চুড়ি চাই চুড়ি, কোথা থেকে আসে এসব চুড়ি?
উচ্চ মাধ্যমিকে কেবল ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যেই একদিন পাত্রপক্ষ এসে ঠিক করে গেলেন বিয়ের দিনক্ষণ। বউ সাজবেন সেলিনা। এই বউ সাজা নিয়ে তার ছোটোবেলা থেকেই কতশত শখ। হাতভর্তি রেশমি চুড়ি পরতে হবে, বাহুতে থাকবে বাজু, মাথায় সোনার টায়রা, পায়ে আলতা-নূপুর, ঠোঁটে লাল রঙ— আরও কত কী!
সময়মতো বরপক্ষের দেওয়া শাড়ি-গয়না পৌঁছে গেলো কনের বাড়ি। সেলিনা বসলেন বউ সাজতে। ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন সেলিনা, তেমনই সাজানো হলো তাকে। চাটগাঁইয়া বিয়ে, তাই এক কথায় সোনার গয়না দিয়ে মোড়ানো হয়েছে তাকে। কিন্তু এত গয়নার মাঝেও সেলিনার মন কেড়ে নিয়েছিল ছয় ডজন কাঁচের চুড়ি। টকটকে লাল রঙা ছিল সে চুড়িগুলোর। সেলিনাকে দেখাচ্ছে একদম লাল টুকটুকে বউয়ের মতো। অতিথিরাও দেখতে এসে একের পর এক তারিফ করে যাচ্ছে তার সাজের, গয়নার।
কিন্তু এর মধ্যেই বাঁধল বিপত্তি। ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে গেলো হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি। ব্যস! নতুন বউয়ের কান্না শুরু। এত গয়নার মাঝে কাঁচের চুড়ি ভাঙলে কী এমন এসে যায়! কিন্তু সেলিনার কান্না যে আর থামেনা। চুড়িটিই তো তার সবচেয়ে প্রিয়। কেবল তার বাবা জানতেন, মেয়ের কান্না থামানো যাবে, যদি আবার এই লাল রেশমি চুড়ি এনে দেওয়া যায়।
যদিও বাড়ি থেকে ৫-৪ কিলোমিটার দূরত্বে ছিল বাজার। কিন্তু মেয়ের কান্না তো থামাতে হবে! তাই দেরি না করেই সাইকেলে চেপে যাত্রা করলেন লাল চুড়ির সন্ধানে। অনেকগুলো দোকান ঘুরে খুঁজে আনলেন লাল রঙের রেশমি চুড়ি। সেই চুড়ি পেয়ে কনে কী যে খুশি! ভালোয় ভালোয় বিয়ের অনুষ্ঠানও শেষ হলো এরপর।
রিনিঝিনি শব্দ না হলে সে আবার কেমন চুড়ি?
শুধু সেলিনাই নন, গ্রাম বাঙলার সব বউদের বিয়ের দিনে চুড়ি চাই-ই চাই। নয়তো বউ বউ লাগেনা— এমন ধারণাই ছিল সবার। আবার সেসব চুড়ি হতে হতো কাঁচের।
নব্বই দশকের কথা। ছোট্ট কুলসুম বাবার সাথে মেলায় বায়না ধরে চুড়ি কিনবে। কিন্তু বাবার কাছে টাকা ছিল না সেদিন। চুড়ি না পাওয়ায় তাই মনে একরাশ দুঃখ ছিল তার। পরেরদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখে বিছানার এক পাশে লাল-নীল চুড়ি। তার কাছে চুড়ি মানেই সাজ। আর যেদিন চুড়ি পরতো সে, সেদিন তাকে ঘুরতেই হবে। সবাইকে দেখাতে হবে না নতুন চুড়ি!
বিয়ের পরেও কুলসুমের চুড়ির প্রতি ছিল আলাদা টান। তার বর কাজ করতেন শহরে। ছুটিতে যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন শহর থেকেই কিনে ফিরতেন কুলসুমের পছন্দের সব সাজসজ্জার সামগ্রী। আর এতকিছুর মধ্যে চুড়ি নিতে ভুল করতেন না কখনো!
কুলসুম বলেন, "আমাদের সময়ে কোনো মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে তার হাতের চুড়ির শব্দে আর নূপুরের শব্দেই বোঝা যেত যে কোনো মেয়ে যাচ্ছে! ছোটো ছোটো মেয়েরা হাতভর্তি চুড়ি পরেই সারাবাড়ি দাপিয়ে বেড়াতো। ওদের কাছে সাজ মানেই ছিল হাতে চুড়ি। সে চুড়িকে আবার হতে হবে কাঁচের। রিনিঝিনি শব্দ না হলে সে আবার কেমন চুড়ি।"
নানা রঙের নানা অর্থ!
খ্রিস্টপূর্ব দেড় হাজার বছর আগে রোমান সভ্যতায় চুড়িতে কাঁচের ব্যবহারের কথা জানা যায়। কাঁচের রেশমি চুড়ি একসময় বেশ পাতলা ছিল। তখন অবশ্য আজকের মতো হাতের কাছে চুড়ির দোকান ছিল না। ইচ্ছে হলেই যখন তখন কেনা যেতো না চুড়ি। মেলা থেকেই কিনতে হতো। অথবা সপ্তাহে এক দুইবার যে হাট বসতো গ্রামে, সেখান থেকে কিনতে হতো।
সেসব হাটে আবার সবসময় চুড়ি পাওয়াও যেতো না। হঠাৎই দেখা মিলতো এসবের। গ্রামের মেয়েরা তাই ভিড় করতেন হাটে-মেলায় চুড়ি কিনতে। মাঝেমধ্যে আবার ফেরিওয়ালা চুড়ি ফেরি করতে করতে গ্রামে ঢুকে পড়লে গ্রামের সব নারীরা তাকে ঘিরে ধরতেন। এরপর দরদাম করে কিনতেন নানা রঙবেরঙের চুড়ি। রঙবেরঙের এসব চুড়ির অর্থও কিন্তু ভিন্ন! যেমন-
লাল চুড়ি- ক্ষমতা এবং ভালোবাসা
নীল চুড়ি- জ্ঞান
বেগুনি চুড়ি- স্বাধীনতা
সবুজ চুড়ি– ভাগ্যবতী/বিবাহিত, উর্বর
হলুদ চুড়ি– সুখী
কমলা চুড়ি– সাফল্য
সাদা চুড়ি– নতুন জীবনের শুরু
কালো চুড়ি– শক্তি
রুপালি চুড়ি– তেজ
সোনালি চুড়ি– ভাগ্য।
আগের মতো, এখন চুড়ি কিনতে এত অপেক্ষায় থাকতে হয়না। চাইলেই হাতের কাছে পাওয়া যায় রঙ বেরঙের চুড়ি। শুধু চুড়ির জন্যই আছে এখন হাজারো দোকান। ডিজাইনেও আছে বৈচিত্র্য। গ্রামে গঞ্জেও একই চিত্র দৃশ্যমান।
উপমহাদেশে ঢাকার চুড়ির বেশ খ্যাতিও ছিল
তবে রিনিঝিনি শব্দের চুড়ি হতে হবে এই ধারণা থেকে অনেকেই এখন বেরিয়ে এসেছেন। চুড়ি পরার উপলক্ষও বা চুড়ির উপকরণেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। এখন মেয়েরা যেমন শাড়ি-কামিজের সাথে চুড়ি পরছে, তেমনি পরছে শার্ট প্যান্ট বা পশ্চিমা পোশাকের সাথেও।
কেবল শাড়ির সাথেই কাঁচের রেশমি চুড়ি পরতে হবে এই ছোট্ট পরিসরে আর আটকে নেই এখনকার মেয়েরা। বাজারে এখন ফাইবার, মেটাল, সুতাসহ নানা ধরনের চুড়িও পাওয়া মেলে। হোক শার্ট-প্যান্ট, হোক শাড়ি ফতুয়া, হোক কাপড়ের চুড়ি বা কাঠ বা কাঁচ বা প্লাস্টিক। কখনো দু হাতে কখনো বা একহাতে নিজেদের পছন্দমতো সাজিয়ে তুলছেন নিজেকে। আর এইসব চুড়ির যোগান আসে চকবাজারের চুড়িহাট্টা থেকে।
যদিও চকবাজারের চুড়িহাট্টার নাম শুনলেই সবার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির সেই ভয়াবহ অগ্নিদগ্ধের কথা। কিন্তু এই চুড়িহাট্টার নামকরণ হয়েছিল 'চুড়ির হাট'কে কেন্দ্র করেই। মোগল আমল থেকেই মুসলমান কারিগরেরা কাঁচের চুড়ি তৈরি করে পুরোন ঢাকার চকবাজারে বেচাকেনা করতেন। ফজরের আজানের পর শুরু হতো বিকিকিনি আর শেষ হতো মাগরিবের আজানের আগে।
নাজির হোসেন তার কিংবদন্তী ঢাকা বইয়ের উল্লেখ করেছেন, 'চকবাজারের সন্নিকটেই রয়েছে চুড়িহাট্টা। একসময় এখানকার মুসলমানরা কাঁচের চুড়ি নির্মাণ করতো। উপমহাদেশে ঢাকার চুড়ির বেশ খ্যাতিও ছিল। চুড়িহাট্টাতেই ঢাকার চুড়ি কারখানা অধিক ছিল। পরবর্তীতে অনেক কারিগর ঢাকা থেকে মধ্য ভারতে চলে যায়।'(পৃ ৩১২)
জানা যায়, চুড়িহাট্টা মসজিদটিও নির্মিতি হয়েছিল চুড়ির এইসব কারিগরদের নামায পড়ার উদ্দেশ্যেই।
ময়ূরী চুড়ি, জয়পুরী চুড়ি, দেবদাস চুড়ি…
চকবাজারের চুড়িহাট্টায় এখনো আছে সারি সারি চুড়ির দোকান। চকবাজার শাহি মসজিদের বিপরীতে গোটা পনেরো চুড়ির দোকান রয়েছে। সাধারণ চুড়ি থেকে শুরু করে বউ সাজের চুড়ি, কাচের, মেটালেরসহ হরেক রকমের চুড়ির সন্ধান পাওয়া যায় এসব দোকানে।
কাঁচের চুড়ি, মেটালের চুড়ি, সিটিগোল্ডের চুড়ি- যাই হোক না কেন, এসব চুড়ির আছে বিভিন্ন নাম। রেশমি চুড়ি, খাজকাটা চুড়ি, বউ চুড়ি, বিয়ের ফুল, কাশফুল, মুসকান, রুপকথা, বাংলালিংক চুড়ি , সুতা চুড়ি, ময়ূরী চুড়ি, জয়পুরী চুড়ি, দেবদাস চুড়ি, কাচের চুড়ি, নেপালী চুড়ি সহ হরেক নামের চুড়ির দেখা মেলে চকবাজারে। এর মধ্যে রেশমি চুড়ির ইতিহাস প্রায় একশো বছর ধরে। সম্ভ্রান্ত জমিদার ও নবাব পরিবারে নারীদের হাতে চুড়ি পরা ছিল তখনকার সময় বাধ্যতামূলক একটি ব্যাপার। নব্বই দশক পর্যন্ত রেশমি চুড়িই ছিলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। এরপর আসে বউ চুড়ি। ২০০০ সালের পর থেকে জনপ্রিয় হতে শুরু করে বউ চুড়ি।
রেশমি চুড়ির পাশাপাশি ময়ূরী চুড়িও বেশ জনপ্রিয় ছিল তখন। ময়ূরী চুড়ির উপরে মুক্তার মত পাথর বসানো থাকতো এবং স্বর্ণের পানিতে ডুবিয়ে সোনালি করা হতো। ফলে বিবাহিত নারীরা সেসব চুড়ি কিনতেন ডজন ডজন করে।
নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি বিক্রি
প্রতিটি চুড়িরই আগের চেয়ে দাম বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে দ্বিগুণ। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে কাঁচামালের দাম যেমন বাড়তি, তেমনি বাড়তি কর হারও। আগে যেখানে রেশমি চুড়িরই একক আধিপত্য ছিল, সেখানে এখন জায়গা করে নিয়েছে দেশিবিদেশি নানা চুড়ি। তারপরও শুধু রেশমি চুড়ির দামই বেড়ে হয়েছে তিনগুণ।
আগে এক বুরুস (৬ বান্ডিল বা ২৪ মুঠ। এক বান্ডিলে চুড়ি থাকে ৪ ডজন) রেশমি চুড়ির দাম ছিল ৪০০ করে। সে দাম বেড়ে হয়েছে ৭০০ টাকা। কয়েক বছর আগেও ৩০ টাকায় পাওয়া যেতো এক ডজন রেশমি কাঁচের চুড়ি। এখন তা দাঁড়িয়েছে ৪০-৫০ টাকায়। ৩০ টাকায় যেটা ক্রেতারা কিনতেন পাইকারে তা বিক্রি হতো ১০-১২ টাকায়। রেশমি চুড়ি ছাড়াও অন্যান্য যেসব চুড়ির দাম ৬০-৭০ ছিল, এখন তা বিক্রি হয় ১৫০-২০০ টাকায়। ভারী কাজকরাগুলো ৩০০-৪০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।
তবে এত কিছুর ভিড়েও থেমে নেই বিক্রির কাজ। বরং চকবাজারের চুড়ির পাইকারী বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আগের তুলনায় বেড়েছে চুড়ি বিক্রি।
মূলত সারাদেশেই চুড়ি সরবরাহ হয়ে থাকে এই চকবাজার থেকে। তবে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম এবং সিলেটে চুড়ির চাহিদা সবচেয়ে বেশি বলে জানান চুড়ির পাইকারী বিক্রেতারা। বছরের বারো মাসে কেনাবেচা ভালো থাকলেও নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারিতে চুড়ি ক্রয়-বিক্রয় সর্বোচ্চ হয়। আবার ঈদ, নববর্ষ এবং ফাল্গুনের সময়েও চুড়ির অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। এতে বাজার অবস্থা যেমন ভালো, তেমনি চুড়ির কারখানার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশীয় এসব চুড়ি তৈরি হয়ে থাকে মূলত কামরাঙ্গীর চর এবং লালবাগের শহীদনগরে। আর ঢাকার বাইরে সবল্পপরিসরে জেলাপর্যায়ে এই চুড়ির কারখানা রয়েছে বরিশাল এবং কুমিল্লা অঞ্চলে।
রেশমী চুড়ি আমাদের নয়, আসে ভারত থেকে
তবে মজার ব্যাপার হলো, যে রেশমি চুড়িকে আমরা এতদিন দেশীয় চুড়ি বলে জানতাম, তা মূলত আমদানি হয় ভারত থেকে। সেই প্রথম থেকেই ভারত থেকে আমদানি হয়ে আসছে চুড়িটি। কারণ রেশমি চুড়ি বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় যে কাঁচামাল এবং দক্ষ কারিগর লাগে, তার যোগান নেই এই দেশে। তার ওপর এখন অন্যান্য চুড়ির আবেদন বাড়লেও, কমেনি রেশমি চুড়ির চাহিদা। ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা।
চুড়ির পাইকারি বিক্রেতা রাশেদুল বলেন, "অনেকেই ভাবে রেশমি চুড়ি বাংলাদেশের, কিন্তু এই চুড়ি কোনো সময়েই দেশে তৈরি হয়নি।"
আরও উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো বর্তমানে চুড়ির বাজারে ভারতীয় চুড়ির ক্রেতা তৈরি হয়েছে অনেক। এর অন্যতম কারণ পণ্যের গুণগত মান এবং ডিজাইনে ভিন্নতা।
এমনকি বিক্রেতাদের কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশি এবং ভারতীয় চুড়ির বিক্রির পরিমাণ যদি হিসেব করা হয় তবে তা দাঁড়ায় ৫০-৫০ শতাংশতে। আবার, অনেকের মতে তা ৬০-৪০ শতাংশে।
দামের পার্থক্যের কারণেই বাংলাদেশের চুড়ির চাহিদা এখনো একটু বেশি বলে জানান তারা। ভারত এবং বাংলাদেশের কাঁচের চুড়ির দামে পার্থক্য বুরুসে ১০০ টাকা।
অন্যদিকে, গুণগত মানের কারণে ভারতীয় চুড়ি অনেক বেশি বাজার দখল করে রাখতে পেরেছে বলেও দাবি অনেক ব্যবসায়ীর। তবে ভারতই শুধু নয়, বাজারে আছে চীন, মিয়ানমার থেকে আসা চুড়িও। তবে ভারতীয় চুড়ির বাজারই বেশি জমজমাট।
বাংলাদেশে তৈরিকৃত চুড়ির এমন চাহিদার পেছনে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে তা হলো চুড়ির ক্ষেত্রে ভিন্নতা নিয়ে আসা। দোকানে দোকানে দেখা মেলে বিভিন্ন ডিজাইনের ৪০-৫০ ধরনের চুড়ির।
চুড়ির পাইকারি বিক্রেতা শাহাবুদ্দিন বলেন, "আগে চুড়ির কোন ভিন্নতা ছিল না। হাতেগোনা কয়েকটা চুড়িই ছিল কেবল। এখন কারখানার মালিকরাও বোঝেন কী করতে হবে। তারা বিভিন্ন ডিজাইনের চুড়ি তৈরি করে। এক একটা কারখানায় কম করে হলেও ৩-৪ ধরনের চুড়ি হয়।"
'এই কাজ করে উচু উচু বিল্ডিং ও করে ফেলেছে!'
চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বেড়েছে কারখানার সংখ্যাও। নব্বই দশকের দিকে শহীদনগরে চুড়ির কারখানা ছিল ২০-৩০টি। বর্তমানে সে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে অনেকগুণ।
মূলত ২০০০ সালের পর থেকেই অবাধে কারখানা বাড়তে শুরু করে বলে দাবি চুড়ির কারখানার মালিক মো. মিন্টুর। ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসার সাথে জড়িত তিনি। একসময় নিজেই কারিগরের কাজ করতেন। এখন নিজে একটি কারখানার মালিক।
শহীদনগরের পুরোনো ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনি একজন। মিন্টু বলেন, 'এই কামরাঙ্গীর চর এবং শহীদনগর মিলিয়ে শুধু চুড়ির কারখানা আছে প্রায় ৫০০টি। এখানে সর্বনিম্ন দশ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা ডজনে পাইকারি বিক্রি হয়। ছোট বড় এসব কারখানায় কমপক্ষে ২০ জন কাজ করে। কাজ করতে করতে কেউ সব শিখে ফেললে সে-ও একটা কারখানা দিয়ে বসে। চুড়ির চাহিদা না থাকলে কি এটা সম্ভব? অনেকেই তো এই কাজ করে উচু উচু বিল্ডিং ও করে ফেলেছে!'
একটি চুড়ি তৈরিতে পার করতে হয় ২৮ টি ধাপ
বরিশাল, কুমিল্লা থেকে স্বল্পভাগ এবং কামরাঙ্গীরচর এবং লালবাগের শহীদনগর থেকে চুড়িগুলো তৈরি হয়ে আসে চকবাজারে। আর চকবাজার থেকে নিউমার্কেট, গাউসিয়াসহ বিভিন্ন খুচরা মার্কেটে। তবে চুড়ি তৈরির জন্য যে কাঁচামাল, তা কিন্তু আসে আবার এই চকবাজার থেকেই!
সিলভারের তার, চুমকি, জরি, রং, মাটি ইত্যাদির সমন্বয়ে কীভাবে চুড়ি তৈরি করা হয় তা ব্যাখ্যা করছিলেন ষাটোর্ধ্ব জালাল উদ্দীন। তিনি বলেন, একটি চুড়ি তৈরিতে পার করতে হয় ২৮ টি ধাপ। প্রথমে হয় যান্ত্রিক কাজ। অর্থাৎ সিলভারের তারকে সোজা করা হয় একটি মেশিনে। আরেকটি মেশিনে সেগুলোকে লম্বা স্প্রিং এর মত করে কাটা হয়। তারপর অন্য একটি যন্ত্র দিয়ে সে স্প্রিংটাকে কাটা হয়। এতে গোলাকৃতির চুড়ির আকারে অনেকগুলো রিং হয়। আরেকটি যন্ত্রের মাধ্যমে স্প্রিং থেকে গোলাকৃতির আলাদা করা রিংগুলোকে আগুনের সাহায্যে জোড়া লাগানো হয়।
অন্য আরেকজন কারিগর জোড়ালাগানো গোল গোল চুড়ি থেকে অতিরিক্ত সিলভার ছাটাই করে বিভিন্ন ধরনের নকশা করেন (যেমন খাঁজকাটা)। আবার খাজকাঁটা করতে না চাইলে সেক্ষেত্রে একটি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে চুড়ির অন্য শেইপ বা আকার দেওয়া হয়। চুড়ি খাঁজকাটা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে হাত কেটে যায় বলে হাতের আঙ্গুলে নিরাপত্তার জন্য অনেকেই কাপড় বা রাবার পেঁচিয়ে নেন।
কাঁচের চুড়িগুলো আসে ঢাকার বাইরে থেকে
চুড়ির কাজ দুইরকম। যান্ত্রিক বা মেশিনের ভারী কাজগুলো করে থাকে ছেলেরা। অন্যদিকে, চুড়িকে সাজিয়ে তোলার কাজটি করে থাকে মেয়েরা।
সাধারণত কারখানার শ্রমিকর ৩ দিনে তৈরি করতে পারেন ১০০০ মুঠ চুড়ি। তবে কেউ কেউ আরও বেশি করে থাকেন। কর্মী কত পারদর্শী এবং দক্ষ সেটির উপরই তা নির্ভর করে। অন্যদিকে নারী কারিগররা জানান, দিনে ১০০০, ২০০০ এবং সর্বোচ্চ ৩০০০ পর্যন্ত চুড়ি সাজানোর কাজ করে থাকে নারী কর্মীরা।
এসব নারী কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চুড়ির মধ্যে বউচুড়ি সাজাতে হয় সবচেয়ে বেশি। আবার এতে কষ্টও আছে বেশ। অন্যান্য চুড়ির চেয়ে ভারী হয় বলে কষ্টটা একটু বেশি। কষ্ট বলতে ধৈর্য্য।
সিলভারের সমান একটি পাতকে গোল করে কাটা হয়। তারপর আগুনে জোড়া লাগিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নারী কর্মীদের কাছে। চ্যাপ্টা পাতের উপরে আঠা মেশানো মাটি লেপ্টে দেওয়া হয়। সে মাটির উপরে বসানো হয় পাথর, চুমকি, জরি ইত্যাদি। শুকানো শেষ হয়ে এলে অনেক শক্তভাবে লেগে যায় সেসব। পরে ডজনে ডজনে সাজিয়ে নিয়ে প্যাকেটে ভর্তি করে বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করে রাখা হয়। সেখানে লাভ হয় পাঁচ থেকে দশ টাকার মতো।
আবার কাচের চুড়ির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ধরনের কাঁচের বোতল, ভাঙা গ্লাস, রঙ ইত্যাদি। আগুনে কাঁচ গলিয়ে তৈরি করতে হয় বলে এই চুড়ি বানাতে তুলনামূলক বেশি কষ্ট। কেবল কাঁচের চুড়ি বানানোর ক্ষেত্রেই আগুনের ব্যবহার হয়ে থাকে। যদিও এক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে কাঁচের চুড়িগুলো আসে মূলত ঢাকার বাইরে বরিশাল আর কুমিল্লার দেওয়ানবাগ থেকেই। কারণ এ চুড়ি তৈরিতে পর্যাপ্ত যে জায়গা এবং গ্যাসের দরকার হয়, তার সংকুলান ঢাকায় হয়ে উঠে না। তবে অনেকসময় কাঁচামাল প্রস্তুত করে দেওয়া হলে বাকি কাজ করা হয় ঢাকার কারখানাগুলোতেই।
শহীদনগর এবং কামরাঙ্গীচরের এইসব কারখানায় তৈরিকৃত চুড়ি পাইকারি দামে কিনে নেয় চকবাজারের পাইকারীরা। সেখান থেকে সারা বাংলাদেশে সরবরাহ হয় এসব চুড়ি। কারখানার মালিকের কাছ থেকে যে দামে চকবাজারের পাইকারি বিক্রেতারা কিনে নেন, সেখানে দামের পার্থক্য হয় কেবল ৫-১০ টাকা। আবার চকবাজার থেকে যারা পাইকারি দামে কিনে নিয়ে যান তারা আবার আরেকটু বেশি দামে বিক্রি করেন সাধারণ ক্রেতাদের কাছে। সেখানে দামের পার্থক্য হয় ১০-১৫ টাকার। আবার কিছু চুড়ি বানাতে গিয়েই নষ্ট হয়ে যায়। এই সংখ্যা দিনে ৩০০-৫০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে।
আড্ডা, গান, চা খাওয়া, গল্পের ছলে ছলে জুটছে নারীদেরও কর্মসংস্থান
কামরাঙ্গীরচর এবং শহীদনগরের নারী-পুরুষরা নির্বিশেষেই যুক্ত এই কাজের সঙ্গে। এমনকি শিশুরাও জড়িত এসব কাজে। এলাকার বেশিরভাগ মানুষের পেশাও এটি। এই কাজের ভিত্তিতেই সাপ্তাহিক হিসেবে টাকা দেওয়া হয় শ্রমিকদের। কে কত বেশি কাজ করতে পারেন তার উপর নির্ভর করে তাকে কত টাকা দেওয়া হবে। তবে দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করার বিনিময়ে প্রত্যেক কর্মচারী সপ্তাহে ১,৫০০-২,০০০ করে মজুরি পান। মাস শেষে যা দাঁড়ায় ৮-৯ হাজারে। তবে কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে বেতনও বাড়ে তাদের।
১১ বছর বয়সী ফারজানা। ৩ বছর ধরে করছে চুড়ি সাজানোর কাজ। ফারজানার মত আরও অনেকেই করছে এসব। মূলত যাকে আমরা ডিজাইন করা বলি। শেষ কবে স্কুলে গিয়েছিল মনে নেই তার। পড়াশোনা করতে না পারার দু:খও নেই তার মধ্যে। কারণ এ কাজটি সে অনেক ভালোবাসে। চুড়িতে লাল নীল হলুদ জরি লাগাতে লাগাতে যখন মনের সুখে গুনগুন করে গান গায়। তখন অন্যরাও সেই সুরের তালে তালে চুড়িতে নকশা করতে থাকেন। তার গলার সুরে যেন বাকিদের ক্লান্তিও সব ঝরে যায়। ফারজানার কাছে এই কাজ বেশ মজার।
পড়াশোনা আর করবে কি-না জানতে চাইলে ফারজানার সরল স্বীকারোক্তি, "আমার চুড়ি বানাইতে বেশি ভালা লাগে। অতডা কষ্টও লাগে না। এহন আর কোথাও যাইতে মন চায় না, মজাই লাগে এইডায় জরি লাগাইতে।"
অনেকেই গার্মেন্টস ছেড়ে যুক্ত হচ্ছেন এই পেশায়
এখনকার অনেক মেয়েই আগে ঘরে বসে থাকতো। এখন তারাও কাজ করে টাকা আয় করছে। অনেকে আবার গার্মেন্টেসের কাজ ছেড়ে দিয়ে এই কাজে ধরেছে। মজুরি যদিও কম। কিন্তু কাজে আরাম, নিরাপত্তা এবং কম পরিশ্রমের বলে মজুরি কম নিয়ে অভিযোগ নেই তাদের।
নারী কর্মচারী রুকশানা বলেন, "গার্মেন্টসে যখন কাজ করতাম। পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে একটু ছুটি চাইতে গেলেও পাঁচজনের কাছে যাওয়া লাগত। ঐ যে সকালবেলা ঢুকতাম, আর বের হতাম রাত্রে। আর এখানে চাইলেই বাসা দিয়ে ঘুরে আসা যায়। একটু চা খেতে বেরিয়ে আসা যায়। যখন ছুটি লাগে নিতে পারি, চাপ নাই। কিংবা গল্প করতে করতে কাম করতে পারি।"
অনেক সময়ে এসব কর্মচারীদের বিয়ে হলে মহাজনের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয় চুড়ি। তবে নারী কর্মীদের আকর্ষণ বেশি থাকে সিটি গোল্ডের চুড়ির প্রতি। তারা যে চুড়ি তৈরি করেন, দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে সেসবের রঙ উঠে যায়। তাই সিটিগোল্ডেই তাদের ভরসা, বিশেষ করে ভারতীয় সিটিগোল্ড।
নারীর পূর্ণতা এবং সৌভাগ্যের প্রতীক
চুড়ির ইংরেজি Bangle, যা এসেছে মূলত বাঙ্গরী বা বাঙ্গালী শব্দ থেকে। সংস্কৃততে এর অর্থ-হাতকে অলংকৃত করে যে গহনা। ভারতীয় নারীদের জীবনে এই চুড়ি শুধুই সাজসজ্জা নয়, বরং তার সামাজিক অবস্থানের প্রতীক।
সামাজিক, রাজনীতিক এবং ধর্মীয় দিক থেকেও চুড়ির রয়েছে আলাদা অর্থ। তাই স্বদেশী আন্দোলনেও চুড়ি ছিল প্রতিবাদের ভাষা। তাই তো, অন্যতম চারণ কবি মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪) গেয়েছেন-
'আমার বঙ্গনারী
পরো না বিলেতী শাড়ী
ভেঙ্গে ফেলো বেলোয়ারী চুড়ি।'
কবির এই আহ্বানে মঞ্চে উঠে চুড়ি ভেঙ্গে ফেলার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল বঙ্গনারীরা- এমন ইতিহাসও আছে।
ভারতীয় উপমহাদেশে চুড়ি ঠিক কবে চালু হয়েছে, তার সঠিক তথ্য কারও কাছে নেই। তবে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকালে নানবিধ চুড়ির নিদর্শন পাওয়া গেছে। যা খোল, তামা, ব্রোঞ্জ, সোনা ও আকিক পাথরের তৈরি ছিল বলে জানায় ইন্টারন্টের সূত্রগুলো।
আবার, পাকিস্তানের মহেঞ্জোদারোতে (খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০ বছর) পাওয়া এক ব্রোঞ্জের মূর্তিতে দেখা যায়, নৃত্যরত এক বালিকার বাম হাতে চুরি রয়েছে। অন্যদিকে, মৌর্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ডিজাইনের চুড়ি পাওয়া গেছে ভারতের তক্ষশীলায়।
সুতরাং আজ আমরা যে চুড়ি দেখছি তার শুরুটা বহু আগেই। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, সারাবিশ্বব্যাপীই কমবেশি চুড়ির ব্যবহার রয়েছে বহু আগে থেকেই। তবে কেবল এ ভূখণ্ডেই চুড়িকে ধরা হয় নারীর পূর্ণতা এবং সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। বিশেষ করে, বিবাহিত বঙ্গনারীদের জন্য চুড়ি হলো তাদের স্বামীর দীর্ঘায়ুর প্রতীক। তাই এখনো কোনো বিবাহিত নারীকে হাতে চুড়ি না পরতে দেখলে, মুরুব্বিরা ধমকের সুরে বলে বসেন- 'হাত খালি কেন!'