দীর্ঘদিন যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে সৈন্যরা ক্লান্ত, নতুন সৈনিকের অভাবে বিপর্যস্ত ইউক্রেন
ইউরোপের বসন্তের এক বিকেলে ইউক্রেনের একটি যুদ্ধক্ষেত্র, দেখা যায় পাতার আচ্ছাদনের নিচে একটি আর্টিলারি ইউনিট অপেক্ষা করছে। তাদের কাজ মাঝে মাঝে নিজেদের ৫০ বছরের পুরোনো লঞ্চার থেকে রকেট নিক্ষেপ করা। তবে পাহাড়ের ঢালে নতুন বাঙ্কার খুঁড়তে খুঁড়তেই তাদের বেশির ভাগ সময় কাটে। খবর বিবিসিরি
তারা পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্ক অঞ্চলের ৫ কিলোমিটার (৩ মাইল) দূরের এই স্থানে বসে ক্রমে অগ্রসর রুশ বাহিনীকে ঠেকানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও তাদের লোকবল ও অস্ত্র দুইয়েরই মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে।
আশা করা হচ্ছে, আমেরিকার দেওয়া গোলাবারুদে কিছুটা সহায়তা হবে। তবে নতুন সৈন্য নিয়োগ নিয়ে ইউক্রেনীয় সরকার যা করছে, তা নিয়ে জোর বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
এপ্রিলের শুরুতে পাস হওয়া একটি নতুন মবিলাইজেশন বিলে, সৈন্যদের সেবাদানের সময়সীমা অন্তর্ভুক্ত না করায় ব্যাপক সমালোচনার জন্ম হয়েছে। কারণ সেনাবাহিনীর অনুরোধে এই বিলে তিন বছর পর সৈন্যদের অবসরে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত একটি ধারা বাতিল করা হয়েছে।
যুদ্ধ-ক্লান্ত সৈন্যরা বিবিসিকে বলেছে, সামরিক বাহিনী কীভাবে নতুনদের নিয়োগ করবে, বিষয়টি তাদের 'পুনর্বিবেচনা' করা উচিত।
পুরনোদের জায়গায় নতুন সৈন্য নিয়োগ দিতে সৈন্যদের বয়সসীমা আরও কমিয়েছে সেনাবাহিনী। তবে তাতেও কাজ হচ্ছে না। বয়স কমিয়ে শুধু সৈন্য আনলেই তো চলবে না, যুদ্ধক্ষেত্রে আনতে গেলে তো ন্যূনতম প্রশিক্ষণ লাগবে।
যেমনটা বলছিলেন ২১ তম মেকানাইজড ব্রিগেডের রেডিও অপারেটর ওলেক্সান্ডার।
তিনি জানান, তার মতো হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সৈন্য পর্যাপ্ত বিশ্রাম ছাড়াই দুই বছরের বেশি সময় ধরে লড়াই করছে।
তিনি বলেন, 'আমরা যদি বাড়িতে যাই, তবে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে অনভিজ্ঞ বহু নতুন সৈন্যের মৃত্যু হবে।'
অন্যদিকে তাদের কমান্ডার গর্বের সঙ্গে বলেন, 'আমাদের সৈন্যরা দীর্ঘদিন লড়াই করার কারণে পেশাদার হয়ে উঠেছে।'
তিনি ক্যামোফ্লেজ নেটের নিচে তাদের মোবাইল রকেট লঞ্চারের দিকে ইঙ্গিত করেন।
তিনি বলেন, 'ওরা জানে একেকটা রকেট একেকজন নারীর মতো। নিজস্ব খেয়ালখুশি ও বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে এগুলোর প্রত্যেকটিই স্বতন্ত্র।'
বলা চলে তাদের সামনে থাকা ১৯৭০-এর দশকের ট্রাকটি, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর বর্তমান অবস্থার প্রতীক।
পুরানো ধাঁচের, তবে এর মধ্যে জিপিএস গাইডিং সিস্টেমের মতো কিছু আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। তবে এতে মূল জিনিসই নেই, তা হলো রকেট।
যদিও রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কাছেও যে যুদ্ধের সব অস্ত্র বা যন্ত্রপাতি আধুনিক তা নয়। তবে তারা পূর্ব ফ্রন্ট লাইনের একাধিক অংশে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে পরাজিত করে ক্রমে ভেতরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এই কারণেই আমরা দেখছি, সীমান্তের ৩০ কিলোমিটার (১৯ মাইল) পিছনে ইউক্রেনের নতুন পরিখাগুলো খনন করা হচ্ছে।
নিঃসন্দেহে রুশ বাহিনী কৌশলগতভাবে এগিয়ে আছে এবং ইউক্রেনের আকাশসীমায় মোটামুটি দাপিয়েই বেড়াচ্ছে।
এছাড়া, মস্কো অস্ত্র উৎপাদনও ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে এবং ইউক্রেনের চেয়ে দ্রুত গতিতে সৈন্য নিয়োগ দিচ্ছে।
ওই সৈন্য বলেন, আমাদের জঙ্গলাকীর্ণ পরিখায় রাখাটা ইউক্রেনীয় সরকারের একটি সিদ্ধান্তকে প্রতিফলিত করছে। তা হলো 'যতদিন লাগে, আমরা ততদিনই লড়াই করব'।
যদিও আমরা যেসব সৈন্যের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেননি।
তবে কমব্যাট মেডিক ইলিয়া মনে করেন, সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার মানে কী তা নিয়ে সামরিক বাহিনী অসৎ।
তার মতে, নিয়োগকারীরা যদি নতুন সৈন্যদের জানায় প্রথম ছয় মাস হয়ত তাদের জন্য 'অত্যন্ত কঠিন'হবে। তবে এ সময়ে তাদের যুদ্ধের জন্য ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। তাহলে হয়ত আরও অনেক তরুণ সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে।
তিনি বলেন, 'সামরিক বাহিনীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ করে পদাতিক বাহিনী।'
ইলিয়ার মতে, একটি পরিখায় বসে ক্লান্ত ও ক্ষুব্ধ সৈনিক হিসেবে লড়াই করার বিষয়টি তরুণদের কাছে মোটেও আকর্ষণীয় নয়।
তিনি আরও মনে করেন, যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা সম্পর্কে স্বচ্ছতার অভাবেও, তরুণেরা যুদ্ধে যোগ দিচ্ছে না।
'যদি এই যুদ্ধ ১০ বছর স্থায়ী হয়?'
কিয়েভের স্থানীয় এমপি ইনা সোভসুন ব্যাখ্যা করেন, কেন তিনি মবিলাইজেশন বিলে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন। তার সঙ্গী যুদ্ধক্ষেত্রে একজন ফ্রন্টলাইন ডাক্তার হিসেবে কাজ করেন।
তিনি বলেন, 'তিনি কোথায় আছেন সেই চিন্তায় আমার অসংখ্য রাত নির্ঘুম কাটে। আমি একা না, আমার মতো লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয়দের অবস্থা একই।'
মিসেস সোভসুন মনে করেন, পালাক্রমে সৈন্য বদল করার উপর আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ইউক্রেনের ৫ লাখ বা তার বেশি সৈন্য বর্তমানে যুদ্ধ করছে, তাদের কিছুদিন বিশ্রাম দেওয়ার জন্য যুদ্ধের উপযোগী বয়সের যথেষ্ট পুরুষ আমাদের দেশে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'হ্যাঁ, কিছু উচ্চ প্রশিক্ষিত সৈন্য রয়েছে, যাদের হয়ত বিকল্প হয়না। কিন্তু পরিখায় থাকা সৈন্যদের পালাক্রমে বিরতি দিতে কী সমস্যা?'
তিনি প্রশ্ন করেন, 'এই যুদ্ধ যদি ১০ বছর স্থায়ী হয় (তাহলেও কি তারা একটানা ১০ বছর কোনো বিশ্রাম পাবেন না)?'
ওই এমপি বলেন, 'যারা প্রথম দিন থেকে সেবা দেওয়া শুরু করেছে, তাদের ওপর সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে নির্ভার হয়ে থাকার ভান করতে পারি না আমরা।'
সেনাবাহিনীতে দুর্নীতির অভিযোগ এবং স্বেচ্ছাসেবক হ্রাসের কারণে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
বর্তমানে দেশটির মন্ত্রীরা দুটি মূল উদ্দেশ্যে বাস্তবায়নে মরিয়া। এগুলো হলো: তরুণদের ওপর যুদ্ধে যাওয়ার চাপ বাড়ানো এবং সিস্টেমের উপর আস্থা পুনরুদ্ধার করা।
কারণ এ দুটি বিষয়ই যুদ্ধকালীন ইউক্রেনকে আরও কঠিন বিপাকে ফেলেছে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি