বিশ্বজুড়ে কৃষক বিদ্রোহ, নির্বাচনি বছরে বিপর্যয়ের শঙ্কা!
এরিক ফুকো হাঁটার চেয়েও ধীরে তার সবুজ ট্রাক্টরটি চালাচ্ছেন। ইঞ্জিন আর হর্নের শব্দের চেয়েও জোরালো ফোনে তার চিৎকার করার শব্দ।
তিনি এসেছেন প্যারিসের দক্ষিণ থেকে। রাজধানীতে ঢুকতে বাধা পেয়ে প্যারিসের বাইরের মহাসড়কে অবস্থান নেওয়া ২০০ কৃষকের একজন তিনি।
ফুকো এবং তার সঙ্গে থাকা বিক্ষোভকারীরা বেজায় অস্থির। তাদের অভিযোগের তালিকাও দীর্ঘ। যেমন- ব্যয়বৃদ্ধি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বৃদ্ধি, গ্রিন ডিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নতুন বিধিনিষেধ এবং আমদানির ফলে তাদের বাজার সংকুচিত হওয়া প্রভৃতি।
বিশেষত ফ্রান্সে কৃষকদের বিক্ষুব্ধ হওয়ার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কৃষক বিদ্রোহের ঢেউ ইউরোপের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশ্বজুড়ে কৃষি একটি মূল যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা কৃষকদের বশে আনার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে ইউরোপের উগ্র ডানপন্থীরা কৃষকদের ক্ষোভকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। বর্তমানে ইইউ, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আরও কয়েক ডজন দেশে নির্বাচনের কারণে প্রচণ্ড রাজনৈতিক ঝুঁকির এক বছরে ক্ষোভের এই ব্যাপকতা কি প্রভাব ফেলে তাই এখন দেখার বিষয়।
এটি একটি বৃহত্তর সংস্কৃতি যুদ্ধের সর্বশেষ সংঘর্ষে পরিণত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষিখাতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রসার এই সংকটের মূল।
গম, বার্লি, বিট ও রেপসিড চাষ করা ৫৫ বছর বয়সী ফুকো বলেন, 'রাজনীতিবিদরা কেবল নির্বাচিত হতে চান, তাই কৃষক আন্দোলনে তাদের কেউ কেউ ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'ডানপন্থী দলগুলো থেকে শুরু করে পরিবেশবাদীরা, সবাই এসে জড়ো হচ্ছে।'
২৬ জানুয়ারি প্যারিসে কৃষি যানবাহনের দীর্ঘ সারি তীব্র অসন্তোষের এক টুকরো ছবি মাত্র।
এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে গত ১ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ব্লকটির সদর দপ্তরে আসেন ইইউ নেতারা। সেসময় রাস্তায় যানজট সৃষ্টির জন্য ১৩০০ ট্রাক্টর নিয়ে বিক্ষোভ করেন সশস্ত্র বিক্ষোভকারীরা। ইতালি, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও রোমানিয়াতেও ক্রমেই বিক্ষোভ বাড়ছে।
পোল্যান্ডের কৃষকরা প্রতিবেশী ইউক্রেন থেকে শস্য আমদানির বিরোধিতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, ফলে দেশটির সরকার ফের আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়।
জার্মানিতে ডিজেলে ভর্তুকি কমানোর প্রতিবাদে গত মাসে এক সপ্তাহব্যাপী মহাসড়ক অবরোধ করা হয়। বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ গেট অভিমুখী রাস্তায় সেসময় হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়।
এমনকি খোদ মার্কিন মুলুকে কৃষকদের অভিযোগ, বড় বড় কোম্পানিগুলোর কারণে তারা ব্যবসা করতে পারেছে না।
এদিকে, লাখ লাখ ক্ষুদ্র কৃষকের উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল দেশ ভারতের কৃষকরাও থেমে নেই।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নগদ অর্থ ও ভর্তুকি দিয়ে বিক্ষুব্ধ কৃষকদের শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। তবুও কৃষক বিক্ষোভে মঙ্গলবার দেশটির রাজধানী নয়াদিল্লি স্থবির হয়ে পড়ে।
অন্যদিকে, ভারতের কৃষক, ট্রেড ইউনিয়ন, নারী সংগঠন ও শিক্ষার্থীরা আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি একযোগে দেশব্যাপী ধর্মঘট ডেকেছে।
প্যারিসের সায়েন্সেস পো'র গ্লোবাল ফুড পলিটিক্সের অ্যাডজাংক্ট প্রফেসর ক্রিস হেগাডর্নের মতে, একযোগে বিক্ষোভের ডাক দেওয়া কৃষকেরা এসব দেশের সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
হেগাডর্ন বলেন, 'আপনারা বৈদ্যুতিক গাড়ি ছাড়া বাঁচতে পারেন, মোবাইল ফোন ছাড়া বাঁচতে পারেন; কিন্তু কৃষক আর তাদের উৎপাদিত খাদ্য ছাড়া বাঁচতে পারবেন না।'
অবসরপ্রাপ্ত এই মার্কিন কূটনীতিক বলেন, 'আমি মনে করি আমাদের এখনই এই বিষয়ে গভীর মনোযোগ দেওয়া উচিত।'
সম্প্রতি কৃষিকাজের জন্য ইইউ তার কিছু প্রধান পরিবেশগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে সরে এসেছে, অথচ কৃষি এ অঞ্চলের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের দশমাংশেরও বেশির জন্য দায়ী।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন অসন্তোষ দূর করতে কৃষি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে একটি বৈঠক করছেন।
ফ্রান্স ইউরোপের শীর্ষ ফসল উৎপাদনকারী দেশ। তবু সম্প্রতি দেশটির প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সরকার কৃষকদের জন্য আরও অর্থ বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে ইইউ'র বাণিজ্য আলোচনার বিরোধিতা করেছেন।
বিভিন্ন দেশের সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোও অনন্য নজির তৈরি করেছে।
নিউজিল্যান্ডে, কৃষকবান্ধব ন্যাশনাল পার্টির নতুন সরকার ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের প্রথম 'খামার নির্গমন কর' বিলম্বিত করার প্রস্তাব দিয়েছে।
গত বছর নেদারল্যান্ডসে নাইট্রোজেন দূষণ রোধের পরিকল্পনার ফলে বিক্ষুব্ধ কৃষকরা উগ্র ডানপন্থী ফ্রিডম পার্টির নেতা গির্ট উইল্ডার্সকে নির্বাচনে জয়ী হতে সহায়তা করে।
অন্যদিকে, কৃষকদের সমর্থন সত্ত্বেও ব্রাজিলের জাতীয়তাবাদী নেতা জাইর বোলসোনারো ক্ষমতা হারিয়েছেন। এখন দেশটির কৃষি ব্যবসায়ীরা প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার পরিবেশগত এজেন্ডাকে ভেস্তে দিতে তৎপর হয়ে আছে।
ধনী দেশগুলোতে কৃষকরা এখন ক্ষুদ্র শ্রমশক্তির অংশ
কাগজে-কলমে বিশ্ব অর্থনীতিতে সেবা ও শিল্পখাতের তুলনায় কৃষির অবদান সামান্যই।
কৃষিকাজের অবদান ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মোট দেশজ উৎপাদনের ২% এরও কম এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১%। উচ্চ আয়ের দেশগুলো তাদের মাত্র ৩% কর্মী এই খাতে নিয়োগ করে এবং এর পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।
তবুও খাদ্য সরবরাহ সম্পর্কে উদ্বেগের যুগে এবং ভোটারদের জন্য দাম একটি মূল উদ্বেগে পরিণত হওয়ায়, কৃষিকাজের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের পুষ্টি নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের ক্ষতি হচ্ছে, যুদ্ধের কারণে রপ্তানি রুটে প্রবেশাধিকার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং দেশগুলো বাণিজ্য বাধা সৃষ্টি করছে।
ক্রিস পিটারসন ও তার স্বামী গ্যারি উত্তরপশ্চিম উইসকনসিনে পাঁচ প্রজন্মের একটি পারিবারিক দুগ্ধ খামারের মালিক ও পরিচালনাকারী। তারা হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছিলেন।
সেসময়ে তিনি নাকি প্রতিদিন তার ফোনে রাত ৮টার অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন। যাতে ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করার কথা ভুলে না যান।
তিনি বলেন, কৃষিতে ট্রাম্পের ধারাবাহিক মনোযোগ তার প্রতি আমাদের আগ্রহের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।
পিটারসন বলেন, 'আমার পুরো জীবনে কোনো প্রেসিডেন্টকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো করে কৃষকদের কথা ভাবতে দেখিনি।'
তিনি বলেন, 'আমি জানি তিনি একটি বড় শহরের মানুষ, তবুও তিনি জানেন যে কৃষি দেশের জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ।'
চার বছর আগে বাইডেনের কাছে উইসকনসিন ও হোয়াইট হাউস হারিয়েছলেন ট্রাম্প। এ বছরের শেষের দিকে যদি ট্রাম্পের নাম রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়, তাহলে আবারও ওয়াশিংটনে ফিরতে হলে তার কৃষক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সমর্থন প্রয়োজন হবে।
আগামী নভেম্বরের ভোটকে ঘিরে কৃষকেরা ব্যস্ত সময় পার করছে। কৃষিকাজ থেকে আয় এখনও অনেক বেশি, তবে ২০০৬ সালের পর এ বছর এ খাতে যথেষ্ট কম আয় করেছে কৃষকেরা। ভুট্টা ও সয়াবিন থেকে শুরু করে দুধ ও শুয়োরের মাংসের দামও সম্প্রতি অনেক কমেছে।
বৈদ্যুতিক যানবাহনে রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে বাইডেনের চাপ জৈব জ্বালানিতে ব্যবহৃত ফসলের উৎপাদকদের ক্ষুব্ধ করেছে।
তাদের যুক্তি, বাইডেন খামারভিত্তিক নবায়নযোগ্য তরল জ্বালানি দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগটিও হাতছাড়া করছেন।
উইসকনসিনের কৃষক ডারিন ভন রুডেনের উদ্বিগ্নতার কারণ হলো বেঞ্চমার্ক দুধের দাম ফের বড় সংস্থাগুলোর পক্ষে যাবে।
রুডেন বলেন, 'এটি একটি দীর্ঘ যুদ্ধ এবং সাধারণত কৃষকেরাই ক্ষতির মুখেই পড়ে।'
২০১৯ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম উইসকনসিনের কৃষক জিম গুডম্যান তার পরিবারের চার প্রজন্মের দুধ ও গরুর মাংসের খামার বিক্রি করে দেন। এর এক বছর পর তিনি বাইডেনকে ভোট দেন।
শেষমেশ তিনি ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও গত কয়েক বছরে অনেক দুগ্ধ খামারি তেমন সুবিধা করতে পারেনি।
৬৯ বছর বয়সী গুডম্যান বলেন, বাইডেন প্রশাসন গ্রামীণ অর্থনীতি ও পরিবেশকে শক্তিশালী করার জন্য কিছু 'ইতিবাচক প্রচেষ্টা' করেছে। তবে কর্পোরেট মালিকানাধীন খামারগুলোর সম্প্রসারণে স্থগিতাদেশসহ কৃষকদের সহায়তা করার জন্য আরও অনেক কিছু করা দরকার।
তিনি অনিশ্চিত এবারের নির্বাচনে তিনি ফের বাইডেনকে সমর্থন দেবেন, নাকি ২০১৬ সালের মতো অন্য কোনো প্রগতিশীল প্রার্থীকে সমর্থন দেবেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কৃষকরা বলছেন, তারা আমলাতান্ত্রিকতা ও ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের ভারে জর্জরিত।
ইউরোপের প্রায় ৩৮ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ হয়, অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর অর্ধেক জমিতে চাষাবাদ হয়।
জিডিপির অংশ হিসেবে কৃষি উৎপাদকদের সহায়তা
ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের ইউরোপীয় কৃষি নীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক অ্যালান ম্যাথিউসের মতে, ক্রমবর্ধমান ব্যয় সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইইউ'র কৃষকরা সর্বোচ্চ আয় করেছেন।
ইইউ ২০১৪ সাল থেকে কৃষকদের সহায়তার জন্য বিভিন্ন সংকট-সম্পর্কিত তহবিলে ২.৫ বিলিয়ন ইউরো (২.৭ বিলিয়ন ডলার) ব্যয় করেছে।
২০২৩-২০২৭ সালের জন্য তার বিশাল কৃষি তহবিলে ২৭০ বিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে, যা সাধারণ ইইউ বাজেটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।
এছাড়া, দীর্ঘদিন ধরে ইইউ'র সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে সাধারণ কৃষিনীতি বা সিএপপি 'তে।
অন্যদিকে, বসন্তে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে ভারতের মোদি সরকারকেও কৃষক আন্দোলনের বিষয়টি ভালো করে ভাবতে হচ্ছে।
২০২০ ও ২০২১ সালে দিল্লির বেশিরভাগ অংশকে অচল করে দেওয়া কৃষক বিক্ষোভের ফলে কৃষি নীতি সংস্কার বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল মোদি।
তাই এবারের প্রচারণায় মোদি বারবার কৃষকদের কথা বলেছেন। তবে তার কথায় কৃষকেরা আশ্বস্ত হতে পারছেন না।
উচ্চ ঋণ, কৃষি ঋণ, দামের অস্থিরতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ফসলের ক্ষতির মতো বহু কারণ বছরের পর বছর ধরে এই খাতটিকে জরাজীর্ণ করে ফেলেছে।
কৃষক সংগঠন 'জয় কিষান আন্দোলন'-এর সর্বভারতীয় সভাপতি অভিক সাহা বলেন, সরকার পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাজারে যেভাবে পণ্যের দাম দেওয়া হয়, তাতে চাষিদের কোনো লাভ হয় না।
তিনি জানান, তার দল কয়েক বছর আগে বিক্ষোভ করেছিল এবং এই সপ্তাহে আবার রাস্তায় নামবে তারা।
ঋণ মওকুফ ও ফসলের নিশ্চয়তা নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা থেকে আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় মঙ্গলবার নয়াদিল্লির প্রধান সড়কগুলো অবরুদ্ধ করা হয়।
সাহা বলেন, 'আর কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, আমাদের এখনই পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। '
তিনি বলেন, 'ফসলের ন্যূনতম দাম নিয়ে আইন থাকা উচিত। আমাদের এখন আইন দিন। নরেন্দ্র মোদি সরকার কৃষি নিয়ে যে প্রকল্প ঘোষণা করেছে, তা কোনো কাজে লাগছে না।'
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ভেরিস্ক ম্যাপলক্রফটের হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরে বিশ্বে কৃষক বিক্ষোভের সবচেয়ে বড় অংশ হয়েছে ভারতে।
কিন্তু ইউরোপের আন্দোলন সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে, কারণ রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠীগুলো এখানকার আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছে।
ইউরোপের কৃষকদের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো উচ্চাভিলাষী গ্রিন ডিল। ২০৫০ সালের মধ্যে দূষণের পরিমাণ শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য তৈরি করা ইইউ আইনের একটি প্যাকেজ হলো গ্রিন ডিল।
এছাড়া ২০৪০ সালের অন্তর্বর্তীকালীন জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে দূষণ কমানোর জন্য আরও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ফলে অসন্তোষ আরও বেড়েছে।
কিছু কৃষক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, গ্রিন ডিলের জন্য তাদের ফলন ও আয় কমবে।
অন্যদিকে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় ভোক্তাদের ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়বে।
উগ্র ডানপন্থী ও ইউরো-সংশয়বাদী দলগুলো এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টায় তৎপর।
ফ্লোরেন্সের ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের কমপারেটিভ পলিটিক্সের অধ্যাপক সাইমন হিক্সের মতে, অভিবাসী শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার প্রয়োজন বলে অভিবাসন নিয়ে জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সঙ্গে কৃষকদের মতপার্থক্য রয়েছে। তবে উচ্চাভিলাষী সবুজ নীতির (পরিবেশবান্ধব) বিরোধিতায় উভয়ই এক হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
হিক্স ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের একটি প্রতিবেদনের সহ-লেখক। যেখানে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৯টি সদস্য রাষ্ট্রের জরিপে ইইউ-বিরোধী পপুলিস্টরা সম্ভবত শীর্ষে থাকবে। এর মধ্যে ফ্রান্সও রয়েছে।
জরিপগুলো মেরিন লে পেনের নেতৃত্বাধীন উগ্র ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালি পার্টির পক্ষে। কৃষকদের মন ভোলাতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে এই দলটি।
ইউরোপে উগ্র ডানপন্থীদের পায়ের তলার মাটি আরও শক্ত হবে
ন্যাশনাল র্যালির প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর পেরপিগানের মেয়র লুই আলিওট ফ্রান্সে রাস্তা অবরোধ করে রাখা কৃষকদের সঙ্গে দেখা করতে যান।। সেসময় তিনি কৃষকদের অভিযোগের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন।
তাদের অন্যতম অভিযোগ ছিল, ইইউ'র মুক্তবাজারের কারণে পোল্যান্ড ও অন্যান্য দেশ থেকে পণ্য আসায় ফরাসি বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইইউ নির্বাচনে লড়ার আগে আলিওট বলেন, তিনি চান সিনেমার মতো ফ্রান্সের কিছু কৃষিপণ্যকেও প্রতিযোগিতা থেকে মুক্ত রাখা হোক।
আলিওট বলেন, 'আমরা যখন এই উদ্বেগগুলো প্রকাশ করতাম, তখন কিছু কৃষক সংগঠনও আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করত। আপনারা আজ দেখতে পাচ্ছেন, আমরা বরাবর সঠিক ছিলাম।'
কৃষকদের আন্দোলন নিয়ে সক্রিয় আরেক জাতীয়তাবাদী নেতা হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান।
তিনি তার দেশে আইনের শাসন থেকে শুরু করে ইউক্রেনকে সহায়তা করা পর্যন্ত সব কিছু নিয়ে ইইউ'র সঙ্গে বিরোধ করেছেন।
অরবানের সফট পাওয়ার প্রতিযোগিতার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে বুদাপেস্ট-ভিত্তিক কলেজ ম্যাথিয়াস করভিনাস কলেজিয়াম। জানুয়ারিতে সম্মিলিত প্রতিরোধ শুরুর জন্য ব্রাসেলসে ইউরোপীয় কৃষকদের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করেছিল তারা।
এমসিসি ব্রাসেলস বিভাগের নির্বাহী পরিচালক ফ্রাংক ফুরেদি বলেন, সংস্থাটি ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের মতো বিভিন্ন দেশের কৃষকদের একটি নেটওয়ার্ক তৈরির চেষ্টা করছে, যাতে তারা 'বুঝতে পারে যে তারা একা নয়'।
তিনি বলেন, এর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো নীতি পরিবর্তনের জন্য ইইউ'র ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য একটি প্যান-ইউরোপীয় প্লাটফর্ম তৈরি।
সমসাময়িক পরিস্থিতির বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী ফুরেদি বলেছেন, 'ব্রাসেলসের কিছু লোক মনে করে সবুজ এজেন্ডা কৃষকদের খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কখনও কখনও তারা যুক্তি দেয় যে আগে ইউরোপে কম কৃষিকাজ ছিল, কারণ তারা মনে করে এটি পরিবেশকে সহায়তা করবে।'
তিনি বলেন, 'ইইউ কর্মকর্তারা অবশ্য এর ফলে কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে স্বীকার করেছেন।'
এই বছর ইউরোপজুড়ে বিক্ষোভকারীদের চাপের মুখে, ইইউ জীববৈচিত্র্য বাড়ানোর জন্য কৃষকদের আরও জমি পতিত রাখার প্রস্তাব বাতিল করেছে।
৬ ফেব্রুয়ারি ইইউ প্রধান ভন ডার লেন ঘোষণা করেন, কীটনাশকের ব্যবহার অর্ধেক করার একটি ফ্ল্যাগশিপ পরিকল্পনা প্রত্যাহার করা হবে, কারণ এটি 'মেরুকরণের প্রতীক' হয়ে উঠেছে।
ফ্রান্সে ফিরে প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আত্তাল এই মাসে কৃষকদের সহায়তার জন্য আর্থিক সহায়তা, অন্যায্য প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে অভিযান এবং অন্যদেশ থেকে আনা পণ্যগুলোর উৎসের উপর কঠোর নজরদারিসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন।
প্যারিসের দক্ষিণে যুব কৃষক ইউনিয়নের সভাপতি আমাউরি বাবাউল্ট সন্দিহান যে জনগণ ভোট দেওয়ার পরে গ্যাব্রিয়েল আত্তালের এই সংস্কারবাদী চিন্তা থাকবে কি না।
২৬ জানুয়ারি প্যারিস হাইওয়েতে বিক্ষোভের সময় ৩৪ বছর বয়সী বাবাউল্ট বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের আন্দোলনকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছে, তারা কেবল নির্বাচন আসলেই সক্রিয় হয়। কিন্তু আমরা কৃষকরা, ওদের বিশ্বাস করি না। ফ্রান্সেও কৃষকদেরও প্রয়োজন। আর রাজনীতিবিদদের কথা? আমি তাদের আশ্বাসে খুব বেশি ভরসা পাই না।'