ঘরোয়া লিগে অবহেলিত রিশাদ জাতীয় দলের নতুন আশার প্রতীক
জাতীয় দলের হয়ে খেলার আগে রিশাদ হোসেনকে চিনতেন, এমন খুব বেশি মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য চেনার কথাও নয়, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৯টি ম্যাচ খেলা আর লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে মাত্র পাঁচটি ম্যাচ খেলা কাউকে না চেনাটাই বরং স্বাভাবিক। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে এত কম খেলার পরও জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নেমে পড়ার উদাহরণও খুব একটা নেই।
রংপুরের জন্ম নেওয়া ২২ বছর বয়সী রিশাদ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত খেলেছেন মাত্র পাঁচটি ম্যাচ। অথচ জাতীয় দলের হয়ে খেলে ফেলেছেন নয়টি টি-টোয়েন্টি ও তিনটি ওয়ানডে। লেগ স্পিনার বলেই কিনা রিশাদ অবহেলিত ঘরোয়া ক্রিকেটে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লেগ স্পিনার মানেই মার খাবেন, এমন মানসিকতা যেন গেঁড়েই বসেছে।
জাতীয় দলের কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহেও এই বিষয়ে উদাহরণ টেনেছেন দুই অস্ট্রেলিয়ান লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পা ও তানভীর সাংহার। বিশ্বকাপজয়ী জাম্পাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন হাথুরুসিংহে। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বলেছেন, 'আমি দুজন বিশ্বমানের লেগ-স্পিনার হাতে ধরে গড়েছি। ২০১১ সাল থেকে আমি জাম্পাকে দেখে এসেছি। তাকে যখন প্রথম দেখি তখন সে সাধারণ একজন খেলোয়াড়ের মতোই ছিল। কিন্তু এখন সে বিশ্বমানের হয়ে উঠেছে।'
বাংলাদেশে লেগ স্পিনারদের যথাযথ কদর করা হয় না বলেও আক্ষেপ করেছেন হাথুরুসিংহে, 'এখানে লেগ স্পিনারদের মূল্য দেওয়া হয় না। এর জন্য আমরা প্রতিনিয়ত ভুগছি।'
রিশাদ হোসেন আলোচনায় ছিলেন আগে থেকেই। বাংলাদেশ কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহেও রিশাদকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছেন বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে। দলের অধিনায়ক নাজমুল হাসান শান্তরও রিশাদের ওপর অগাধ প্রত্যাশা। সিলেটে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচে বড় ব্যবধানে হারতে বসা বাংলাদেশকে সম্মানজনক জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন ৩০ বলে ৫৩ রানের এই ইনিংস খেলে। সেই ইনিংসে কোনো চার মারেননি রিশাদ, তবে হাঁকিয়েছিলেন সাতটি ছক্কা!
আজ আরেকবার নিজের শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন রিশাদ। তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন এমন কিছু নয়, তবে যখন রিশাদ ব্যাটিংয়ে নামেন তখন বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও সিরিজ হারানোর শঙ্কা ঘিরে ধরেছে। জিততে তখনও প্রয়োজন ৫৮ রান, হাতে আছে চার উইকেট। এক প্রান্তে মুশফিকুর রহিম আগলে রেখেছিলেন, রিশাদ এসে যে ঝড় বইয়ে দিলেন সাগরিকার ওপর দিয়ে, তাতে সব ভীতি কেটে আলোর দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ।
১৮ বলে ৪৮ রানের ইনিংসে পাঁচটি চার ও চারটি ছয় মেরেছেন রিশাদ। যার মধ্যে এক হাসারাঙ্গার বলেই নিয়েছেন ৪০ রান। এই লঙ্কান লেগ-স্পিনারের ১১টি বল খেলেছেন রিশাদ, যার মধ্যে এক ওভারে ২৪ ও আরেক ওভারে ১৬ রান তুলেছেন তিনি। রিশাদের কল্যাণেই সিরিজ জেতা নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের।
মুশফিকুর রহিমের ব্যাটের কানায় লেগে জয়সূচক রান হিসেবে চার না হলে রিশাদ ভেঙে দিতে পারতেন বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে দ্রুততম হাফ সেঞ্চুরির রেকর্ড। যেটি এখন আপাতত যৌথভাবে মোহাম্মদ আশরাফুল ও আব্দুর রাজ্জাকেরই থাকল। দুজনই ২১ বলে হাফ সেঞ্চুরি করেছেন।
ঘরোয়া লিগে রিশাদের খেলার সুযোগ না পাওয়া নিয়ে এর আগেও কথা বলেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হাসান শান্ত। আজ আরেকবার সংবাদ সম্মেলনে এই বিষয়ে নিজের মতামত জানিয়েছেন শান্ত, স্বাভাবিকভাবে সবাই ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে জাতীয় দলের জন্য সুযোগ পায়। এখন সে জাতীয় দলে খেলে কিন্তু ঘরোয়া ক্রিকেটে সুযোগ পায় না। এ বিষয়টা হতাশাজনক বলব না, তবে সে যে দলে খেলে তাদের ম্যানেজমেন্টের দেখভাল করা উচিত।'
এই তরুণ অলরাউন্ডারের পারফরম্যান্স নিয়ে শান্ত খুশি হলেও এটিও মনে করিয়ে দিলেন, এখনই খুব বেশিদূর ভাবার মতো কিছু হয়নি, 'হ্যাঁ, আমার মনে হয় ও খুব ভালো ফিল্ডার। ব্যাটিংটা উন্নত হচ্ছে আস্তে আস্তে। বোলিংটা অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। আজকেও যেভাবে বোলিং করেছে। মাঝে গুরুত্বপূর্ণ একটা উইকেট নিয়েছে। এটা অবশ্যই দলের জন্য ভালো। তবুও এখনই খুব বেশি এক্সাইটেড হওয়ার প্রয়োজন নাই। অনেক উন্নতির জায়গা আছে।'
বাংলাদেশ অধিনায়কের কথা অনুযায়ী, খুব বেশিদূর না ভাবলেও রিশাদকে নিয়ে যে নিকট ভবিষ্যতে ভালো কিছু আশা করাই যায়, সেটি নিয়ে সম্ভবত দ্বিমত থাকার কথা নয়। বাংলাদেশ দল অনেক দিন ধরেই ভুগছে সাদা বলের ক্রিকেটে সাত-আট নাম্বারে একজন হার্ড হিটার না পেয়ে। রিশাদ যে শুরু পেয়েছেন আর আশা জাগিয়েছেন, তাতে সেই কমতি পূরণে যে টিম ম্যানেজমেন্ট তার দিকেই তাকিয়ে থাকবে, তা আর না বললেও চলছে।