কর আইন লঙ্ঘন? এবার জরিমানা ও শাস্তি!
শাসকগোষ্ঠী আর সরকার কর আদায় প্রকৃতপক্ষে নিশ্চিত করার জন্য অন্যতম যে উপায়গুলো অবলম্বন করে, তার মধ্যে একটা হলো আইন ও আদেশ লঙ্ঘনকারীদের জরিমানাসহ অন্যান্য দণ্ড। আইনকে কীভাবে অর্থকরী ব্যবসায় পরিণত করা যায়, এ বিদ্যেটা শাসকেরা যুগ যুগ ধরে রপ্ত করে এসেছে।
এই যেমন ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি (খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৮২— ১৭৫০) ফরমান জারি করেছিলেন, কেউ গবাদিপশু চুরি করলে তাকে চুরি করা পশুর দামের ৩০ গুণ জরিমানা দিতে হবে। প্রাচীন রোমে পানির উৎস নষ্ট করে ধরা পড়লে দণ্ড হিসেবে ১ লাখ সেস্টার্স (প্রাচীন রোমান মুদ্রা) আক্কেল সেলামি গুনতে হতো।
আর শাসকগোষ্ঠীর বিশেষ পছন্দের অপরাধ ছিল বিশ্বাসঘাতকতা। কেননা এ অপরাধে তারা যেমন ভয়ানক শাস্তি দিতে পারত, শাসকের জন্যে ছিল আর্থিকভাবে ব্যাপক লাভজনক। কারণ, বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির সমস্ত সহায়সম্পত্তি জব্দ করত অধিকাংশ শাসক। মিথ্যে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে প্রজাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে নেওয়াটাকে আয়ের অন্যতম উৎস করে ফেলার জন্য কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন রোমান সম্রাট টিবেরিয়াস (১৪৩৭ খ্রিষ্টাব্দ)।
ফরাসি বিপ্লবের সময় গিলোটিনে প্রাণদণ্ড দেওয়া অসংখ্য মানুষের সম্পত্তি জব্দ করে নেয় সরকার। ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ইংরেজ যাজককে নিজের ক্ষমতার সীমার বাইরে সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য ১ লাখ পাউন্ডের মোটা অঙ্কের জরিমানা করেন।
আধুনিক যুগেও জরিমানা আদায় করে মোটা অঙ্কের আয় করে নেয়ার প্রচেষ্টা দেখা যায় অনেক কর্তৃপক্ষের মধ্যে। এই যেমন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের মাত্র ৪ বর্গমাইল আয়তনের শহর ডোরাভিলের কথাই ধরা যাক। ২০১৩ সালে মাত্র ১০ হাজার বাসিন্দার এ শহর শুধু জরিমানা করেই ২.২ মিলিয়ন ডলার কামিয়েছে, যা কিনা শহরটির মোট রাজস্ব আয়ের এক-চতুর্থাংশ।
জরিমানা আদায়ের জন্যে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে কখনো কখনো। ১৯৬০-এর দশকে জর্জিয়ারই আরেক শহর লুডোভিচির পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, তারা ট্রাফিক লাইটের লালবাতিতে কারসাজি করে শহরের বাইরে থেকে আসা গাড়িচালকদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করছেন। এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা উঠলে জর্জিয়ার তৎকালীন গভর্নর রীতিমতো বিলবোর্ড বসিয়ে মোটরচালকদের লুডোভিচি থেকে দূরে থাকতে বলে দেন।
গাড়ি চালানোর সময় গতিসীমা লঙ্ঘন করে জরিমানা খেলে যে কারোরই মেজাজ খারাপ হয়। তবে জরিমানার পয়সা যাদের পকেটে ঢোকে, সেই কর্তৃপক্ষের কিন্তু পোয়াবারো। গতিসীমা লঙ্ঘনকারীদের 'স্পিডিং টিকিট' দিয়ে ফি বছর বিপুল আয় করে যুক্তরাষ্ট্র। এ খাত থেকে দেশটির আয় ২০০ বিলিয়ন ডলারও ছাড়িয়ে গেছে।
শ্রেণি ধরে কর আরোপ
যুদ্ধ মানেই খরচ। আর সে ব্যয় জোগাতে রাজা-রাজড়ারা বাড়াতেন করের বোঝা। ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধের খরচ জোগাড় করতে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি কর আরোপ করলেন শ্রেণি ধরে।
ডিউকদের ওপর ৬ পাউন্ড ১৩ শিলিং ৪ পেনি, আর্লদের ওপর ৪ পাউন্ড, ব্যারনদের ওপর ২ পাউন্ড কর বসালেন ইংল্যান্ডের রাজা। আর ১৫ বছরের বেশি বয়সী যেসব নাগরিকের আয় ৪০ শিলিংয়ের কম, তাদের ওপর আরোপ করলেন ৪০ পেনি কর।
এই শ্রেণিভিত্তিক করব্যবস্থা অবশ্য নতুন উদ্ভাবন ছিল না। এর আগে ১৩৭৯ সালেও এ রকম করারোপের চেষ্টা করেছেন ইংরেজ শাসকেরা। এর পরেও এ ব্যবস্থায় কর আদায় করেছে।
১৬৮৯ থেকে ১৬৯৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটেন মানুষের সামাজিক অবস্থান ও অবস্থার ভিত্তিতে নানা ধরনের কর আরোপ করেছে। ১৬৯৫ সালে ফ্রান্সও শ্রেণিভিত্তিক করব্যবস্থা চালু করে। দেশটি মোট ২২ ভাগে বিভক্ত করে মানুষকে। শ্রেণিবিন্যাসের চূড়ায় থাকা অভিজাত ব্যক্তিকে কর দিতে হতো শ্রেণিবিন্যাসের তলানিতে থাকা নিম্ন আয়ের মানুষের চাইতে ২২০০ গুণ বেশি।
প্রুশিয়াতেও ১৮২১ সালে শ্রেণিভিত্তিক কর চালু হয়। নগরাঞ্চলের সমাজকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয় সেখানে। ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত প্রুশিয়ায় এ ব্যবস্থা চালু থাকে।
তবে শ্রেণিভিত্তিক করব্যবস্থার সমস্যাও ছিল অনেক। ইংল্যান্ডে যেমন উচ্চ মর্যাদার অনেক ডিউকের চাইতে নিম্ন মর্যাদার বহু আর্লের আয়-রোজগার অনেক বেশি ছিল। সময়ের পরিক্রমায় সমাজব্যবস্থা আরও জটিল হলো। শুধু সামাজিক মর্যাদাই যথেষ্ট হলো না মোটা অঙ্কের কর পরিশোধ করতে। তবে আজও অনেক দেশে এ রকম কর ব্যবস্থা চালু রয়েছে; আয় অনুসারে কর দিতে হয় জনগণকে। এজন্য ধনীদের উপর আরো বেশি করারোপের দাবি উঠে প্রায়ই।
পণ্যের ওপর কর
আঠারো শতকে ইংল্যান্ডে ধনীরা ব্যয়বহুল হ্যাট ব্যবহার করত, আর দরিদ্ররা মাথায় পরত সবচেয়ে সস্তা হ্যাট। ১৭৮৪ সালে এই হ্যাট নিয়েই ব্রিটিশরা পড়ল বিপাকে। ওই বছর ব্রিটিশ সরকার হুকুম জারি করল, প্রত্যেক হ্যাটের লাইনিংয়ে রেভেনিউ স্ট্যাম্প থাকতে হবে। স্ট্যাম্পের দাম হবে হ্যাটের দামের অনুপাতে। যারা এই কর দিতে পারত না, তাদের মোটা জরিমানার মুখে পড়তে হতো।
এই করের অত্যাচার থেকে নিস্তার পেতে হ্যাট প্রস্তুতকারকেরা এই পণ্যটিকে 'হ্যাট' নাম দেওয়াই বন্ধ করে দিল। সরকার বাহাদুরই বা কম যায় কিসে? ১৮০৪ সালে ব্রিটিশ সরকার নতুন করে হুকুম জারি করল, মাথায় পরিধেয় সব ধরনের জিনিসের ওপর শুল্ক দিতে হবে।
এদিকে ওই সময় পরচুলা পরত মূলত অবস্থাসম্পন্ন মানুষেরা। এ ব্যাপারটিও কর কর্মকর্তাদের শ্যেনদৃষ্টি এড়াল না। ফলাফল তো অনুমেয়ই, ১৭৯৫ সালে নতুন এক কর চালু করল ব্রিটিশ সরকার। পরচুলার দুর্গন্ধ ঠেকাতে যে সুগন্ধি পাউডার ব্যবহার করতেন নারী ও পুরুষেরা, সেই পাউডার ব্যবহারের অধিকার পেতে হলে বছরে দিতে হবে এক গিনি করে কর।
আঠারো ও উনিশ শতকে অবস্থাপন্নদের ব্যবহৃত ভোগ্যপণ্যের ওপর আরও নানা ধরনের কর আরোপ করেছিল ব্রিটেন। 'বিলাসপণ্যের ওপর কর আরোপ করতে হবেৃকারণ সবার আগে ধনী ও সম্পদশালীদের ওপরই বোঝাটা পড়া উচিত'— এই নীতি নিয়েছিল ব্রিটেন ওই সময়।
ওই যুগে বিশেষ কিছু পণ্যের ব্যবহার বা মালিকানা গ্রহণ মানেই ছিল কর পরিশোধের দায় বর্তাবে কাঁধে। দেয়ালঘড়ি, হাতঘড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, রেসের ঘোড়া এবং কুলচিহ্ন (কোট অভ আর্মস)— এই সবকিছুর ওপরই আলাদা আলাদা কর দিতে হতো।
এ ছাড়া ব্রিটেনে কর বসানো হয়েছিল পুরুষ চাকরদের ওপরও। ১৭৭৭ থেকে ১৮৮২ সাল পর্যন্ত কতজন পুরুষ চাকর নিয়োগ করেছে, তার সংখ্যার ওপর কর দিতে হতো নিয়োগদাতাকে। প্রথম ১০ জন চাকরের জন্য বছরে দিতে হতো মাথাপিছু ২৫ শিলিং; এর পরের প্রতিজনের জন্য দিতে হতো মাথাপিছু ৩ পাউন্ড। এভাবে চাকর যত বাড়ত, সেই অনুপাতে বাড়ত করের হারও।
ধনীদের ওপর বেশি কর আরোপের এই প্রথা আজও চালু আছে, শুধু একটু ভিন্ন রূপে। এখন সাধারণত বিলাসবহুল হিসেবে তালিকাভুক্ত পণ্যের ওপর চড়া আমদানি শুল্ক বা কর দিতে হয়। এ রকম দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০১৬ সালে ১.৩ মিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ২ লাখ ডলার) মূল্যের 'অতি-বিলাসী যানবাহনের' ওপর ১০ শতাংশ কর বসায় চীন। নাইজেরিয়ায় আমদানি করা নৌকা আর বিলাসবহুল গাড়ির ওপর ৭০ শতাংশ কর দিতে হয়।
নারীত্বের ওপর কর
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের রাজারা নিম্নবর্ণের মানুষদের বশে রাখতেন তাদের ওপর চড়া কর আরোপ করে। ভারতের বহু অঞ্চলের কৃষকদের গয়না পরার জন্যে অথবা গোঁফ পরার জন্যে কর দিতে হতো।
ভারতবর্ষের কিছু অঞ্চলে আবার নারীরা কাপড় দিয়ে স্তন ঢেকে ঘর থেকে বের হলে কর দিতে হতো। অর্থাৎ বিনা করে নীচু জাতের নারীদের লজ্জা নিবারণের অধিকার ছিল না। স্তন ঢেকে ঘর থেকে বের হওয়ার বিলাসিতা করার অধিকার ছিল কেবল উঁচু বরনের নারীদের।
এই করের নাম ছিল মুলাক্কারাম। এ স্তন কর আরোপ করা হয়েছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, নিম্নবর্ণের নারীদের অপমান করার জন্য।
কথিত আছে, ১৮৪০ সালে ট্রাভাঙ্কুর রাজ্যের (বর্তমান দক্ষিণ ভারতে) চেরথালা নগরের নাঙ্গেলি নামে এক নারী স্তন কর দিতে অস্বীকৃতি জানান। প্রতিবাদে তিনি নিজের স্তন কেটে কলাপাতায় করে কর সংগ্রাহকের হাতে তুলে দেন। ওই দিন রাতেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান নাঙ্গেলি। শেষকৃত্যের সময় নাঙ্গেলির স্বামীও তার জ্বলন্ত চিতায় লাফিয়ে পড়েন। পরদিন সরকার স্তন কর বাতিল করে। চেরথালা পরবর্তীতে 'মুলাচিপারাম্বু', অর্থাৎ 'স্তনধারী নারীর ভূমি' নামে বিখ্যাত হয়ে যায়।
প্রায় ওই একই সময়কালে আধুনিক নারী অধিকার আন্দোলনকারীরাও সমতা ও অতিরিক্ত করের বোঝার বিষয়টি খেয়াল করতে শুরু করেন। নারী অধিকার আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে আন্দোলনকারীরা কর দিতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকেন। ১৮৫২ সালে ন্যাশনাল উইমেনস রাইটস কনভেনশনে বিখ্যাত অধিকারকর্মী সুজান বি অ্যান্টনি ঘোষণা দেন, সরকারে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সম্পত্তির মালিক নারীদের উচিত হবে কর দেওয়া বন্ধ রাখা।
যুক্তরাজ্যে উইমেনস ট্যাক্স রেজিস্ট্যান্স লিগের স্লোগান ছিল, 'নো ভোট, নো ট্যাক্স'— অর্থাৎ নারীদের ভোটের অধিকার না দিলে তারা কর দেবেন না। ক্লেমেন্স হাউসম্যান নামে কমিটির এক সদস্য তো ঘোষণাই দিয়ে বসেন, তিনি কর দেবেন না, কর্তৃপক্ষ তাকে জেলে ঢোকাক। তার জেরে এক সপ্তাহ জেলও খাটতে হয় তাকে।
যুক্তরাজ্যের একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল, বিবাহিত নারীদের তাদের আয়ের ওপর কর দিতে হতো না; নারীদের আয়কর দেওয়ার ভার ছিল স্বামীদের ওপর। এই নিয়মের ফলে বিপাকে পড়েছিলেন উইমেনস ট্যাক্স রেজিস্ট্যান্স লিগের কোষাধ্যক্ষ এলিজাবেথ উইল্কসের স্বামী মার্ক উইল্কস। স্বামীকে নিজের আয়করের ব্যাপারে কিছুই জানাননি এলিজাবেথ। ফলে স্বামী বেচারাও স্ত্রীর আয়কর পরিশোধ করেননি। তার জেরে জেলে যেতে হয়েছিল মার্ক উইল্কসকে।
আজকাল করের ক্ষেত্রে তেমন লিঙ্গভেদ আর নেই। তবে কিছু ব্যতিক্রম এখনও রয়েছে। যেমন মরক্কোতে বিবাহিত পুরুষ তার ওপর আর্থিকভাবে নির্ভরশীল স্ত্রী এবং ছয়টি পর্যন্ত সন্তানের জন্য কর রেয়াত নিতে পারেন। কিন্তু বিবাহিত নারী যদি প্রমাণ করতে পারেন যে তার স্বামী ও সন্তানেরা তার ওপর নির্ভরশীল, কেবল তখনই এই কর রেয়াত পান। তবে এমন ঘটনা দিন দিন কমে আসছে। আজকাল করারোপের ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদ করা হয় খুব সূক্ষ্মভাবে।
ট্যাম্পন বা স্যানিটারি প্যাড এর একটা উদাহরণ। ট্যাম্পনের ওপর থেকে কর তুলে দিতে ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাসেম্বলিতে একটি বিল উত্থাপন করা হয়। বলা হয়, এটি 'লিঙ্গ বৈষম্যতা দূর করার পথে সঠিক পদক্ষেপ'। ২০১৬ সালে শিকাগো, ইলিনয় ও নিউইয়র্কে ট্যাম্পন ও স্যানিটারি টাওয়েল থেকে কর তুলে নেওয়া হয়। বিশ্বজুড়ে আরও অনেকেই ট্যাম্পনকে করমুক্ত করার দাবি জানাচ্ছেন।
২০১৫ সালে ৭৫ হাজার মানুষ একটি পিটিশনে স্বাক্ষর করার পর কানাডা নারীদের স্বাস্থ্য সামগ্রির ওপর থেকে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর তুলে নেয়। ফ্রান্সে ভ্যাটের হার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫.৫ শতাংশ করা হয়। যুক্তরাজ্য ইইউ থেকে বেরিয়ে এসেই ২০২১ সালে ট্যাম্পনের ওপর থেকে ভ্যাট তুলে নেয়।
তবে পরোক্ষভাবে পুরুষের ওপরও কিছু করের বাড়তি বোঝা আছে। পুরুষ যেহেতু নারীদেও চেয়ে ধূমপান ও খেলাধুলা বেশি করে, সে জন্য এসব পণ্যের ওপর তাদের করও দিতে হয় একটু বেশি। স্বাস্থ্যসেবার ওপর কম করেরে খানিকটা বাড়তি সুবিধাও পায় নারীরা— কারণ, গড়ে পুরুষেরা নারীদের চাইতে কম চিকিৎসা গ্রহণ করে।
শাস্তি হিসেবে কর
বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি সাধারণত বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ, কখনো কখনো মৃত্যুদণ্ডও। ফরাসি বিপ্লবের সময় গিলোটিনে প্রাণদণ্ড দেওয়া ব্যক্তিদের সম্পত্তি সরকার দখলে নিয়ে নিত। এ রকম আরও অনেক উদাহরণ আছে। প্রাচীন রোমে (৯০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে) বিশ্বাসঘাতকদের জমিজমা ছিনিয়ে নেওয়া ছিল সুলার মতো স্বৈরাচারী শাসকদের আয়ের ভালো একটা উপায়। কখনো কখনো অভিযুক্ত সত্যিই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে কি না, তা-ও নিশ্চিত হওয়ার গরজ বোধ করত এই শাসকেরা।
গৃহযুদ্ধ ও সংস্কারের যুগের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক ব্যর্থতার শাস্তি হিসেবে করের বোঝা টানার কাছাকাছি চলে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। ওই সময় দেশটি সেনাশাসনের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছিল। ১৬৫৫ সালে অলিভার ক্রমওয়েল নতুন কর আরোপ করেন। এর আওতায় সংস্কারের বাইরে থাকা যেসব রাজতন্ত্রবাদী ১৪৬ একরের বেশি জমির মালিক অথবা বছরে ১০০ পাউন্ড আয় আসে এমন এস্টেটের মালিক ছিলেন, তাদের আয় থেকে ১০ শতাংশ কর কেটে নেওয়া হতো। ১৬৪৯ সালে নিহত হওয়া রাজা কিংবা তার ছেলে চার্লস স্টুয়ার্টের পক্ষে যারা লড়াই করেছিলেন— অথবা এই দুজনকে আনুগত্য, সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন— তাদের ওপর কর আরোপ করা হয়। রাজতন্ত্রবাদী অনেককেই পরে নিজ পক্ষে যোগ দেওয়ার সুযোগ দেন ক্রমওয়েল।
তবে এই কর বাস্তবায়ন করাটা ঝামেলা ছিল। কারণ, ঠিক কোন কাজ করলে রাজা ও তার ছেলেকে সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা হিসেবে বিবেচিত হবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। সমস্যা ছিল আরও একটা। নতুন নিয়মানুসারে, কারও আয় ৯৯ পাউন্ড থেকে মাত্র ১ পাউন্ড বেড়ে ১০০ পাউন্ড হলেই তাকে বাড়তি ১০ পাউন্ড কর গুনতে হতো। এর ফলে সবাই বার্ষিক আয় ১০০ পাউন্ডের কম দেখানোর জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা শুরু করল।
বহু মানুষ আজও বিশ্বাস করে, কর আরোপ করা হয় শাস্তি হিসেবেই। ২০০৭ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর প্রতিহিংসার বশেই আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকারদের ওপর আরও বেশি কর আরোপের দাবি আসতে থাকে। তবে কারও ওপর প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে কর জিনিসটা খুব একটা ভালো না। কারণ, যাদের ওপর রাগের বশে করারোপ করা হয়, সে সাধারণত তত দিনে মরেই যায়। যেমন অলিভার ক্রমওয়েল যখন রাজতন্ত্রের সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষকদের ওপর মোটা করারোপ করেন, তত দিনে তাদের বেশির ভাগই হয় মরে গেছেন, নইলে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।