হুইলচেয়ার সেবায় যেভাবে সহজ হলো প্রতিবন্ধী ও প্রবীণদের বইমেলায় অংশগ্রহণ
শীতের শেষ। বসন্তের আগমন প্রকৃতিতে। রূপ বদলের বার্তা দিতে বইছে বসন্তের মাতাল হাওয়া। কিন্তু বিকেল হতেই কেমন যেন বিষণ্ন সব। এমন এক বিকেলে বেরিয়েছিলাম বইমেলা ভ্রমণে। ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখছিলাম নানা রঙের মুহুর্তগুলো। অনেকদিন পর এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিকেল উপভোগ করা হলো সেদিন। দিনের আলো তখন নিভু নিভু। ক্লান্ত ক্রেতাদের কেউ কেউ ঘরে ফিরছেন হাতভর্তি বই নিয়ে। আবার কেউ কেউ ভিড় করছেন কর্মব্যস্ত দিন শেষে। শত ব্যস্ততার মাঝেও বইপ্রেমীদের এমন আনাগোনা প্রাণচঞ্চল করে তুলেছে মেলার চারপাশ।
এসবের ভিড়ে হঠাৎ করে চোখ আটকে গেলো একটি দৃশ্যে। মধ্যবয়সী এক নারীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন নীল গেঞ্জি পরিহিত ২-৩ জন ছেলে মেয়ে। কী হয় দেখার জন্য আমি তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম, খুব যত্ন নিয়ে সেই ছেলেমেয়েগুলো মধ্যবয়সী নারীটিকে একটি হুইলচেয়ারে বসালেন। কৌতূহল থেকে আমি তাদের পিছু নিলাম। দেখলাম, নারীটি যেদিক যেদিক যেতে চাচ্ছেন, ছেলেমেয়েগুলো তাকে সেদিকেই ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। আবার দেখানো শেষ করে আগের জায়গায় পৌঁছেও দিচ্ছেন তারা। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম এভাবে আরও অনেককেই বইমেলা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে এই সেচ্ছাসেবী দল। আগ্রহ তৈরি হলো তাদের নিয়ে। তাই দেরি না করে এগিয়ে গেলাম কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর কাছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। বুঝলাম, মানুষগুলো শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় এই আয়োজন। জানা গেলো উদ্যোগের পেছনের মানুষদের নিয়েও।
ব্যস্ত নগরীর চলমান জীবনে বই পড়ুয়াদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের মাস ফেব্রুয়ারি। কারণ সবারই জানা। বইমেলা, ফাল্গুনের আমেজ- সব মিলিয়ে যেন উৎসবের রং লেগে যায় চারদিকে। সেই আমেজ ছড়িয়ে পড়ে তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মাঝেও। তাই পছন্দের বই কেনার উদ্দেশ্যে ভিড় জমানো তারা। তবে কেউ কেউ এমনও আছেন, বইয়ের রাজ্যে সদা বিচরণ থাকলেও মেলায় আসা হয় না। ইচ্ছা নেই, এমনটা নয়। পায়ে হেঁটে মেলায় আসাতেই যত বিপত্তি। প্রতিবন্ধী যারা, বয়সের ভারে হাঁটাচলায় সমস্যা হয় যাদের, মানুষের ভিড় ঠেলে মেলায় বই কেনার সাহসটুকু তারা করতে পারেন না। এমন সব মানুষদের জন্য এগিয়ে এসেছে 'সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন'। একদল সাহসী তরুণদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে এটি। সেবামূলক কাজের মাধ্যমে বরাবরই সাড়া জাগিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে। বইমেলায়ও সেটির ব্যতিক্রম ঘটেনি।
তারা উদ্যোগ নেন, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী এবং প্রবীণ (চলাফেরায় সমস্যা যাদের) যারা, মেলায় তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবেন। সে লক্ষ্যে হুইল চেয়ার সেবা দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর চিন্তা ভর করে মাথায়। হলোও তাই! ২০১৬ সালে এই কাজের সূচনা হয়। ৩২ বছর বয়সী এক যুবকের হাত ধরেই এই সংগঠনের যাত্রা। নাম, মুঈনুল ফয়সাল। জন্ম বরিশালের ঝালকাঠিতে। পড়াশোনা শেষ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। শিক্ষার্থী থাকাকালীন বিভিন্ন ধরনের সেবামূলক কাজে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন নিজেকে। পথশিশুদের জন্য স্কুল, তাদের জন্য সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা তৈরি, শীতার্তদের শীতবস্ত্র বিতরণ, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি, নিরক্ষর মানুষদের সাক্ষরজ্ঞান করা সহ নানান কাজ করেছেন। পুরো ছাত্রজীবন পার করেছেন এমন সব কাজ করে। আরও ভালোভাবে কাজের পরিধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলে বন্ধুদের সাথে নিয়ে শুরু করেন 'সুইচ বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন' এর যাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ও ডিএমসি সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের সমন্বয়ে পরিচালিত হয় এটি।
২০১৬ সালে এই উদ্যোগ নেওয়ার পরপরই ব্যাপক সাড়া মেলে তাদের। অনেকেই নিয়মিত এই সেবা নিচ্ছেন খুশিমনে। হালিমা হোসেন (ছদ্মনাম) এমনই একজন। বয়স ৭০ এর কোঠায়। বই নিয়ে তার আলাদা জগৎ। ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার অভ্যেস। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। খাঁটি বইপোকা যাকে বলে তিনি তা-ই ছিলেন। নিজে পড়তেন বলে মেয়ের মধ্যেও এই অভ্যাস গড়ে তুলতে বই এনে দিতেন প্রায়ই। আস্তে আস্তে হালিমারও বইয়ের প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়। এখন তা নেশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবার একা বইমেলায় এসে ঘুরে ঘুরে পছন্দের বই কিনে নিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন আর তা পারেন না। হাড়ের সমস্যার কারণে ঠিকঠাক চলাফেরা করাই যেন দায়! বেশিক্ষণ ভর দিয়ে দাঁড়ালেন অবশ হয়ে আসে পা। তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও মেলায় এসে বই কেনা হয়ে উঠে না। কখনো আর আসা হবে সে চিন্তাও বাদ দিয়েছিলেন একেবারে।
কিন্তু একদিন জানতে পারেন হুইলচেয়ার সেবার কথা। তার নাতনি সে বিষয়ে জানান তাকে। এবার আর দেরি করলেন না। ছেলেকে সাথে নিয়ে চলে এলেন বইমেলায়। হুইলচেয়ারে করে বইমেলা ঘোরাও হলো। কিনে নেন পছন্দের বই। মেলায় এসে আবার এভাবে ঘুরে দেখতে পারার অনুভূতি জানতে চাইলে হালিমা বলেন, "এই ছেলে-মেয়েরা না থাকলে তো তা সম্ভব হতো না। মন থেকে দোয়া রইলো তাদের প্রতি। খুব ভালো কাজ করছে। আবার বিরক্তও হচ্ছে না। যা যা বলেছি করেছে। সেভাবে ঘুরে দেখিয়েছে। আমাদের মত যারা তাদের নিয়ে কেউ কেউ ভাবে দেখে খুবই ভালো লাগছে।"
এর আগে পথশিশুদের নিয়ে ভিন্নধর্মী এক স্কুল, 'সুইচ বিদ্যানিকেতন' প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে এই ফাউন্ডেশন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ৪৭ জন শিক্ষার্থী নিয়েই সকল কাজকর্ম শুরু হয় তাদের। শিশুদের বিভিন্ন রকম ব্যবহারিক কাজকর্মে পারদর্শী করে তোলাই হলো এই স্কুলের মূল লক্ষ্য। ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মুঈনুল ফয়সাল এমন একটি স্কুল গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন যেখানে অ্যাকাডেমিকভাবে অর্জিত জ্ঞানে হবে ব্যবহারিক কাজ। শিক্ষার্থীরা তৈরি করবে নতুন নতুন সব জিনিসপত্র। করবে আবিষ্কার। খেলাধুলায় হবে পারদর্শী। প্রাযুক্তিক জ্ঞানে হবে দক্ষ। নিজেরাই নিজেদের সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলবে। 'সুইচ বিদ্যানিকেতন' ঠিক তেমন একটি স্কুল হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
২০১১ সাল থেকেই নানা ধরনের সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে আসছে এই ফাউন্ডেশন। সেসব কার্যক্রমের অন্যতম একটি উদ্যোগ হুইল চেয়ার সেবা প্রদান। বাংলা অ্যাকাডেমির সাথে যৌথভাবে এই কাজ করছেন প্রায় ৮ বছর ধরে। ২০২৪ সালেও তা অব্যাহত রেখেছেন। প্রতিদিন ২০ জনের অধিক সেচ্ছাসেবী নিজেদের কাজের পাশাপাশি বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত এই সেবা দানের কাজ করছেন নিরলসভাবে। তাদের এই মানবিক উদ্যোগ সফল করতেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানও। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিকাশ এবং র্যাডিয়ান্ট ফার্মাসিটিক্যাল লিমিটেড। আগামীতেও এমন আরও অনেক উদ্যোগ নিয়ে হাজির হতে বদ্ধপরিকর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা মুঈনুল ফয়সাল। তিনি বলেন, "সেসব বিষয় নিয়েই আমরা কাজ করতে চাই যেসব নিয়ে কেউ ভাবে না। ভাবতে চায়ও না।"