‘প্রশংসনীয় উদ্যোগ’: চিনিযুক্ত খাদ্য ও পানীয়ের ওপর কর বাড়ানোর পরিকল্পনা এনবিআরের
২০২৪-২৫ অর্থবছরের আসন্ন বাজেটে চিনিযুক্ত খাদ্য ও পানীয় পণ্যের ওপর কর বাড়ানোর কথা ভাবছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় এটি একটি সঠিক পদক্ষেপ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এনবিআরের নীতি প্রণয়নের সাথে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে বলেন, বর্তমানে কার্বোনেটেড বেভারেজ প্রস্তুতকারকদের বার্ষিক বিক্রির ওপর ন্যূনতম ৩ শতাংশ হারে কর দিতে হয়, নতুন অর্থবছরের বাজেটে এই করহার বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে।
একইভাবে আইসক্রিম, জুস, জেলি, বিস্কুট ও কেকের মতো অন্যান্য চিনিযুক্ত পণ্যের ওপর বিদ্যমান শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ করহারও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
চিনিযুক্ত কিছু পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ইঙ্গিতও দেন ওই কর্মকর্তা।
"প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করতে মঙ্গলবার (১৪ মে) আমরা প্রধানমন্ত্রীর সাথে বসব" যোগ করেন তিনি।
শিল্প-সংশ্লিষ্টরা এ পদক্ষেপের বিরোধিতা করলেও – জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, কর বাড়ানোর ফলে এসব পণ্যের দাম বাড়বে, তাতে করে চিনিযুক্ত পণ্যগুলো ভোগচাহিদা কমবে, কমবে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ টিবিএসকে বলেন, "সুগার-সুইটেনেড বেভারেজের ভোগ কমাতে সরকার যদি কর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় – তাহলে এটি খুবই ভালো পদক্ষেপ হবে। এসব পণ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। চিনি ও লবণকে বলা হয় সাদা বিষ, তাই যেকোনো উপায়ে এগুলোর খাওয়া নিরুৎসাহিত করা উচিত ।"
বেনজীর ব্যাখ্যা করে বলেন, "বিপাকীয় সমস্যা এবং হাইপারলিপিডেমিয়ার জন্য বেশিরভাগ সময়েই দায়ী সুগার-ইনডিউসড আইটেম। এগুলো সরাসরি মানবদেহে চিনির মাত্রা বাড়ায়, তখন ইনসুলিন এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।" এর বদলে বাজারে বিভিন্ন ধরনের মানবদেহের জন্য উপকারী ও পুষ্টিকর ফলমূলের সরবরাহ বাড়াতে সরকারের উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর 'আন্ডারওয়েট, ওভারওয়েট অর ওবেসিটি, ডায়াবেটিস অ্যান্ড হাইপারটেনশন ইন বাংলাদেশ ২০০৪ টু ২০১৮' গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তনের কারণে গত ১৪ বছরে মহিলাদের মধ্যে স্থূলতার প্রাদুর্ভাব প্রায় তিনগুণ বেড়েছে এবং পুরুষদের মধ্যে তা দেড়গুণ বেড়েছে।
একই গবেষণা বলছে, ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নারী ও পুরুষদের মধ্যে ডায়াবেটিস ১১ থেকে ১৪ শতাংশ হারে বেড়েছে।
জনস্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. রুমানা আহমেদ বলেন, 'চিনিযুক্ত পানীয়ে এনবিআর কর বাড়ালে তা হবে প্রশংসনীয় একটি পদক্ষেপ। এতে দুটি উদ্দেশ্য পূরণ হবে: সরকারের রাজস্ব বাড়বে, এবং জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।"
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে কার্বোনেটেড বেভারেজের উৎপাদক পর্যায়ে ন্যূনতম কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করেছিল সরকার। তবে সংশ্লিষ্ট শিল্পের তদবিরের কারণে পরে তা কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়।
তবে আইসক্রিম, জুস, জেলি, বিস্কুট, চকলেট ও কেকের মতো অন্যান্য চিনিযুক্ত পণ্যে বর্তমানে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ ন্যূনতম কর হার রয়েছে।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা জানান, "এখন আমরা সব ধরনের চিনিযুক্ত পণ্য উৎপাদকদের ন্যূনতম করের হার ৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা করেছি।"
"এই খাতে খুবই সামান্য রাজস্ব প্রবৃদ্ধির অনুমান করছি, কমার সম্ভাবনাও আছে। এই খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানো আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য নয়, বরং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনায় চিনিযুক্ত পণ্যের ভোগ কমানোই হলো মূল উদ্দেশ্য" তিনি বলছিলেন।
২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকার এই খাত থেকে ১ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর হার বাড়ানোর পরে বিক্রি কমে যায়। এতে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ সময়ে রাজস্ব আদায় কমে ৩০ শতাংশ।
প্রস্তাবনার বিরোধী ব্যবসায়ীরা
সংশ্লিষ্ট শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, কর বাড়ানো হলে এ খাতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যার ফলে বিনিয়োগও কমতে পারে।
বাংলাদেশ বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, "কর বাড়লে – পণ্যের দামও তখন বাড়াতে হবে। এতে চাহিদায় মন্দা দেখা দিতে পারে। তবে সরকারের প্রস্তাবিত (কর) সমন্বয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হতে আমাদের বাজেট ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।"
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম গত ৯ মে বিদ্যমান কর হার কমানোর অনুরোধ করে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাহমাতুল মুনিমকে একটি চিঠি দিয়েছেন।
চিঠিতে এফবিসিসিআই) সভাপতি অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে একটি টেকসই কর কাঠামো বাস্তবায়নের তাগিদ দেন।
বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে কার্বোনেটেড পানীয় খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে মোট বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হার হচ্ছে ২০ শতাংশ।
শুধু কর বাড়িয়েই কী ভোগ কমানো যাবে?
বেভারেজ ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, সব রকমের আমদানি কর, মূল্য সংযোজন কর ও অন্যান্য কর মিলিয়ে বর্তমানে কার্বোনেটেড পানীয়ে করভার ৪৮ শতাংশের বেশি।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড) এর মতে, প্রতিবেশী ভারতে পানীয় পণ্যে করহার ৪০ শতাংশ, স্রিলঙ্কায় ২৯ শতাংশ, নেপালে ৩৯ শতাংশ এবং ভুটানে ৩০ শতাংশ।
এই বাস্তবতায় চিনিযুক্ত পানীয়ে কর বাড়ানোর উদ্যোগকে সমর্থন করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কর বাড়িয়ে ভোক্তাদের মধ্যে এসব পানীয়ের চাহিদা কমানো যাবে না।
অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ, যিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেরও সাবেক পরিচালক বলেন, 'চিনিযুক্ত পানীয়ের ভোগ কমাতে স্বাস্থ্য বিভাগের নেতৃত্বে বড় পরিসরে জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে, বিশেষত শিশুদের মধ্যে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস প্রচারের জন্য সরকারকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হবে।"
তামাক পণ্যের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, "আমরা দেখেছি কর বাড়িয়ে ক্ষতিকর এসব পণ্যের ব্যবহার কমানো যায়নি। তাই চিনিযুক্ত খাদ্য ও পানীয়ে কর বাড়ানোর পাশাপাশি আমাদের স্থানীয় ফল উৎপাদকদের প্রণোদনা দিতে হবে।"
অধ্যাপক রুমানা আহম্যাড বলেন, "কর একটি ব্যয়-সাশ্রয়ী পন্থা হলেও, এক্ষেত্রে গণ-প্রচারণা কর্মসূচি, বা স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর নানান প্রচেষ্টা, এসব পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্যাকেজিং নিয়ন্ত্রণের যথাযথ নীতিমালা দরকার।"