মিয়ানমারের রাখাইনে আরেকটি ফাঁড়ি দখল আরাকান বিদ্রোহীদের, লড়াই অব্যাহত
মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি ফাঁড়ি গত রবিবার দখল করেছে জান্তাবিরোধী আরাকান আর্মি (এএ)। ফাঁড়িটি থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রও বাজেয়াপ্ত করেছে সশস্ত্র এই গোষ্ঠী।
স্থানীয় বাসিন্দা ও জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এ তথ্য জানিয়েছে। আরাকান আর্মি এই জোটের সদস্য। এ জোটে আরও রয়েছে তা'য়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি।
এর আগে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের শাসন ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এর পর জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। গত বছরের নভেম্বরে এ যুদ্ধবিরতি শেষ হয়। এখন রাখাইনে জান্তা সরকারের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তু দখলে নিতে এগোচ্ছে বিদ্রোহীরা।
থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এক বিবৃতিতে জানায়, রবিবার স্থানীয় সময় বিকেলে মংডু শহরের তায়াং পিও লেত ইয়ার ফাঁড়ি নিয়ন্ত্রণে নেয় আরাকান আর্মি। এর ফলে সেখানে অবস্থানরত সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড ফোর্স বা বিজিএফের প্রায় ৬০ সদস্য সীমান্তের দিকে পালিয়ে যায়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ফাঁড়ি দখলের আগে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে আরাকান আর্মির কয়েকজন সদস্য নিহত হয়েছে। তবে ঠিক কতজন হতাহত হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানানো হয়নি।
আরাকান আর্মি পাশেই বিজিএফের তায়াং পিও লেত ওয়েই ফাঁড়িতে আক্রমণ করেছে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়।
দুটি ফাঁড়িই মংডু শহরের ঠিক উত্তরে অবস্থিত। স্থানীয়রা আরএফএ বার্মিজকে জানিয়েছে, দুটি ফাঁড়িই জান্তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর প্রতিটিতেই তাদের অন্তত ১০০ জন করে সৈন্য ছিল।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে গোলাগুলির মধ্যেই বিজিএফ সদস্যদের বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে দৌড়ে আসতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন আহত সৈন্যও ছিল।
আজ মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ২৬৪ জন। তাদের মধ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য ছাড়াও সেনাবাহিনীর সদস্য, কাস্টমস ও বেসামরিক নাগরিক রয়েছে।
নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মংডুর এক বাসিন্দা জানান, শনিবার থেকেই আরাকান আর্মি ওই ফাঁড়িতে হামলা শুরু করে। তাদের হামলার কারণে গ্রামবাসী বাধ্য হয়ে সীমান্তের দিকে পালিয়ে যায়।
তিনি বলেন, 'গ্রামের কয়েকজন বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। কেউ কেউ বাঙ্কারের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। সংঘাত-লড়াই চলছেই। তাই মানুষজন গ্রামে থাকার সাহস পাচ্ছে না।'
এ বিষয়ে জান্তার পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি। গতকাল সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) আরএফএ জান্তার রাখাইন রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল হ্লা থেইনের কাছে জানতে চাইলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
আরও চাপ তৈরি করবে আরাকান আর্মি
রাখাইনের মংডু শহরের আরেক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমার বিশ্বাস আরাকান আর্মি আরও চাপ তৈরি করবে। যদি তায়াং পিও দখল হয়ে থাকে, তাহলে সীমান্ত পার হয়ে পালানোর মতো ঘটনা রাখাইন রাজ্যে চলতেই থাকবে। আমি এও মনে করি আশে-পাশের এলাকার অন্য ফাঁড়িগুলোতেও আক্রমণ হবে।'
তিনি জানান, আরাকান আর্মি সম্ভবত বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক রুটগুলো পুনরায় চালু করার জন্য সীমান্তের ফাঁড়িগুলোতে আক্রমণ করছে, যেগুলো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বন্ধ করে দিয়েছিল।
তিনি বলেন, 'জান্তা রুটগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর বহু পণ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। আরাকান আর্মি মনে করে এগুলো পুনরায় চালু করা তাদের দায়িত্ব। তাই এটি অনুমান করা যাচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চালু করাই মংডুতে আক্রমণের প্রধান কারণ।'
গত ডিসেম্বরে আরাকান আর্মি জানিয়েছিল, তারা গত নভেম্বর মংডুতে লড়াই শুরু হওয়ার পর থেকে বিজিএফের ৬০টিরও বেশি ফাঁড়ি দখল করেছে। গোষ্ঠীটির দাবি, বেশিরভাগ ফাঁড়ি থেকেই জান্তার সৈন্যরা পিছু হটেছে। কারণ তাদের 'আক্রমণের শিকার হওয়ার ভয়' ছিল।
রোহিঙ্গা শরণার্থী
এদিকে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাখাইনের তায়াং নিও শহরে বেশ কয়েকটি অস্থায়ী শিবির স্থাপন করেছে জান্তা সরকার।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তাকারী খিন মং আরএফএকে বলেন, এই এলাকায় তীব্র সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন এখনও 'অনেক দূরের পথ'।
তার প্রশ্ন- 'রোহিঙ্গারা কীভাবে সেই এলাকায় ফিরবে, যেখানে এ ধরনের তীব্র সংঘাত চলছে? এখন পরিস্থিতি অতীতের মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে কীভাবে আমরা ফিরে যাব? ফিরে যাওয়ার মতো উপযুক্ত পরিস্থিতি নেই।'
মিয়ানমারের এ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ ব্রিটেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও ছয়টি দেশ উদ্বেগ জানিয়েছে। এক যৌথ বিবৃতিতে দেশগুলো এ পরিস্থিতিকে 'শোচনীয়' বলে উল্লেখ করেছে।