আমেরিকায় বাঙালি শিপজাম্পার
ভাবুন আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে এই সহজ সরল মাছে-ভাতে বাঙালিরা যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখন তাদের বিবাহিত জীবন কেমন ছিল? যখন জীবন ছিল ঘন কুয়াশায় বন্দি, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা, সেই সঙ্গে বর্ণবাদ, শ্রেণিবৈষম্য তো ছিলই, এই কঠিন পরিস্থিতিতে ওই দেশে কীভাবে বাঙালিরা বিয়ের মত কঠিন কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন?
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় আমেরিকায় যারা উপকুলে লাফিয়ে নেমেছিলেন জাহাজ থেকে, যাদের নাম হয়ে গিয়েছিল শিপ জাম্পার- এই বাঙালি শিপ জাম্পারদের অধিকাংশের বয়স ছিল ২০ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। খুব স্বাভাবিকভাবেই কুড়ি বছরের যুবক আমেরিকার মাটিতে পা দেওয়ার পর, তার সামনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কাজ জরুরি হয়ে উঠতো: প্রথম কাজটি ছিল যেন তেন ভাবে একটি 'চাকুরী' জুটিয়ে নেওয়া। আর দ্বিতীয় কাজটি হল দেশটিতে কীভাবে বৈধভাবে থাকা যায়, চিরস্থায়ী হওয়া যায় সেটা নিশ্চিত করা। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ এবং আইনসম্মত উপায় ছিল বিয়ে করা। কোনো আমেরিকান নাগরিককে বিয়ে করলেই বৈধ হওয়ার পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা হত।
পুয়র্তেরিকো যেহেতু আমেরিকার আওতায় একটি দ্বীপ তখন, এবং আমেরিকায় বসবাস করার সব রকম সুযোগ সুবিধা তারা পায়, তাই জাহাজ পলাতক বা শিপ জাম্পার বাঙালিরা পুয়র্তেরিকান নারীদের বিয়ে করাটাই সবচেয়ে যুক্তি সম্মত মনে করতো। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল আমেরিকায় ওই সময়ে, বিশেষ করে স্প্যানিশ এবং আফ্রিকান সমাজে 'জামাই' হিসেবে বাঙালির কদর ভালোই ছিল। বাঙালিরা তখনই সৎ, কর্মঠ, এবং সামাজিক হিসেবে পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছিল। ফলে এই শিপজাম্পার বাঙালিদের মেলামেশার পরিধিও বেড়েছিল, তারা আফ্রিকান আমেরিকান, স্প্যানিশ, এবং কেউ কেউ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে আসা মেয়েদের বিয়ে করে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছিল।
১৯২৭ সালের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত 'দি আমস্টার্ডাম নিউজ' এর জুন মাসের একটি সংখ্যায় একটা খবরের উদাহরণ দেওয়া যায়। ওই পত্রিকার বিনোদন পাতায় পূর্ব বাংলা থেকে আসা হারলেমে বসবাসরত সৈয়দ আলী মিয়ার সাথে আফ্রিকান আমেরিকান স্ত্রী মার্গারেট রিচার্ডসনের বিয়ের একটি খবর বেশ ঘটা করে ছাপা হয়েছিল। কি লেখা হয়েছিল ওই প্রতিবেদনে:
'গত শুক্রবার সৈয়দ আলী মিয়ার অনেক বন্ধু-বান্ধব এই নব দম্পত্তিকে শুভেচ্ছা জানাতে তাদের হারলেমের ২৬০, ওয়েস্ট ১২৫ স্ট্রিটের বাড়িতে জড়ো হয়েছিল। উল্লেখ্য যে মিস্টার মিয়া স্থানীয় মেথোডিস্ট চার্চে ৫ এপ্রিল পাদ্রী রেভ. চার্লস এফ. ডিভাইনের সহযোগিতায় আফ্র্রিকান- আমেরিকান মার্গারেট রিচার্ডসনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। মার্গারেট রিচার্ডসনের বাবা হারপার রিচার্ডসন, তার বাড়ি ৪০১, ১৪৯ ওয়েস্ট স্ট্রিটে। তার চাচা চার্লি এন্ডারসন একজন প্রখ্যাত ড্যান্সার এবং নাচের শিক্ষক। তিনি ২৩২৩ সেভেন্থ এভিনিউর বাসিন্দা। উল্লেখ্য যে মিস্টার মিয়া ভারতের বেঙ্গল প্রদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন...'
তবে এটাই বাঙালি শিপজাম্পারদের একমাত্র বিয়ের খবর নয়।
পত্রিকার সংবাদে শিপ জাম্পারদের বিয়ের খবর
বিয়ে হবে আর আনন্দ-হৈচৈ হবে না? তা তো নয়। তবে স্পষ্টতই, শিপ জাম্পারদের বিয়ে-শাদি খুব জৌলুসে হয়েছিল তাও মনে করা সঙ্গত হবে না। বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে উত্তর আমেরিকায় বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে ভিনদেশি ভাষা এবং সংস্কৃতির পাত্রিদের বিয়ের চল শুরু হয়। ধীরে ধীরে এ খবর স্থানীয় পত্র-পত্রিকার পাতায়ও জায়গা করে নিতে শুরু করে।
১৯২০ সালের দিকে নিউইয়র্কের হারলেমে পূর্ববাংলা থেকে আগত অনেক বাঙালির সঙ্গে পুয়র্তেরিকান এবং আফ্রিকান আমেরিকান মেয়েদের বিয়ের ধুম পড়ে যায়। দি নিউইয়র্ক আমস্টার্ডাম নিউজের পাতায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালের জুন মাসে একই পত্রিকা নিউইয়র্ক আমস্টার্ডাম নিউজে, দেখা যাচ্ছে মোকসেদ আলি এবং আবদুল করিমের বিয়ের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তারাও পূর্ববঙ্গেরই। পত্রিকাটি জানাচ্ছে-
'২৯৭১ ওয়েস্ট, ৩৬ স্ট্রিটের পাত্র মকসুদ আলির সঙ্গে, ৩৬ ওয়েস্ট, ১২৮ স্ট্রিটের কনে মিস মাবেল লিয়োলা গিবসনের বিয়ে। একইসঙ্গে আরেক বর ৩২২ ওয়েস্ট, ১৪১ স্ট্রিটের আবদুল করিম, তার সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন হল ২৪২ ওয়েস্ট, ১৪৬ স্ট্রিটের মিস মিলড্রেড হেসের..."
১৯৩২ সালেও ঠিক একই রকম একটি সংবাদ দেখা যায়। সংবাদ শিরোনাম ছিল ইস্ট ইন্ডিয়ানদের বিয়েশাদি। দি আমস্টার্ডাম নিউজ লিখছে-
'নাসির মিয়া, বয়স ২৭। বিয়ের সনদে উল্লেখ করেছে তার জন্ম হয়েছে বোম্বে, ভারতে এবং তিনি সদ্য বিয়ে করেছেন মিস লিলিয়ান পন্ডস নামের একজন স্থানীয় নারীকে। তার ঠিকানা ১৯২৬ সেকেন্ড এভিনিউ। মিয়ার ঠিকানা ৩০১ ওয়েস্ট, ১০২ স্ট্রিট।(বেঙলি হারলেম, বিবেক বাল্ড)।
১৯৩৫ সালে আমস্টার্ডাম পত্রিকায় বাঙালির আরেকটি খবর বেশ গুরূত্ব দিয়ে প্রকাশ পায়। এই সংবাদে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মার্কিন মুলুকে শিপ জাম্পারদের বিয়েশাদি ব্যাপারটি নিউইয়র্কের সমাজে ভালো মতোই গেঁথে গেছে।
১৯৩৫ সালে আমস্টার্ডাম নিউজ শুধুমাত্র পাত্র-পাত্রির বিয়ের খবর দিয়েই বসে থাকেনি। সেই সাথে জুড়ে দিয়েছে বিয়ে বাড়ির অন্দরমহলের খবরও। সেখানে বিয়েতে কি কি ঘটনা ঘটেছিল, কীভাবে বিয়ে বাড়ি সাজানো হয়েছিল, কারা কারা বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন ইত্যাদি সবিস্তারে লেখা হয়েছে। সেই প্রতিবেদন-
'গত শুক্রবার সাইয়েদালি মিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন হল। মিয়ার ২৬০ ওয়েস্ট, ১২৫ স্ট্রিটের বাড়িতে। তার অনেক বন্ধুরা জমায়েত হয়েছিল। এপ্রিলের ৫ তারিখ মিয়ার বিয়ে পড়ানো হয় ১৮ স্ট্রিটের মেথোডিস্ট চার্চে। রেভ. চার্লস এফ. ডিভাইন বিয়ে সম্পাদন করেন। মিসেস মিয়া, যিনি আগে মিস মার্গেরিতা রিচার্ডসন নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি হারপার রিচার্ডসনের কন্যা। তাদের বাড়ি ৪০১ ওয়েস্ট, ১৪৯ স্ট্রিট। জানা যায় তার চাচা চার্লি এন্ডারসন একজন বিখ্যাত নাচের শিক্ষক। নাচ শেখানোর জন্যে তার একটি স্টুডিও আছে, যার ঠিকানা ২৩২৩ সেভেন্থ এভিনিউ। মিস্টার মিয়া ভারতের পূর্ব বাংলার মানুষ। (বেঙ্গলি হারলেম, বিবেক বাল্ড)।
উপরের প্রতিবেদনে কয়েকটি বিষয় খুব স্পষ্ট। ১৯২০ থেকে ১৯৩৫ অর্থাৎ এই পনের বছরেই ভারতীয় উপমহাদেশের শিপ জাম্পারদের সঙ্গে স্থানীয় আফ্রিকান আমেরিকান অথবা পুয়র্তেরিকানদের বিয়েশাদি বেশ জোরেসোরেই শুরু হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম স্থানীয় সংবাদপত্রে এ ধরনের বিয়ের সংবাদ খুব গুরত্বের সঙ্গে না ছাপলেও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বিষয়টি পত্রিকার পাতায় বেশ গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয় যে, পূর্ব বাংলা থেকে আসা অনেক বাঙালির নাম কিছুটা বিকৃতভাবেই ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে তখন। এটা ঘটেছে হয়তো এ ধরনের নাম সম্বন্ধে স্থানীয়দের অজ্ঞতা থেকেই। যেমন, আবদুল করিমের কথা ধরা যাক। বিয়ের নিবন্ধন পত্রে তার নাম ছাপা হয়েছে Abdul Kriam নামে। আবার মোকসেদ আলির কথাই ধরি। তার নাম লেখা রয়েছে Mokhd Ali এই নামে। এটা কার ভুল? পূর্ব বাংলা থেকে আগত শিপ জাম্পারদের ইংরেজি শিক্ষায় যথেষ্ট জ্ঞান না থাকা? নাকি, স্থানীয়দের মুসলমান নাম সম্পর্কে অজ্ঞতাই মূল কারণ? হয়তো দুটোই সঠিক। অথবা এমনও হতে পারে বিয়ের অনুষ্ঠানে ফর্ম পুরণ করার সময়ই ভুলটা ঘটেছে। অনবধানতবশত। এবং যে ব্যক্তি তাদের সাহায্য করেছেন নামধাম লেখায়, ভুলটা তিনিও করে থাকতে পারেন। তিনিই উচ্চারণ ধরতে না পেরে এরকম অদ্ভুত বানান লিখেছেন হয়তো, যা ইংরেজিতে অপ্রতুল জ্ঞানের বাঙালি বরটি ধরতেই পারেননি, বিয়ের নথিতে কি নাম লেখা হল তার!
বিয়ে-শাদির উটকো ঝামেলা
যে আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঙালিরা জীবন বাজি রেখে জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়তেন, সে স্বপ্নপুরণে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল আমেরিকার মাটিতে বৈধভাবে, স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করা। তৎকালীন সময়ে শিপ জাম্পারদের বৈধ হওয়ার সবচেয়ে সহজ সুযোগটি ছিল স্থানীয় কাউকে বিয়ে করা। যে কারণে আমেরিকার ডাঙায় কোনো রকমে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেই এই জাহাজ পলাতকরা তারপর সম্ভাব্য বিয়ের কনের সন্ধানে নেমে পড়তেন।
কারা ছিল সেই সম্ভাব্য বিয়ের কনে? শিপ জাম্পারদের বিয়ে শাদির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায় স্থানীয় পুয়র্তেরিকান নারী আর আমেরিকান কালো নারী(আফ্রিকান আমেরিকান)। এই নারীরাই ছিলেন বাঙালি শিপ জাম্পারদের আরাধ্য পাত্রী। এবং, এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিধবা। তবে বাঙালি পাত্রের কাছে তখন এটা খুব গুরূত্ব দিয়ে ভাবার মতো অবস্থা ছিল না। বিধাব হোক আর সধবাই হোক তার কাছে তখন সবচেয়ে জরুরি ছিল আমেরিকায় স্থায়ী হওয়া। তার কাছে সবচেয়ে গুরূত্বের ছিল পাত্রীর আমেরিকান নাগরিকত্ব। তবে চাইলেই এই বিধবাদের বিয়ে করা যেত ব্যাপারটা তেমনও ছিল না। পাত্রীর ঠিকুজি, মানে পারিবারিক অবস্থা-সব মিলিয়ে দেখে শুনে একজন বিয়ে করার মত উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে বের করা বেশ কঠিনই ছিল। তবে পাত্র হিসেবে একটা সুবিধা ছিল বাঙালি অভিবাসীদের: কর্মঠ হিসেবে সুনাম ছিল বাঙালিদের। দাঙ্গাবাজ নয়, মাদকাশক্ত নয় আর স্বভাবের নম্রতাও বিবেচনায় থাকত।
আরেকটা ব্যাপার, এসব বিয়ের সবই ছিল আসলে এক ধরনের বন্দোবস্তমূলক, এখানে প্রেম-ভালোবাসার কোনো বিষয় ছিল না। তবে কয়েকজন বাঙালি যুবক যে প্রেমে পড়েনি তাও বলা যাবে না। সেরকম উদারহরণও আছে। তবে বন্দোবস্তমূলক বিয়ে হলেও ভিনদেশি নারীকে বিয়ে করে পরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ জাহাজীরাই বেশ সুখী হয়েছিলেন। ইতিহাস এ স্বাক্ষ্যই দেয়। তবে এর মধ্যে দু একটি ব্যাতিক্রমী ঘটনাও চোখে পড়ে। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র সেই সময়ের নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত 'দি আমস্টার্ডাম নিউজ' এর 'অপরাধ বিভাগ' পাতা ঘেঁটে দেখা হলে, পুলিশের খাতায় পূর্ব বাংলা থেকে আসা বেশ কয়েকজন বাঙালির নাম পাওয়া যায়।
১৯২৬ সালের ১০ মার্চ 'দি আমস্টার্ডাম নিউজ' পত্রিকার অপরাধ বিভাগে একটি প্রতিবেদন ছিল এরকম:
'হুবায়দুল উল্লাহ এবং তার দুই বন্ধু একটু ভালো সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে ১৩৪ স্ট্রিটের লেনেক্স এভিনিউতে, তাদের পূর্ব পরিচিত বান্ধবী ফ্যানি ডায়ালসের জন্য অপেক্ষা করছিল। ফ্যানি তাদের সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের এপার্টমেন্টে নিয়ে যায়। এপার্টমেন্টে যেয়ে দুই বন্ধু ফ্যানির দেওয়া হুইস্কি পান করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে ফ্যানিকে নিয়ে হুবায়দুল উল্লাহ পাশের কামড়ায় গিয়ে অন্তরঙ্গ হয়। এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল, কিন্তু বিপত্তি বাধলো হুবায়দুল যখন আবিস্কার করল, তার প্যান্টের পকেটে রাখা মানি ব্যাগটি গায়েব হয়ে গেছে। হুবায়দুল সঙ্গে সঙ্গে এই কাজের জন্য ফ্যানিকেই দায়ি করল। হুবায়দুল তখুনি পুলিশের দ্বারস্থ হল, পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে ফ্যানি ডায়ালসকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেফতার করে...।'
উপরের এই সংবাদের গুরূত্ব অন্য জায়গায়। প্রথমত, হুবায়দুল যেহেতু তার মানিব্যাগ খোয়া যাওয়াতে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন, তার মানে দাঁড়ায় তিনি আমেরিকায় থাকার বৈধতা পেয়ে গেছেন। তিনি আমেরিকার বৈধ নাগরিক। তিনি নির্ভয়ে পুলিশ তলব করতে পারছেন। অবৈধ হলে পুলিশ ডাকার মত সাহস তার হবে না এটা বলাই বাহুল্য। দ্বিতীয়ত: হুবায়দুল টাকার বিনিময়ে সময় কাটাতে গিয়েছিলেন কিনা সংবাদে স্পষ্ট নয়। ফ্যানি পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত কিনা তার আভাসও কোথাও নাই। পেশাদার হলে এই সংবাদে, গুরূত্বর্ণ এ তথ্যটি গোপন করার কথা নয়। তারমানে ফ্যানি ভদ্র মেয়ে ছিলেন। হুবায়দূলের সঙ্গে সখ্য বা প্রেমের সম্পর্ক চলছিল!
আরেকটি ঘটনা। ১ মার্চ, ১৯৩৩ সালের দি আমস্টার্ডাম পত্রিকার অপরাধ বিভাগে বেশ বড় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এই সংবাদে স্থান পাওয়া বাঙালি ব্যক্তিটির নাম কুটি মিয়া। কুটি মিয়ার অপরাধ গুরুতর। কুটি মিয়া পূর্ব বাংলা থেকে এসেছিলেন ১৯২৭ সালে। ঠিকানা ২৬৭ ওয়েস্ট, ১৩৭ স্ট্রিট। কুটি মিয়া নিউইয়র্কে এসেই বেলিকা হিমেনেথ নামে দক্ষিন আমেরিকান নারীকে বিয়ে করেন। পত্রিকার প্রতিবেদনে লিখা হয়েছে:
'বিয়ের পাঁচ বছর পর ১৯৩২ সালে কুটি মিয়া তার প্রথম স্ত্রী বেলিকাকে ডিভোর্স না দিয়েই কারমেন হিমেনেথ নামের এক পুয়র্তেরিকান নারীকে বিয়ে করে তার সঙ্গে বসবাস করতে শুরু করেন।
কুটি মিয়ার প্রথম স্ত্রী বেলিকার অভিযোগের প্রেক্ষিতেই পুলিশ কুটি মিয়াকে গ্রেফতার করে। আদালতের রায় কুটি মিয়ার পক্ষে যায়নি। কুটি মিয়ার জেল-জরিমানার সঙ্গে তার পক্ষে লড়া উকিলও মামলায় হেরে ২৫ ডলার জরিমানা গুনেন, কুটি মিয়ার পক্ষে ৬ জন মিথ্যা স্বাক্ষীকেও আমেরিকায় অবৈধভাবে প্রবেশ করায় হাজতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।'
১৯৩০ সালের ৯ এপ্রিল দি আমস্টার্ডাম নিউজের আরেকটি অপরাধ পাতার প্রতিবেদন:
'...১০৩ ওয়েস্ট, ১২১ স্টিটের বাসিন্দা ওয়াট গ্রিফিন নামের ২৪ বছর বয়সি এক নারী আবদুল মোহাম্মদ নামের এক পূর্ববঙ্গীয় যুবকের সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশে তার টাকাপয়সা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে পেছন দিক থেকে ভারি অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করে। উল্লেখ্য যে আবদুল মোহাম্মদ ২০৫১ সেভেন্থ এভিনিউর বাসিন্দা।...
উপরের ঘটনায় আবদুল মোহাম্মদ গ্রেফতার হননি। তার মানে আবদুল মোহাম্মদ ততদিনে আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন। আবদুল মোহাম্মদকে অবৈধভাবে আমেরিকায় থাকার অপরাধে জেলে নেওয়া হয়নি এ ঘটনায়। পুলিশ শুধুমাত্র ওয়াট গ্রিফিনকে গ্রেফতার করে জেলে পুরেছে।
এপ্রিল ৩০, ১৯৩০ সালের 'দি আমস্টার্ডাম নিউজ' পত্রিকার আরেকটি প্রতিবেদন পড়লে ভিরমি খাওয়ার যোগাড় হতে পারে! প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে:
'আবদুল হক, বয়স ৩৫, অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য নিজের কাছে রাখার অপরাধে মাননীয় বিচারক তাকে জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে আবদুল হক ২২৫ ই নাইনটিনাইন স্ট্রিটের বাসিন্দা।'
১০০ বছর আগের নিউইয়র্ক শহরের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থাকে বিবেচনায় নিলে এটা বড় কোনো অপরাধ নয়, তখনকার বিচারে এ অপরাধ ছিল খুবই মামুলি।
শিপ জাম্পারদের ঘর-সংসার
'বাঙালি শিপ জাম্পাররা স্বামী হিসেবে ছিলেন নিষ্ঠাবান এবং দায়িত্ববোধের দিক থেকে ছিলেন অদ্বিতীয়। স্ত্রীর প্রতি তারা ছিলেন সৎ এবং স্ত্রীকে কখনই ঠকানোর চেষ্টা করেন নি।' এই কথাটি তৎকালীন আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষের বিয়ের বাজারে বাঙালিদের বেলায় বেশ চালু ছিল। বিশেষ করে আমেরিকার অবহেলিত কালো আফ্রিকান আমেরিকান এবং হত দরিদ্র পুয়ের্তোরিকান নারীদের কাছে বাঙালি বরদের বেশ কদরই ছিল। তাই ওই সময়ের বেশির ভাগ বিয়ে বর বাঙালি আর কনে পুয়র্তেরিকান। বাঙালিকে বর হিসেবে গ্রহণ করতে পুয়র্তেরিকান মেয়েদের তেমন আপত্তি ছিল না। অন্যদিকে বাঙালিরাও এই নারীদেরকে বিয়ে করে আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করার সুযোগ নিয়ে থিতু হতে চেয়েছে।
হাবিব উল্লাহকে স্বামী হিসেবে পেয়ে পুয়ের্তোরিকান ভিকতোরিয়াও অনেক সুখি হয়েছিলেন। বিয়ের পর পরই ভিকতোরিয়া পুয়ের্তোরিকোতে বসবাসরত তার বাবাকে একটি চিঠি লিখেন। সেই চিঠিতে তিনি স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেন যে, হাবিব উল্লাহ মানুষ হিসেবে অসাধারণ, সত্যিকারের একজন ভালো মনের মানুষ এবং তিনি সংসার জীবনে খুবই সুখী। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই ভিকতোরিয়া এবং হাবিব উল্লাহ এক ছেলে এবং এক কন্যা সন্তান লাভ করেন। ছেলের নাম রাখা হয় হাবিব উল্লাহ জুনিয়র এবং মেয়ের নাম হুমায়রা। সংসার জীবনে এই দম্পত্তি সুখে থাকলেও তাদের সংসারে অভাব অনটন লেগে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর আমেরিকার বাজার অর্থনীতিতে তখন মন্দা চলছিল। হোটেল, রেস্তোরাঁ অথবা কোনো কলকারখানায় কাজ পাওয়া সহজ ছিল না।
তবে ভিকতোরিয়াও হাবিব উল্লাহর মতই সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবার থেকে আসা কর্মঠ নারী। তাই দুজনেই রাতদিন কারখানায় কাজ করে সংসার চালিয়েছে। এমন কি মাঝে মাঝে অসুস্থ বাবার জন্যে কিছু টাকাও পাঠিয়েছে ভিকতোরিয়া পুয়র্তেরিকোয়। ভিকতোরিয়ার একটি চিঠিতে সেই চিত্রের আভাস মেলে। ভিকতোরিয়া তার বাবাকে লিখছেন,
'নিউইয়র্কের জীবন খুব কঠিন। এখানে মজুরীর পরিমাণ খুব অল্প, জীবন খুব মানবেতর। কিছুদিন পর আবার টাকা পাঠাবো...'
জানা যায় হাবিব উল্লাহ এবং ভিকতোরিয়া উল্লাহ দাম্পত্য জীবনে সুখি হয়েছিলেন। অন্যান্য বাঙালি শিপ জাম্পার, যারা বিদেশি নারী বিয়ে করেছিলেন তারাও এদের চেয়ে ব্যাতিক্রম ছিলেন না। আরেক বাঙারি ভিক্টর সাদ উল্লাহ, তাঁর পুয়ের্তোরিকান স্ত্রী হেলেন উল্লাহর বয়ান:
'সে(ভিকটর সাদ উল্লাহ) আমাকে আমার ধর্ম পালন করতে সবসময় সাহায্য করতো। সে নিজেও কোরান পড়তো এবং নিজের ধর্ম পালন করতো। আমি প্রতি রবিবার চার্চে যেতাম আর সে তার নামাজ পড়তো। আমাদের দুজনের ভীন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল, কিন্তু সেটি আমাদের সংসার জীবনে কখনই কোনো অন্তরায় হয়ে উঠেনি। আমাদের সন্তানরাও ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত ছিল এবং তাতে তার কোন আপত্তি ছিল না। কিন্তু সে তার নিজের ধর্মে সব সময় অবিচল থেকেছে। এবং তাতে আমার কোনই আপত্তি ছিল না।'
কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া বেশিরভাগ বাঙালি শিপ জাম্পারই স্বামী হিসেবে দায়িত্বপূর্ণ আর প্রেমিক হিসেবেও ছিলেন নিবেদিত। তাদের স্ত্রীদের ভাষ্যে সেরকম কথাই লিপিবিদ্ধ হয়েছে আরও নানা জায়গায়।
তথ্যসূত্রঃ
Bald,Vivek, Bengali Harlem and the Lost Histories of South Asian America, Harvard University Press, Hardcover – November, 19, 2013)
আদনান সৈয়দ, 'শিপ জাম্পারঃ বাঙালির আমেরিকা যাত্রা', 'মুক্তধারা নিউইয়র্ক', প্রকাশকাল ২০২০
(https:/ww/w.everyculture.com/multi/A-Br/Bangladeshi-Americans.html)