আপনারা ঘুমিয়ে আছেন কেন?: মোদিকে হটাতে ভারতের নিম্নবর্ণের প্রতি বার্তা রাহুল গান্ধীর
মাস দুয়েক পরই ভারতের লোকসভা নির্বাচন। আর নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির নেতা রাহুল গান্ধী তার নির্বাচনী প্রচার আর রাজনৈতিক ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় দেশজুড়ে চার হাজার মাইলের দীর্ঘ লং মার্চে (পদযাত্রা) আছেন। সেই লং মার্চ এখন অবস্থান করছে উত্তর প্রদেশে।
উত্তর প্রদেশের ওই সমাবেশে রাহুল জনগণকে আরও কঠোরভাবে চিন্তা করার আহ্বান জানিয়েছেন, বিশেষত জাতপাত নিয়ে।
সমবেত জনতার উদ্দেশে রাহুল বলেন, 'বিচার বিভাগে আপনাদের মধ্যে দলিত বা অন্য কোনো নিম্নবর্ণের লোক আছেন কি?' আপনাদের কেউ কি গণমাধ্যমে আছেন? আপনাদের মধ্যে কেউ কি ভারতের শীর্ষ ২০০ কোম্পানির একটির মালিক? যে সকল সরকারি কর্মচারী শ্রেণি এই দেশ শাসন করে, তাদের মধ্যে কি আপনাদের কেউ আছেন?
তিনি আরও বলেন, 'আপনারা সবাই ঘুমিয়ে আছেন কেন? আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না যে আপনাকে বোকা বানানো হচ্ছে? এসব প্রতিষ্ঠানে আপনাদের কেউ নেই বললেই চলে। অবহেলিত নিম্নবর্ণের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৭৩% হলেও এ সমাজে আপনি কেন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না?'
গান্ধী পরিবারের পঞ্চম প্রজন্ম রাহুল গান্ধী। ২০১৪ ও ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির কাছে হারলেও মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টায় আছেন।
মে মাসে অনুষ্ঠাতব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে রাহুল প্রতিদিন তার দল নিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পদচারণা ও সমাবেশ করে চলেছেন।
গত সপ্তাহে রাহুলের পদযাত্রা এলাহাবাদে পৌঁছায়। নেহেরু-গান্ধীর স্মৃতিবিজরিত এই ঐতিহাসিক স্থান থেকেই ভারতের তিনজন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাহুল গান্ধীর পদযাত্রাটি ঐতিহাসিক বাসভবন আনন্দ ভবন থেকে শুরু হয়, যা এখন একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই আনন্দ ভবন থেকেই রাহুলের প্রপিতামহ ও পিতামহ জওহরলাল নেহেরু এবং মতিলাল নেহেরু ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ভারতকে স্বাধীন করার জন্য তার অহিংস প্রতিরোধের কর্মসূচিও এখান থেকে প্রস্তাব করেছিলেন।
রাহুল যখন এলাহাবাদের লক্ষ্মী টকিজ নামে একটি স্থানে পৌঁছান, ততক্ষণে সেখানে প্রচুর ভিড় জমে গেছে। বক্তা হিসেবে পূর্বে রাহুলের অতটা খ্যাতি না থাকলেও এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। অন্তহীন মিছিলের লং মার্চ তাঁর বাগ্মিতাকে উজ্জীবিত করেছে। মিছিল ও সমাবেশে এখন তাকে আরও আত্মবিশ্বাসী ও দক্ষ বক্তৃতা দিতে দেখা যায়। তার কণ্ঠস্বর এখন আরও দৃঢ় প্রত্যয় বহন করে।
জনসাধারণের সাথে সংযোগ স্থাপনে পূর্বের থেকে দক্ষ এখন, ভিড়ের মধ্যেও খুব বেশি অসুবিধায় পড়তে দেখা যায় না রাহুল গান্ধীকে।
পূর্বে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি দ্বারা তাকে ও তার দলকে অপ্রাসঙ্গিক এবং সুবিধাভোগী পরিবারতন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করে সমালোচনা করলেও, রাহুল এই পদযাত্রার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে তিনি কার্যকরভাবে তৃণমূল রাজনীতিতে অবদান রাখতে পারেন এবং সাধারণ ভারতীয়দের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন।
তার মতে কঠোর হিন্দু সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের কারণে ভারতের মানুষজন এখনও জাতপাত নিয়ে অন্ধকারে রয়েছে।
তিনি নিম্নবর্ণের গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, 'আপনারা কোথাও নেই। এই দেশে অবহেলিত গোষ্ঠীর কতটুকু সম্পদ আছে তা খুঁজে বের করতে হবে। তাহলেই সব বেরিয়ে আসবে।'
তিনি বিশ্বাস করেন, বিভিন্ন বর্ণের গোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদের এই বণ্টন বুঝতে পারলে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশিত হবে।
গত কয়েক দশক ধরে ভারতের অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন প্রোগ্রাম অনুমানের ওপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। ১৯৫১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত স্বাধীন ভারতে প্রতিটি আদমশুমারি তফশিলি জাতি এবং তফশিলি উপজাতির তথ্য প্রকাশ করেছে। তবে অন্যান্য জাতিগুলোর ওপর কোনও তথ্য প্রকাশ করেনি। তার আগে, ১৯৩১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি আদমশুমারিতে জাত সম্পর্কিত তথ্য ছিল।
গত বছরের শেষের দিকে স্থানীয় দল শাসিত বিহার রাজ্য সরকার প্রথম জাতশুমারি পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, দেশটির ১৩০ মিলিয়ন মানুষের দুই-তৃতীয়াংশই তথাকথিত 'পিছিয়ে পড়া' বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর, যা ধারণার চেয়ে অনেক বেশি।
রাহুল গান্ধী ভারতের ২৮টি রাজ্যে একই ধরনের জাতশুমারি পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন। তিনি প্রতিটি শ্রেণি, বর্ণ, জাত সম্পর্কে আরও স্পষ্ট তথ্য চান যা অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন প্রোগ্রামের ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দশকের পর দশক ধরে সামাজিক বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে। সুবিধাভোগী বর্ণ ও জাত এখনও দেশের বেশিরভাগ সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে এবং বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২৩ সালের দাভোস রিপোর্টে অক্সফাম বলছে, ভারতের ৬০ শতাংশ সম্পদ সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ নাগরিকের দখলে।
তবে রাহুলের এ দাবি ভোটারদের মন জয় করবে কি না, তা এখনও অজানা।
রাজনৈতিক গবেষক অসীম আলী বলেছেন, 'তার আর কিছুই করার নেই। ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার একটি হালকা সংস্করণ গ্রহণ করে ভোটারদের কাছে আকৃষ্ট করার প্রচেষ্টা তার দলের জন্য ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে পারেনি।'
তিনি আরও বলেন, 'জাতপাতের দিকে নজর দিলেও দেরি হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে মতামত গঠন ও সমর্থন আদায় করতে আরও ৫ থেকে ১০ বছর সময় লাগবে। এই সাধারণ নির্বাচনে তা খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না।'
এদিকে কংগ্রেস সহ বিরোধী জোট একাধিক চ্যালেঞ্জ এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হচ্ছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ক্ষমতা থেকে সরানো হলেও জোট গঠনকারী বিভিন্ন দলের মধ্যে রয়েছে সংহতি ও ঐক্যের অভাব।
বিপরীতে, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং তার মিত্ররা আগের নির্বাচনে সংসদীয় আসনগুলো উল্লেখযোগ্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে আরও ঐক্যবদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছে। শরিকদের সাথে মিলে ২০১৯ সালে ৫৪৩ টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৩৫৩ টি জিতেছিল বিজেপি।
আর গুরুত্বপূর্ণ আসনগুলোতে কীভাবে আসন ভাগাভাগি করা যায় তার মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে রাহুলের জোট এখনও হিমশিম খাচ্ছে।
রাহুল গান্ধী মনে করেন তার জাতশুমারি এজেন্ডা আসন্ন নির্বাচনে কার্যকরী প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও এই একটা এজেন্ডা যথেষ্ট নাও হতে পারে, গান্ধীর দল বিশ্বাস করে যে বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতির মতো উদ্বেগের সাথে এটিকে যুক্ত করে তারা বিজেপির সমর্থনের ভিত্তিকে দুর্বল করতে পারে।
কংগ্রেস জাতশুমারিকে বৃহত্তর অর্থনৈতিক উদ্বেগের সাথে সংযুক্ত করে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থন হ্রাস করার আশা করছে।
তারা বিশ্বাস করে যে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি জাতপাত সম্পর্কিত সমস্যাগুলো ভোটারদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়াবে এবং সম্ভবত বিজেপির কাছ থেকে সমর্থন দূরে সরিয়ে নিবে।
প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা এবং বর্তমানে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সঞ্জয় ঝা যেমন বলছেন, মহামারিতে বিধ্বস্ত এবং অর্থনৈতিক দুরবস্থায় জর্জরিত ব্যক্তিদের মধ্যে দেশের সম্পদ পুনরায় বণ্টনের জন্য জাতিভিত্তিক জনগণনা বা জাত শমারির আহ্বান আলোড়ন তুলবে।
ঝা বলেন, 'মোদীর ১০ বছরের শাসনের পর যদি তারা নিজের জীবনের দিকে ফিরে তাকান এবং দেখেন যে তাদের কাছে শুধু একটি রান্নার গ্যাস সিলিন্ডার আর বিনামূল্যে কিছু শস্য রয়েছে, তখন তারা ভাবতে শুরু করবেন যে এটাই যথেষ্ট কিনা।'
রাজনৈতিক বিশ্লেষক নীরজা চৌধুরি বলছেন, বিজেপি নতুন জাতপাতের চেতনা তৈরি করে যে জাতপাতের সংহতির যে বিকাশ ঘটিয়েছে, তাতে ফাটল ধরাতে চাইছেন রাহুল। কিন্তু গান্ধী যেখানে ব্যর্থ হচ্ছেন, তা হলো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ ও তাদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলবে এমন কোনো স্লোগান বা আখ্যান তৈরি করতে পারেননি তিনি।'
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন