জুলাই থেকে দৈনিক ভিত্তিতে রেপোতে ধার পাবে না ব্যাংক
আগামী জুলাই থেকে প্রতিদিন রেপোতে ধার দেওয়ার পদ্ধতি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরিবর্তে, প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো সপ্তাহের যে কোনো একদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিতে পারবে। মূলত ব্যাংকগুলো যেন আরও কার্যকরভাবে তাদের তারল্য পরিচালনা করতে পারে, সে লক্ষ্যেই এমন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
৩০ ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে সোমবার ও মঙ্গলবার এসব বিষয় নিয়ে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এজাজুল ইসলাম। বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তিনি।
বেশ কয়েকজন ট্রেজারি কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে ওপেন মার্কেট অপারেশন (ওএমও)-এর মতো আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওএমও'র মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি সিকিউরিটিজ কেনাবেচা করে। আইএমএফও চায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী ওএমও অনুসরণ করুক।
শীর্ষস্থানীয় একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের ইন্টারেস্ট করিডোরের মধ্যে কাজ করার ব্যাপারে সতর্ক করেছে; যার অর্থ আন্তঃব্যাংক সুদের হার ৯.৫% এর বেশি হতে পারবে না।"
"এখন সে অনুযায়ী আমাদের সম্পদ ও দায় ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এতে আমাদের খরচ বাড়বে, তবে আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে," যোগ করেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদী ঋণ নেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো পুনঃক্রয় চুক্তি বা রেপো পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে। ওপেন মার্কেট অপারেশনস বলতে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের সমসাময়িক বিক্রয়, ট্রেজারি বিল এবং সরকারি সিকিউরিটিজ কেনাকে বোঝায়। এর মাধ্যমে বাজারে অর্থের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যেসব ব্যাংক প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোতে একদিন মেয়াদী ধার নিত, তারা আর সেই সুযোগ পাবেনা। বাংলাদেশ ব্যাংক রেপোতে ধার দেওয়ার জন্য একটি দিন ঘোষণা করবে। ওই নির্ধারিত দিনেই সব ব্যাংককে কমপক্ষে ৭ দিন মেয়াদী ধার নিতে হবে। এতে করে নিয়মিত হিসাব রাখা বা রেপো নবায়নের ঝামেলা কমবে।
"তবে একসঙ্গে বেশি টাকা ধার নেওয়ার জন্য সুদও দিতে হবে বেশি। কোনো ব্যাংক চাইলে ৬.৫ শতাংশ সুদে সপ্তাহের মাঝে সেই টাকা ফেরত দিতে পারবে। কিন্তু রেপোতে ধার নিতে হলে তাকে ৮ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে," যোগ করেন তিনি।
অপর এক ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান জানান, "এখন আমাদের কস্ট অব ফান্ড বাড়বে। কারণ সাত দিনের জন্য একসাথে ধার নিলে সব টাকা একদিনে প্রয়োজন হবে না। কিন্তু আগে একদিনের সুদ দিয়ে ফান্ড পাওয়ার সুযোগ থাকলেও এখন আমাকে সাত দিনের সুদ দিতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই সপ্তাহে একদিন ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত অনুযায়ী এখন বাংলাদেশ ব্যাংকও একই পথে হাঁটছে।"
তারল্য সংকট মোকাবেলায় প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার করেছে ব্যাংকগুলো। গতকালও (৫ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো, অ্যাসুরড লিকুইডিটি সাপোর্ট ফ্যাসিলিটি (এএলএসএফ) এবং ইসলামিক ব্যাংক লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটি (আইবিএলএফ) এর আওতায় ব্যাংকগুলোকে ৫,৭৮৯.৫৩ কোটি টাকা দিয়েছে। এএলএসএফ এবং আইবিএলএফ এর আওতায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রেকর্ড সর্বমোট ২৪,৯২৬ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, খোলা বাজারের কার্যক্রম আরও জোরদার করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পদক্ষেপটি আইএমএফ শর্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে এবং আশা করা হচ্ছে, এতে কল মানি মার্কেটের আকার প্রসারিত হবে, যার ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। এছাড়া, কী পরিমাণ ঋণ প্রয়োজন তা ব্যাংকগুলোকে আগে থেকেই অনুমান করতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর নির্ভর না করে ব্যাংকগুলোকে তাদের নিজস্ব তারল্য ব্যবস্থাপনার আহ্বান জানাচ্ছে। তবে এ পদ্ধতি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে না।"
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেন টিবিএসকে বলেন, এ পদক্ষেপ মুদ্রাবাজারে তেমন উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে না।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আইএমএফ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে লিকুইডিটি সাপোর্ট ফ্যাসিলিটি (এএলএসএফ) এবং স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) পরিচালনার সুপারিশ করলেও সে লক্ষ্য অর্জনে এই ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
কোন দেশে রেপো পদ্ধতি রয়েছে, কোন দেশে নেই
ফেডারেল রিজার্ভ: ব্যাংকিং ব্যবস্থায় রিজার্ভের স্তর পরিচালনা এবং স্বল্পমেয়াদী সুদের হারকে প্রভাবিত করতে ওভারনাইট, রেপো এবং রিভার্স রেপোসহ সাপ্তাহিক খোলা বাজার কার্যক্রম পরিচালনা করে ফেডারেল রিজার্ভ।
ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি): ইউরোজোনের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সরবরাহ এবং স্বল্পমেয়াদী সুদের হার পরিচালনার জন্য ইসিবি নিয়মিত তারল্য-সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করে।
ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড: ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড সাপ্তাহিক রিভার্স অকশন (নিলাম) পরিচালনা করে, যা স্টার্লিং মনিটারি ফ্রেমওয়ার্ক (এসএমএফ) অপারেশন নামে পরিচিত। যুক্তরাজ্যের ব্যাংকগুলোর তারল্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
ব্যাংক অফ জাপান: আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ও দেশের আর্থিক নীতির উদ্দেশ্যগুলো পূরণে জাপানিজ গভার্মেন্ট বন্ড (জেজিবি), সরাসরি ক্রয় এবং ব্যাংকের ঋণ সুবিধার মাধ্যমে ঋণ প্রদানসহ নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্যাংক অফ জাপান।
রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই) দেশটির ব্যাংকিং খাতের তরল্য ব্যবস্থাপনা ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে প্রতি সপ্তাহে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ঋণ প্রদান কার্যক্রম পরিচালনা করে।