শিক্ষার ব্যয় প্রাথমিকে ২৫%, মাধ্যমিকে ৫১% বেড়েছে: গবেষণা
গত বছরের প্রথম ছয় মাসে শিক্ষার্থীপিছু পরিবারের শিক্ষা ব্যয় তার আগের বছরের (২০২২) তুলনায় প্রাথমিকে ২৫ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৫১ শতাংশ বেড়েছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, এই ব্যয় বাড়ার প্রধান কারণ হলো কোচিং-প্রাইভেট এবং নোট-গাইড বইয়ের খরচ বৃদ্ধি পাওয়া।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযানের উদ্যোগে করা 'বাংলাদেশে বিদ্যালয় শিক্ষা: মহামারি উত্তর টেকসই পুনরুত্থান'– শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
শনিবার (৩০ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সংবাদ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশিত 'এডুকেশন ওয়াচ-২০২৩' নামে ওই গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর জন্য বার্ষিক পারিবারিক গড় ব্যয় ছিল ১৩,৮৮২ টাকা। কিন্তু পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসেই প্রাথমিকে এই খরচ ২৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮,৬৪৭ টাকায়।
অন্যদিকে, মাধ্যমিক স্তরের একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার গড় খরচ এক বছরের ব্যবধানে ২০,৭১২ টাকা থেকে বেড়ে ২৭,৩৪০ টাকা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের চিত্রটি বের করা হয়েছে পঞ্চম শ্রেণি এবং নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচের ভিত্তিতে।
এতে দেখা যায়, শহরাঞ্চলে শিক্ষার খরচ তুলনামূলক বেশি। মফস্সল এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার্থীপিছু বার্ষিক পারিবারিক ব্যয় ছিল ১০,৬৩৭ টাকা; যা শহরাঞ্চলে ছিল ১৮,১৩২ টাকা।
একইভাবে, ২০২২ সালে মাধ্যমিক স্তরের একজন শিক্ষার্থীর জন্য পরিবারের গড় ব্যয় ছিল ২৭,৩৪০ টাকা। মফস্সল এলাকায় এই খরচ ২২,৯০৯ টাকা এবং শহরাঞ্চলে ৩৫,৬৬২ টাকা।
অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে গণসাক্ষরতা অভিযানের উপপরিচালক ও গবেষক দলের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় ক্ষেত্রেই প্রধানত ব্যয় হয়েছে প্রাইভেট টিউটরের বেতন ও নোট বা গাইড বই বাবদ।
সারাদেশের ৮ বিভাগের ১৬টি জেলার মধ্যে থেকে ২৬টি উপজেলা ও ৫টি সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে গবেষণাটি করা হয়েছে।
গবেষণার জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা মিলিয়ে মোট ৭,২২৫ জন কাছ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে।
এতে দেখা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে তিন-চতুর্থাংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরের সহায়তা নিয়েছে বা কোচিং সেন্টারে গিয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উভয়ের কাছ থেকে একই ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে।
শ্রেণিকক্ষে যথাযথ পাঠদান না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা গাইড বইয়ের ওপরে অধিক নির্ভরশীল ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এই নির্ভরতার হার ছিল যথাক্রমে ৯২ ও ৯৩ শতাংশ।
প্রাথমিক পর্যায়ের ৪১ শতাংশ এবং মাধ্যমিকের ৫৮ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। তাদের বেশির ভাগই স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮ শতাংশ ও মাধ্যমিকের ১৭ শতাংশ স্কুলের কাজে বা লেখাপড়াসংক্রান্ত কাজে ইন্টারনেটের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মহামারির পরে তাদের নতুন শ্রেণির পাঠ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী পাঠ বোঝার ক্ষেত্রে অসুবিধায় ছিল।
এদিকে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শিক্ষকের 'ব্লেন্ডেড লার্নিং (অনলাইন ও সশরীরে)' পদ্ধতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।
গবেষণার তথ্য বলছে, করোনার সংক্রমণজনিত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিদ্যালয় ছাড়ার পর আর ফিরে আসেনি। ২০২০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে লেখাপড়া করত এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২৩ সালে এসে দেখা গেছে তাদের মধ্যে দ্বিতীয় শ্রেণির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়েছে।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা মহামারি দ্বারা প্রভাবিত। এ জন্য যে কারণগুলো উঠে এসেছে, সেগুলো হলো— মহামারির কারণে নিম্ন-আয়ের পরিবারগুলোর আয় আরও কমে যাওয়া, বিদ্যালয়ে পড়ালেখার জন্য অভিভাবকদের খরচ বৃদ্ধি, মহামারির কারণে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকা এবং বিদ্যালয় থেকে যথাযথ নির্দেশনার অভাব।
ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল– তারা বিদ্যালয়ে ফিরতে আগ্রহী কি না। জবাবে প্রাথমিক স্তরে ৫৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৭৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, তারা আর বিদ্যালয়ে ফিরতে আগ্রহী নয়।
ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা বর্তমানে কী করে, সেটিও জানার চেষ্টা করা হয়েছে এই গবেষণায়। তাতে প্রাথমিক স্কুল বয়সী শিশুদের ৪১ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের ৪৯ শতাংশ বলেছে, তারা কাজ বা শিশুশ্রমে নিয়োজিত আছে।
গবেষোণায় দেখা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়া মেয়ে শিশুদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। একটি ছোট অংশ বলেছে, তারা গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত এবং অন্যরা বলেছে তারা কিছুই করছে না।
এ থেকে উত্তরণের জন্য গবেষণা প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে– উপবৃত্তি ও পরিকল্পিত আর্থিক সহায়তা বাড়ানো, বিবাহিত মেয়েদের উপবৃত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক নিয়ম বাদ দেওয়া, অভিভাবকদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন, শিক্ষার্থীদের শিখনঘাটতির মাত্রার ভিত্তিতে অতিরিক্ত ক্লাসসহ উপযুক্ত সহায়তা করা, শিক্ষকদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া ইত্যাদি।
সংবাদ ব্রিফিংয়ে এ গবেষণা দলের প্রধান ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, করোনার কারণে বড় অভিঘাত হয়েছে। কিন্তু সেটা যেন আমলে নেওয়া হচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, "এখন আমরা এই গবেষণা প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে তুলে দেব। গবেষণাকালে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিনিধিরাও যুক্ত ছিলেন এবং তাদের মতামতও নেওয়া হয়েছে।"
এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন গবেষণার পর্যালোচক আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী, গবেষক দলের সদস্য সৈয়দ শাহাদাত হোসাইন ও মো. আহসান হাবিব।