অনিরাপদ নির্মাণকাজের জন্য জীবন হারিয়ে ঈদে কফিনে করে ঘরে ফিরলেন হাসান
মুসলমানদের পবিত্র রাতে মসজিদে শব-ই-কদরের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ হাসান (৪৬)।
শনিবার (৬ এপ্রিল) সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর এলাকার সাত মসজিদ হাউজিংয়ের মূল সড়কে একটি নির্মাণাধীন ভবনের কলাম ভেঙে মাথায় পড়ে এ পথচারীর মৃত্যু হয়।
নিহত হাসানের প্রতিবেশী শফিউর রহমান বলেন, 'মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ হাউজিংয়ের একটা নির্মাণাধীন ভবনের কলাম ভেঙে তার মাথায় পড়লে তিনি গুরুতর আহত হন।
'আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।'
প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, ভবনের নির্মাণকাজে চরম অবহেলার কারণে মৃত্যু হয়েছে পথচারী হাসানের। আবাসিক এলাকার ব্যস্ততম প্রধান সড়কের পাশে নির্মাণকাজের কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না। সেই নির্মাণকাজ এখনও চলছে।
পেশায় ফার্মাসিউটিক্যাল এক্সিকিউটিভ মোহাম্মদ হাসান (৪৬) তার পরিবারের সঙ্গে ওই এলাকাতেই থাকতেন।
মৃত হাসানের বাড়িতে তার অসুস্থ মা মাসুমা খাতুনের (৮২) সঙ্গে দেখা করেন টিবিএসের এই প্রতিবেদক। মাসুমা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গত এক দশক ধরে শয্যাশায়ী। হাসানই ছিলেন তার একমাত্র জীবিত সন্তান।
নিহতের শ্যালক সেলিম জানান, হাসান চট্টগ্রামের আনোয়ারা এলাকার জুঁইদণ্ডী গ্রামের ফজল আহমেদের ছেলে। ১২ ভাইবোনের মধ্যে ১১ জন বিভিন্ন সময়ে মারা গেছেন, একমাত্র হাসানই বেঁচে ছিলেন। তার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। অসুস্থ মায়ের সঙ্গে সাত মসজিদ হাউজিংয়ের ৭ নম্বর রোডের একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি।
সেলিম জানান, ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল হাসানের। 'তিনি গতকাল বিকেলে আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, এই ঈদে সবাইকে নিয়ে বাড়িতে যাবেন। কিন্তু ভাবতেও পারিনি যে তিনি কফিনে শুয়ে বাড়িতে যাবেন।'
নিহতের ছেলে মাহিম জানায়, তারা তিন ভাই-বোন। তার বড় ভাই ফাহিম মোহাম্মদপুরের একটি স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, এখন ফলাফলের অপেক্ষায় আছে। মাহিম একই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। বাবার অকাল মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ মহিম আর কোনো কথা বলতে চায়নি।
এদিকে সেলিম বাদী হয়ে অপমৃত্যুর মামলা করেছেন।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা হয়েছে। ১৩ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৪০ থেকে ৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে মামলায়। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত হয়েছে হাসানের। চট্টগ্রামের আনোয়ারায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।
ভবনে নেই নিরাপত্তা বেষ্টনী
স্থানীয়রা জানান, একজন পুলিশ পরিদর্শকসহ মোট ২৮ জন মালিক আছেন নির্মাণাধীন ভবনটির। ওই পরিদর্শকের তত্ত্বাবধানে গত তিন মাস ধরে নির্মাণকাজ চলছিল। ব্যস্ত রাস্তার পাশে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও সাইটে কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী দেওয়া হয়নি।
রোববার বিকেলে ঘটনাস্থলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পথচারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'নিরাপত্তা বেষ্টনী তো নেই-ই, এছাড়া নির্মাণাধীন ভবনটিতে এমন কোনো সাইনবোর্ডও নেই যা পথচারীদের সেখানে নির্মাণকাজ সম্পর্কে জানাবে। নির্মাণসামগ্রী রাস্তার ওপর ফেলে রাখা হয়েছে। নির্মাণের যন্ত্রপাতি চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।'
তিনি আরও বলেন, 'মর্মান্তিক ওই মৃত্যুর পরদিনও নির্মাণকাজ চলছে।'
মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খালের পাশে অবস্থিত ভবনটি ইরাদা বিল্ডার্স লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি নির্মাণ করছে।
স্থানীয়রা জানান, হাফিজুর রহমান নামে একজন পুলিশ পরিদর্শক নির্মাণকাজের তদারকি করতেন। তিনি কাফরুল থানার সাবেক ওসি, বর্তমানে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) কর্মরত।
তবে ইন্সপেক্টর হাফিজুর নির্মাণাধীন ভবন বা ইরাদা বিল্ডার্সে তার কোনো শেয়ার বা জমির মালিকানা থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'এখানে আমার কোনো জমি নেই। শুনেছি আমার আত্মীয়-স্বজনের কেউ এই জমিতে শেয়ার কিনেছে।'