'ভেঙে পড়েছি বারবার, অনেকবার...'
শাবনাজ সাদিয়া ইমি। ডাকনাম 'ইমি' হিসেবেই বেশি পরিচিত। ফ্যাশন মডেলিংয়ের সুপরিচিত মুখ। সিনিয়র মডেল এবং অভিনেত্রী।
ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রচুর র্যাম্পে ক্যাটওয়াক করে আলো ছড়িয়েছেন।
সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের ভালোলাগা, মন্দ লাগা, অর্জন ও অপমানবোধ নিয়ে তিনি কথা বলেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে।
আপনার বেড়ে ওঠা...
শাবনাজ সাদিয়া ইমি: ঢাকার এক মহল্লায়, নানুবাড়িতে বড় হয়েছি। ছোটবেলায় খুব চঞ্চল ছিলাম। একটু আউটগোয়িং টাইপের ছিলাম। খেলাধূলা করতে অনেক পছন্দ করতাম। ছেলেদের খেলাধূলাতে আমার আগ্রহ বেশি ছিল। মেয়েলিপনা আমার মধ্যে একেবারেই ছিল না। ন্যাকামি অ্যাকটিভি আমার এমনতিই পছন্দ নয়। আমি আমার মতোই থাকতাম। টম বয় ছিলাম।
ওই এলাকাতেই বাবা চাকরি করতেন। ওখানকার এক স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে ২০০০ সালে ভিকারুননিসা নূন কলেজে ভর্তি হই। ২০০২ সালে এইচএসসি পরীক্ষার পাশাপাশি 'ইউ গট দ্য লুক' প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। তারপর থেকেই ফ্যাশন মডেলিংয়ের কাজ শুরু।
অবশ্য প্রথম শো করেছি ২০০১ সালে, বিবি রাসেলের। তারপর কন্টিনিউ করা হয়নি। পরের বছর থেকে নিয়মিত কাজ করছি।
র্যাম্পমডেলিংয়ে প্রথম শুরু কী ভাবনা থেকে এবং কবে ও কীভাবে?
ইমি: মডেলিংয়ের পরিকল্পনা ছিল না। আমাদের বাসায় 'আনন্দলোক', 'আনন্দধারা', 'কিশোর তারকালোক', 'প্রেসক্রিপশন'... বিভিন্ন ম্যাগাজিন রাখা হতো। ওই ম্যাগাজিনগুলো কাগজওয়ালার কাছে বিক্রির সময় বিনিময়ে ইংরেজি ম্যাগাজিন 'কসমোপলিটন' নিতাম। ওই ম্যাগাজিনে ক্লাওদিয়া শিফার... এই মডেলদের ছবি দেখতাম। গ্লামারাস ছবি দেখতে খুব ভালো লাগত। 'ফ্যাশন টিভি' দেখতে খুব পছন্দ করতাম। ছোটবেলায় তো ইন্টারনেট ছিল না, ডিস অ্যান্টেনার সঙ্গে খুবই কানেক্টেড ছিলাম।
২০০১ সালে টেস্ট পরীক্ষার পর যখন এইচএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, একদিন ছোট খালামণি হঠাৎ বললেন, 'চলো, এক জায়গায় যাব, বিবি রাসেলের কাছে, দেখি তোমাকে পছন্দ করেন কি না, তুমি মডেল হতে পারবা কি না।'
আমাকে তিনি পছন্দ করলেন। এরপরের প্রথম শোতেই আমাকে ক্যাটওয়াক করালেন, ২০০১ সালে।
প্রথম ক্যাটওয়াকের স্মৃতি?
ইমি: তখন অডিয়েন্স, লাইট... এসব মাথায় নিইনি। ক্যাটওয়াক করছি- এটা নিয়েই রোমাঞ্চিত ছিলাম। মঞ্চের যে পরিবেশ, সেটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। যখন প্রথম শোতে হাঁটলাম, কাজটা এত পছন্দ হলো, মনে হলো, মডেল হওয়ার জন্যই বোধ হয় আমার জন্ম। ভবিষ্যৎ যা-ই হোক, আমি মডেলিংই করব।
প্রথম দিকের স্ট্রাগলগুলো কেমন ছিল?
ইমি: যখন ক্যাটওয়াক ছাড়াও অন্যকিছু, যেমন নাটক, মিউজিক ভিডিও বা টেলিভিশনের অন্যান্য কাজে অংশগ্রহণ করতাম, সবাই বলাবলি করত, 'ও ক্যাটওয়াক করে, ওটার তো কোনো ভবিষ্যৎ নাই। ওখান থেকে তো কেউ স্টাবলিশ হয়নি।' এমন আলাপ আমাকে খুব কষ্ট দিত। হতে পারে বাংলাদেশে এটা (র্যাম্প মডেলিং) নতুন এবং অত পরিচিত বা প্রতিষ্ঠিত না- যেখানে বাচ্চারা আসবে নিজেদের ভবিষ্যৎ ভেবে; কিন্তু জানতাম, এটা আমার 'এলাকা', হয়তো এখন কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না, আমাকে যদি দেখা যায়, একদিন এই জায়গাটারও ভবিষ্যৎ দেখা যাবে।
কোনো বিশেষ বাধা বা ঘটনার স্মৃতি মনে পড়ে? কীভাবে সামলিয়েছেন?
ইমি: পরিবার শেষ পর্যন্ত সাপোর্টই দেয়, কিন্তু ঝামেলা পাকায় সমাজ ও আত্মীয়-স্বজন! আমি যে সময় শুরু করেছি, যে সময় র্যাম্প মডেল হওয়ার মনস্থ করেছি, তখন কিন্তু এটা চিন্তার বাইরে ছিল। আমার বয়সী একটা মেয়ের স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে ওটাকে প্রফেশন বা প্যাশন হিসেবে নেওয়া, আমি এমন একটা জিনিস চাচ্ছি, যে জিনিসের ভবিষ্যৎ চোখে দেখা যায় না- এর চেয়ে বড় বাধা কিছুই হতে পারে না। যে এলাকা স্টাবলিশড না, আমি এমন একটা জায়গায় নিজে স্টাবলিশ হতে চাচ্ছি, জায়গাটাকেও স্টাবলিশ করতে চাচ্ছি- এটাই আমার জন্য বড় স্ট্রাগল তখনো ছিল, এখনো আছে।
আমি সেলিব্রেটি হতে পেরেছি, স্টারডম পেয়েছি, কিন্তু স্ট্রাগলগুলোর অনেকটুকুই এখনো শেষ হয়নি।
সমাজ ও আত্মীয়-স্বজনের বাড়তি কথাবার্তার জন্য যে সংঘাতগুলো তৈরি হতো, তার ফলে বাবা একটা দূরত্ব বজায় রাখতেন, আমার সঙ্গে কথা বলতেন না; পরিবারের অন্য সদস্যরাও মাঝে মধ্যে মন খারাপ করতেন- আসলেই কি এমন কোনো কাজ করছি, যেটা সাপোর্ট করার মতো না? সেই সময়গুলো সামলাতে গিয়ে অনেক সময় ভেঙে পড়েছি- বারবার, অনেকবার...। আমি এমন একটা জিনিস চাচ্ছি, যেটা মনে হয় চাওয়াটাই অপরাধ! কিন্তু সেই চাওয়া থেকে সেটাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া- এই স্ট্রাগল ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না!
তবে বাবার সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সন্তান হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে সেটাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। অবশ্য পরিবার যখন বুঝতে পারল আমার স্বপ্নটা কী, তখন কিন্তু তারা আমাকে কোনো ধরনের বাহবা বা সাপোর্ট দিতে এতটুকুও দ্বিধা করেনি।
মডেল হিসেবে কতগুলো শো করেছেন?
ইমি: ১৮-১৯ বছর তো হয়ে গেল র্যাম্পের ওপরই... টানা ১০-১২ বছর এমনও গেছে, বছরপ্রতি ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩০০ দিনই আমার শো থাকত। এটা তো গুনে বলা যাবে না। এটা তো আমার কুড়িয়ে সিন্দুকে জমা করা মুক্তোর মতো...।
র্যাম্পে সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি?
ইমি: আমার বেস্ট পারফরম্যান্স 'বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০১৯-২০'-এ। ২০১১ সালে 'ঢাকা ফ্যাশন উইক' থেকে যখন 'মডেল অব দ্য ডিকেড' অ্যাওয়ার্ড পাই, সেই স্মৃতি আমার কাছে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। ওই বছরটি আমার জন্য সবচেয়ে প্রাপ্তির বছর। ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে 'মডেল স্টার বাংলাদেশ' অ্যাওয়ার্ড নিয়ে আসাটাও সুখের স্মৃতি।
সবচেয়ে বেদনার স্মৃতি?
ইমি: দুয়েকবার হয়তো মঞ্চে উল্টে-পাল্টে পড়ে গেছি, তবে সেগুলো আমার কাছে বেদনার স্মৃতি না। কাউকে পড়ে যেতে দেখলে যেমন হাসতাম, নিজে পড়ে গেলেও হেসেছি। নিজে কোনো ব্ল্যান্ডার করলেও হেসেছি। তবে কয়েক বছর ধরে নিয়মিত হয়, এমন এক ফ্যাশন শোতে আমাকে একভাবে অবজ্ঞা করা হয়েছে। পুরস্কার বিতরণীতে আমার পুরস্কারটা আরেকজনকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা আমার জন্য বেদনার স্মৃতি নয় ঠিক; বরং র্যাম্প ক্যারিয়ারে একটা অপমানের স্মৃতি হয়ে রয়েছে।
মডেল হিসেবে আপনার কোনো আইডল আছে? যদি থাকে, কে বা কারা এবং কেন?
ইমি: টেলিভিশনে যখন সাদিয়া ইসলাম মৌকে দেখতাম, তখন তাকে আইডিয়ালাইজ করতাম; যখন ছবিতে, প্রিন্ট ক্যাম্পেইন ও ফটোশুটে কৌশিকী নাসের তুপাকে দেখতাম, তখন তাকে দেখে ফ্যান্টাসাইজ করতাম, আমিও একদিন তার মতো স্মার্ট হব। বিবি রাসেল তো আমাদের জীবন্ত কিংবদন্তি। আমি যে ওনার হাত ধরে র্যাম্পে হাঁটার সুযোগ হয়েছে, এ ক্ষেত্রে আমার চেয়ে ভাগ্যবতী বোধ হয় কেউ হতে পারে না।
মডেলিংয়ের বাইরে আর যা কিছু করেন...
ইমি: গান শুনি, মুভি দেখি। অবসরে মোটর সাইকেল চালাই। ছবি তুলতে, নিজের ছবি ও ভিডিও এডিট করতে পছন্দ করি। মিউজিক নিয়ে অ্যানালাইসিস করি। মেকআপ, প্লাসিক সার্জারির ভিডিও দেখি। অনেক দেশের টকশো দেখি। দুনিয়াটাকে আরও জানার চেষ্টা করি। জানার আগ্রহই আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। জানার এই আগ্রহ নিয়েই বোধ হয় মানুষ বেঁচে থাকে।
করোনা পরবর্তী র্যাম্প মডেলিং ইন্ডাস্ট্রি কীভাবে ঘুরে দাড়াতে পারবে বলে মনে করেন?
ইমি: যারা বেঁচে থাকব আমরা, ঘুরে তো সবাইকেই দাঁড়াতে হবে। সব ইন্ডাস্ট্রিই, যার যার কাজের ক্ষেত্র সবার কাছেই একই রকম সমান। সবার জন্যই একই ধরনের হৃদয়বিদারক অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, একদিনই হয়তো ঘুরে দাঁড়াব। হয়তো হঠাৎ করেই একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি খুবই ইতিবাচক মানুষ।
এক কথায় জীবনকে কীভাবে দেখেন?
ইমি: জীবনকে অনেক সহজভাবে দেখি। খাওয়া-দাওয়া, প্রার্থনা, ঘুম, বাসার মানুষের প্রতি দায়-দায়িত্ব, সবার প্রতি ভালোবাসা, নিজের কাজগুলো গোছানো, নিজেকে সুস্থ রাখা, নিজের দেহ-মন-মস্তিষ্কের খেয়াল রাখা। নিজেকে মানুষ হিসেবে আরও কতটা প্রশিক্ষিত করা যায়, নিজের মধ্যে আরও কতটুকু মানবিকবোধ তৈরি করা যায়, সেই তৈরি হওয়ার জার্নিটাই জীবন।