যদি ৪৭ রান বাদ দেন, তাহলে কিন্তু ২৫০ রানের মতোই হয়। টার্গেট ছোট হলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। রোহিত আউট হলে আরেকজন এসে ওর মতো মারতে পারতো না।
বলটা নিয়ে সন্দেহ ছিল। একটা সময় উচ্চতা দেখে মনে হচ্ছিল নো বল। কিন্তু বলটা যখন পড়ছিল, কোমড়ের নিচের দিকে যাচ্ছিল। আমরা অনেক কথাই বলতে পারব, কিন্তু এখন তো উন্নত প্রযুক্তি। সেভাবেই বিশ্লেষণ করা হয়। হয়তো বলের গতিপথ দেখে ফিল্ড এবং থার্ড আম্পায়াররা মিলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। হয়তো নো বল না দিলেও পারতেন। না দিলে আমাদের দিকে থাকতো। কিন্তু তারা ডেকেছে, এখানে কিছু করার নেই।
তাসকিন আহমেদ
ইমরুল ভাই যখন ক্যাচটা ধরলেন, আমি দৌড়ে দৌড়ে বোলারের দিকে যাচ্ছিলাম। পরে দেখি নো বল। সবাই অনেক বিস্মিত হয়েছি তখন। মনে হচ্ছিল এটা নো বল দিয়ে দিল! ওই সময়টায় দলের সবারই মন খারাপ হয়ে যায়। কিছু তো করার ছিল না। এটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা হয়, পরে আবার আমরা শুরু করেছি।
আমার মনে হয় ওই নো বল নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ আছে। আমার মনে হয় ওটা নো বল ছিল না। কিন্তু আম্পায়ার দিয়ে ফেলেছে, আর এটা খেলারই অংশ। এখানে কিছু করার ছিল না। আমাদের হাতে কিছু ছিল না। কিন্তু ওটা নো বল হয়নি।
রোহিত শর্মা ৯০ রানে ব্যাটিং করছিল। ৯০ রান করে ফেললেও ও ওই সময় আউট হলে মোমেন্টামটা অন্যরকম হতো। ওটার পর রোহিত আরও ৪৭ রান করেছে। এটা পার্থক্য গড়ে দেওয়ার জন্য অনেক।
পরে রোহিতকে আউট করে অবশ্যই শান্তি লাগছিল। প্রতিটা আন্তর্জাতিক উইকেটই শান্তি দেয়। আমি পেয়েছি ওর উইকেট, ভালো লাগছিল। কিন্তু আগেই আউট হলে বেশি ভালো লাগতো। কারণ ওই নো বলের বলের পর রোহিত আর ধোনির ছোট একটা জুটিও হয়।
ধোনিকেও সেদিন আমি আউট করেছিলাম। এরআগে অজিঙ্কা রাহানেকে আউট করি। ওই ম্যাচে আমি ৩ উইকেট নিই। ওইদিন ম্যাশকিন সেলিব্রেশনটা হয়েছিল।
আমার যতটুকু মনে পড়ে, আমাদের অধিনায়ক মাশরাফি ভাই গিয়ে আম্পায়ারের সাথে কথা বলেছিলেন। পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে আউট দেওয়ার কথা বলছিলেন মাশরাফি ভাই। কিন্তু তখন তো দিয়ে ফেলেছে। কী আর করা!