আগামী অর্থবছরের এডিপিতে পরিবহন-জ্বালানির চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাতে
আসন্ন ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে সরকার। পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, আবাসন এবং কমিউনিটি সুবিধাবলির মতো আগে অগ্রাধিকার পাওয়া খাতে বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমানো হয়েছে।
এছাড়া প্রস্তাবিত এডিপিতে সরকারি তহবিলে বরাদ্দ কমেছে এবং বৈদেশিক ঋণের অংশ বেড়েছে।
মঙ্গলবার (৭ মে) পরিকল্পনা কমিশনের এক সভায় ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপির আকার ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিপিতে বৈদেশিক অর্থায়নের অনুপাত বাড়লে এবং অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন কমলে দেশের মোট সুদব্যয় বাড়বে না।
'কারণ আমরা যে বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছি সেগুলো অনেক সস্তা। অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন অনেক ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে,' বলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকার সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
প্রস্তাবিত এডিপিতে সরকারি তহবিল থেকে বরাদ্দ ধরা হয়েছে মোট বরাদ্দের ৬২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বৈদেশিক অর্থায়ন ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এটি চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরের এডিপির যথাক্রমে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ৩৫ দশমিক ৭ শতাংশের বিপরীত।
জাহিদ হোসেন বলেন, 'বিদেশি অর্থায়ন প্রকল্পের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বৈদেশিক ঋণের অংশ বাড়ানো প্রয়োজন। এতে অভ্যন্তরীণ অর্থায়নের ওপর চাপ কমবে।'
'তবে সংশোধিত এডিপিতে দেখা যাবে বিদেশি অর্থায়নের অংশ কমে যাবে আর দেশীয় অর্থায়ন বাড়বে। এটি হলো এদেশে প্রবণতা,' তিনি যোগ করেন।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'আমরা প্রতি অর্থবছরে একটি পরিকল্পিত এডিপি দেখি। তবে প্রস্তাবিত এডিপি এবং বাস্তবায়িত এডিপির মধ্যে একটি বড় ব্যবধান রয়ে যায়।'
শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে কমে যাওয়া প্রসঙ্গে জাহিদ হুসেন বলেন, পরিবহন, জ্বালানি খাতে কিছু বরাদ্দ কমিয়ে এডিপি কমানো যাবে না। কিন্তু পরিবহন ও জ্বালানিসহ যেসব খাতে অনেক বড় প্রকল্প রয়েছে সেসব খাতে ছাঁটাই বেশি প্রয়োজন ছিল।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বা শিক্ষা খাতে কোনো ছাঁটাইয়ের প্রয়োজন নেই। এসব খাতের প্রকল্পগুলো অগ্রাধিকারভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে।
জাহিদ হোসেন বলেন, রাজনৈতিক কারণে স্থানীয় পর্যায়ে কাউকে তুষ্ট রাখার কোনো বিষয় নেই। ফলে সরকারের এখন সময় অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
প্রস্তাবিত এডিপিতে সরকারি তহবিলের বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় চার হাজার কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ কমেছে। তবে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির সঙ্গে তুলনায় সরকারি তহবিলের বরাদ্দ বেড়েছে ২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
এদিকে, প্রস্তাবিত এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার পরিমাণ চলতি অর্থবছরের এডিপি এবং সংশোধিত এডিপির তুলনায় যথাক্রমে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ও ১৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেড়েছে।
প্রস্তাবিত এডিপিতে সরকারি তহবিল থেকে এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক সহায়তা থেকে এক লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় প্রস্তাবিত এডিপির প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তবে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবিত এডিপি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় উপস্থাপন করা হবে। চলতি মাসে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
পরিকল্পনা কমিশনসূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরের সরকারি তহবিল থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর চাহিদা ছিল এক লাখ ৮৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের চাহিদা ছিল ৯১ হাজার ১১ কোটি টাকা।
তবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বর্তমানে রাজস্ব আহরণ, মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলার সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সরকারি তহবিলের তুলনায় বৈদেশিক অর্থায়নের ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
২০২৩–২৪ অর্থবছরের এডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ ছিল ৭৫ হাজার ৯৪৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপিতে তা কমিয়ে ৭০ হাজার ৬৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা করা হয়েছে। একইভাবে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে এডিপিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ ছিল ৪৪ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা, যা প্রস্তাবিত এডিপিতে ৪০ হাজার ৭৫১ কোটি ৮৬ লাখ টাকায় কমিয়ে আনা হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের এডিপির তুলনায় ২০২৪–২৫ অর্থবছরে প্রস্তাবিত এডিপিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, জলবায়ু এবং শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি পেয়েছে।
যেমন প্রস্তাবিত এডিপিতে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি ছয় লাখ টাকা, যেখানে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে এর পরিমাণ ২৯ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। একইভাবে, স্বাস্থ্য খাতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত এডিপিতে চার হাজার ৪৭৮ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া খাত
প্রস্তাবিত এডিপিতে পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে সর্বাধিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের প্রায় ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বা ৭০ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। মেট্রোরেল এমআরটি লাইন-৫ এবং পদ্মা রেল সংযোগের মতো প্রকল্পের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প এবং মাতারবাড়ি ১,২০০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা বা ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা খাত তৃতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ পেয়েছে ৩১ হাজার ৫২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা বা ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ। আবাসন ও কমিউনিটি সুবিধাবলি খাতে প্রায় ২৪ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা মোট প্রস্তাবিত এডিপি বরাদ্দের ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।
এর পরে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন খাত প্রস্তাবিত এডিপি বরাদ্দের ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ, কৃষি খাত ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং পরিবেশ ও জলবায়ু খাত ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ পেয়েছে। শিল্প ও অর্থনৈতিক সেবা পেয়েছে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং তথ্য প্রযুক্তি খাত পেয়েছে ১ দশমিক ৮১ শতাংশ।
সর্বোচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত প্রকল্প
প্রস্তাবিত এডিপিতে শিক্ষা খাতের অধীনে চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) জন্য সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ ১০ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য তৃতীয় সর্বোচ্চ ছয় হাজার পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অবকাঠামো খাতে ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে এবং এমআরটি লাইন-১ প্রকল্পের জন্য যথাক্রমে তিন হাজার ৭৯৬ কোটি ৮৮ লাখ টাকা এবং তিন হাজার ৫৯৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া পিজিসিবি'র অধীনে পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক স্ট্রেংদেনিং প্রকল্পে তিন হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে তিন হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা, শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পে তিন হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা এবং ডিপিডিসি'র অধীনে এক্সপানশন অ্যান্ড স্ট্রেংদেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক প্রকল্পে তিন হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে একটি প্রকল্পের জন্য তিন হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি হলো এস্টাবলিশমেন্ট অব ৫০০-বেড হসপিটালস ইন যশোর, কক্সেস বাজার, পাবনা, অ্যান্ড মালেক মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড নুরুল হক হসপিটাল, নোয়াখালী।
সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রস্তাবিত এডিপির ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বরাদ্দ করার কথা ছিল। তবে এ খাতে গত কয়েক বছরে গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত এডিপির ২৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সাধারণ সরকারি সেবা খাতে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল, যেখানে বরাদ্দ করা হয়েছে শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল ১১ দশমিক ১ শতাংশ, যেখানে প্রস্তাবিত এডিপিতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ।
প্রকল্প-ভারী কর্মসূচি
প্রস্তাবিত এডিপিতে মোট এক হাজার ২৫৮টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ৭৯টি নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্প রয়েছে।
প্রস্তাবিত এডিপিতে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার অর্থায়নে ৭৯ প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ১১ হাজার ৬৯৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা যোগ করলে এডিপির আকার দাঁড়ায় এক লাখ ৭৬ হাজার ৯৬৯ বোটি ২৪ লাখ টাকা।
'এটি একটি প্রকল্প-ভারী কর্মসূচি। এডিপিতে প্রকল্পের সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ে। এতে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়ে। এটি আমাদের মৌলিক সমস্যা যার সমাধান হয় না,' বলেন অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।