দেশের একমাত্র সরকারি মধু শোধনাগারের অন্দরে
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশনের (বিএসসিআইসি) মধু শোধনাগার বছরে প্রায় ২১০ টন মধু পরিশোধন করতে পারে। যা দেশের আসল চাহিদার থেকে পরিমাণে অনেক কম। ফলে মধু ব্যবসায়ীদের নিজের চাহিদা মেটাতে অপেক্ষা করতে হয় বেশ কয়েকদিন।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বিএসসিআইসির মধু শোধনাগার থেকে ভেসে আসে যন্ত্র ঘোরার শব্দ। দেশের এই একমাত্র মধু শোধনাগারটি ঢাকা জেলার ধামরাইতে অবস্থিত। এখানে এলে দেখা মিলবে রাসায়নিক পাত্রে রাখা মধু।
বিএসসিআইসির এক কর্মকর্তার সাথে কথা বলছিলেন হোসেইন মোহাম্মদ ইকবাল মজুমদার নামের একজন ব্যবসায়ী। এই ব্যক্তি আফ্রিকা থেকে 'কালো মধু' আমদানি করে। সেক্ষেত্রে বাজারজাত করার আগে নিয়ে আসেন এই শোধনাগারে।
শুরুতে ইকবাল মজুমদার মাত্র এক টন মধু নিয়ে আসলেও সময়ের সাথে তা বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, "প্রতি মাসে আমরা প্রায় এক থেকে দেড় টন মধু বিক্রি করে থাকি। কখনো কখনো আমি প্রায় তিন থেকে পাঁচ টন মধু নিয়ে আসি শোধনাগারে।"
আফ্রিকার কোন দেশ থেকে আমদানি করা হয় তা না জানালেও ইকবাল মজুমদার জানান, প্রতি বছর তিনি প্রায় ১০-১৫ টন মধু আমদানি করে থাকেন।
সেক্ষেত্রে 'কারকুনা অর্গানিক হানি' নামে ঐ মধু বাজারজাত করে থাকেন ইকবাল মজুমদার। ৪০০ গ্রাম এই মধুর দাম ৭৫০ টাকা।
বিএসসিআইসির মধু শোধনাগারটি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে যাত্রা শুরু করে। দেশী মধু ও অপরিশোধিত মধু আমদানিকারকদের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে এই শোধনাগার। এর ফলে মধু ব্যবসায়ীরা পরিশোধনের মাধ্যমে আরও উন্নতমানের মধু বাজারজাত করার সুযোগ পাচ্ছে।
পুরো বছরজুড়েই মধু চাষীদের আনাগোনা দেখা যায় শোধনাগারটিতে। তবে শীতকালের একেবারে মাঝামাঝিতে হুট করে বেড়ে যায় মধুর প্রবাহ।
বিএসসিআইসি-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে অনুসারে, ২০২২-২০২৩ অর্থ-বছরে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে উৎপন্ন মধুর পরিমাণ প্রায় ৭ হাজার ৩২৮ টন।
এদিকে প্রতিবছর মধুর চাহিদা রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টনেরও বেশি। ডাবর, বি সুইটস এবং অন্যান্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোই সাধারণত এই চাহিদা পূরণ করে থাকে বলে জানান এই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত একজন।
মধু শোধনাগারের দ্বায়িত্বে থাকা বিএসসিআইসি-এর ঢাকা জেলার প্রচার কর্মকর্তা জানান, তারা বছরে প্রায় ২১০ টনের মতো মধু পরিশোধিত করতে সক্ষম। মধু চাষি এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত পরিশোধনাগারের মাধ্যমে মধু পরিশোধিত করে থেকে। এসব শোধনাগারের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে চীন থেকে।
কেন মধু প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে হয়?
প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে উৎপাদিত ৯০ শতাংশ মধু আসে সরিষা ফুল থেকে। কিন্তু অতিরিক্ত আর্দ্র হওয়ায় এক বছরের মধ্যে এই মধু দানা বাধতে শুরু করে।
এক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ আসে লিচু থেকে। আর বাকি পাঁচ শতাংশ আসে কালো জিরা, ইন্ডিয়ান জোজোবা এবং অন্যান্য ফুল থেকে।
মধুর আর্দ্রতা কমানো গেলে মধু বেশ কয়েক বছর সংরক্ষণ করা সম্ভব। শোধনাগারে শুধু মধুর আর্দ্রতাই কমানো হয় না। এই প্রক্রিয়ায় মেরে ফেলা হয় বিভিন্ন ধরনের জীবাণু। একইসাথে সরিয়ে ফেলা হয় অনাকাঙ্ক্ষিত দ্রব্য ও খড়কুটো।
প্রতি এক কিলোগ্রাম মধু পরিশোধনের জন্য নেয়া হয় ১৫ টাকা। বাজারে দেয়ার জন্য মধু বোতলজাত করার সুবিধাও রয়েছে বিএসসিআইসি শোধনাগারে।
সাদা অ্যাপ্রোন জড়িয়ে পরিশোধনের প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত থাকেন পরিশোধনাগারের টেকনিশিয়ান আব্দুল জব্বার পরাগ। তিনি বলেন "বিভিন্ন দিনে মধুর পরিমাণের তারতম্য হয়। কোন কোন দিন প্রায় ৫ থেকে ৭ টনের মতো মধু আসে পরিশোধনের জন্য। আবার কোন দিন এক ফোটা মধুর দেখাও মেলে না।"
পরাগ আরও বলেন, "শোধনাগারটি প্রতিদিন প্রায় ৭০০ কিলোগ্রাম মধু পরিশোধন করতে সক্ষম। তবে যে পরিমাণ মধু পরিশোধিত হওয়া প্রয়োজন তা থেকে এই পরিমাণ অনেক কম। ফলে মধু চাষি ও ব্যবসায়ীদের কখনো কখনো ১০ দিনেরও বেশি সময় পরিশোধনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এক্ষেত্রে আগে আসলে আগে পরিশোধনের সুযোগ পাওয়া যায়।
এখন নিয়মিত প্রায় একশ'র বেশি মধু চাষি ও মধু ব্যবসায়ীদের আনাগোনা দেখা যায় এই শোধনাগারে। এদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যবসায়ী; চাষীদের থেকে যারা সরাসরি অপরিশোধিত মধু কিনে থাকে।
পরাগ বলেন, "ছোট মধু চাষীরা এত স্বল্প পরিমাণ মধু থেকে তেমন লাভ করতে পারে না। মধু বাজারজাত করতে প্রয়োজন হয় বিএসটিআই এর অনুমোদন ও জনবল; যা ছোট চাষীদের জন্য সাশ্রয়ী নয়।"
পরাগ জানান, মধুতে আর্দ্রতা হওয়া উচিত ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। অপরিশোধিত মধুতে আর্দ্রতার পরিমাণ সাধারণত প্রায় ২১ থেকে ২৫ শতাংশ হয়ে থাকে। মধুর মান ধারে রাখতে মধু সবসময় কাঁচের পাত্রে রাখা উচিত।
খুশি মধু ব্যবসায়ীরা
'সুন্দরবন বী' এবং 'হানি ফার্ম লিমিটেড' বাজারে 'বী হানি' নামে মধু বাজারজাত করে থাকে। তারা বিএসসিআইসি মধু শোধনাগার থেকে গড়ে প্রায় ১২ টন মধু পরিশোধন করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ নুরুল হুদা জানান, তার প্রতিষ্ঠান বিএসসিআইসি মধু শোধনাগার থেকে জানুয়ারি মাসে প্রায় দুই টন মধু পরিশোধিত করেছে।
নুরুল হুদা বলেন, "আমাদের আগামী মাসগুলোতে প্রায় ১০ টনের উপরে মধু পরিশোধনের পরিকল্পনা রয়েছে। বাজারে আমাদের প্রায় ১২ টন মধুর অংশীদারিত্ব রয়েছে।"
ব্যবসায়ীরা জানান, কোভিড-১৯ মহামারির পর মধুর চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের আগের থেকে এখন স্বাস্থ্য সচেতন হওয়া এবং মধুর উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পারাটা এর পেছনে মূল কারণ বলে ধরে নেয়া যায়।
নুরুল হুদা বলেন, "আমি খুবই খুশি যে, আমরা এখানে সরাসরি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে মধু বাজারে বিক্রি করতে পারি।"
কাওরান বাজারে নুরুল হুদার নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র থাকার পাশাপাশি অনলাইনেও বিক্রি করেন এই মধু। ধামরাই বিএসসিআইসি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটেই তার প্রতিষ্ঠানের সকল পণ্যের প্যাকেজিং করা হয়।
অপর এক ব্যবসায়ী শফিক শরিফুল 'পিওর মধু মানিকগঞ্জ' নামে ব্যবসা করেন। মধু শোধনাগার চালু হওয়ার এক বছর পরে, অর্থাৎ ২০২০ সাল থেকে শোধনাগারে মধু প্রক্রিয়াজাত করে থাকেন শফিক।
প্রক্রিয়াজাতকৃত মধু অনেকটা সময় ধরে ভালো থাকে। প্রতি মাসেই শোধনাগার থেকে প্রায় আধা টন মধু প্রক্রিয়াজাত করেন এই ব্যবসায়ী।
শফিক বলেন, "মধু প্রক্রিয়াজাতকরণের এই শোধনাগার আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আমার বাড়ি মানিকগঞ্জ হওয়ায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় আমাদের জন্য কাজটি আরও সহজ হয়ে গিয়েছে।"
শফিকের মতে, দেশে অনেকগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্র থাকলেও এদের মান নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। অপরদিকে বিএসসিআইসি এর শোধনাগার এসব থেকে অনেক বেশি ভালো বলেই মনে করেন তিনি।
যদিও শোধনাগারটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায়শই বন্ধ থাকে। ফলে বিপাকে পড়ে মধু ব্যবসায়ীরা।
শফিক বলেন, "আমার মনে হয় আরও কিছু শোধনাগার তৈরি করা উচিত। কারণ প্রায়ই পরিশোধনের জন্য বিশাল পরিমাণে মধু এসে থাকে। গত মাসেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায় ১০ দিন বন্ধ ছিল শোধনাগারটি।"
শোধনাগারটির কর্মকর্তার মতে, দেশের অন্যতম ঔষধ কোম্পানি একমির ল্যাবরেটরিজের মত বড় বড় অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান বিএসসিআইসি'র শোধনাগার থেকেই পরিশোধন করে থাকে।
রাসায়নিক কনটেইনার ব্যবহার সমস্যার কারণ হতে পারে
অধিকাংশ চাষি ও ব্যবসায়ীরা মধু বহন করার কাজে সাধারণত ব্যবহৃত রাসায়নিক কনটেইনার ব্যবহার করে থাকেন। খুবই অল্প সংখ্যক ব্যবসায়ীরা ফুড গ্রেড কনটেইনার ব্যবহার করে থাকে।
বী হানি'র মালিক শেখ নুরুল হুদার মতে, মধু ব্যবসার সাথে জড়িত চাষীরা সাধারণত বেশ দরিদ্র হয়ে থাকে। তাদের পক্ষে দামি ফুড গ্রেডের কনটেইনার কেনা সম্ভব না। ব্যবহারের আগে সাধারণত পরিষ্কার করে নিলেও তা ব্যবহারের জন্য নিরাপদ নয়।
তিনি দাবি করেন, প্রক্রিয়াজাতকৃত মধু বহনের জন্য তিনি প্রায় ১০০ টি গাজী ট্যাংক কিনেছিলেন। সেক্ষেত্রে সরকার অথবা বিএসসিআইসি'র উচিত ফুড গ্রেডের কনটেইনার কিনতে ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা করা।
এদিকে বিএসসিআইসির পরিকল্পনা ও গবেষণা বিষয়ক পরিচালক আহসান কবীর দাবি করেন, মধু বহন করার কাজে রাসায়নিক কনটেইনার ব্যবহার করার বিষয়টি তারা জানতেন না।
তিনি আরো বলেন, এই ধরনের ব্যবহৃত রাসায়নিক কনটেইনার ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে। তিনি বলেন, কেউ যদি ব্যবহার করতেই চায় তাহলে অবশ্যই পাত্রটি ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে; যাতে কোন প্রকার গন্ধ না থাকে। একইসাথে পরীক্ষাও করে নিতে হবে যাতে কোন প্রকার রাসায়নিক পদার্থ অবশিষ্ট না থাকে।"
তবে আহসান কবীর বলেন, "রাসায়নিক কন্টেইনারে মধু বহন করতে আমরা ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করি।"
ডাবরের মতো হতে চায় বিএসসিআইসি
আহসান হাবিব প্রায় ১০ কোটি টাকার বাজেটের নতুন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে পুরোনো মধু শোধনাগারকে সরিয়ে নতুন 'কাটিং-এজ' পরিশোধনাগার দেবার পরিকল্পনা রয়েছে। এর ফলে মধু চাষ আরও বৃদ্ধি পাবে। একইসাথে বিএসসিআইসিকে আন্তর্জাতিক বাজারে ডাবরের মতো 'বিএসসিআইসি হানি' নামে বাজারজাত করার সুযোগ তৈরি হবে।
আহসান কবীর বলেন, "আমাদের মতে বিএসসিআইসির ব্র্যান্ডের মধু খাঁটি মধু। কিন্তু তারপরও আমরা এখনও তা রপ্তানি করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের এই মধু আপনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাওয়া যায়।"
বিএসসিআইসি'র নিজস্ব মধু উৎপাদনের সাথে সাথে বেসরকারিভাবে মধু উৎপাদন বাড়াতে তিনি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন।
কবীর বলেন, "আমাদের মধুর সাথে ডাবরের মধুর মানের পার্থক্য শুধু এর প্রক্রিয়াজাতকরণের পদ্ধতির কারণে হয়ে থাকে। আমরা যদি আমাদের প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতির উন্নতি করতে সক্ষম হই এবং ডাবরের মতো আকর্ষণীয় বোতলে উন্নত মানের মধু বাজারজাত করতে পারি তাহলে আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের মধু পৌঁছে দিতে পারবো।"
কবীর জানান, তারা এই প্রোজেক্টের প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করছেন। এটি অনুমোদিত হলে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে শুরু করবেন। এই মানোন্নয়নের অর্থ হলো তাদের পুরোপুরি নতুন প্রক্রিয়াজাতকরণের যন্ত্রাংশ স্থাপন করতে হবে।
তবে বিএসসিআইসির পরিচালক বলেন, "বাজারে মধুর চাহিদা অথবা দেশে মধুর বাজার সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। জরিপের মধ্য দিয়ে তারা এ বিষয়ে ধারণা পেতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।"