নিউ অরলিন্সের তাদের ঘর গেরস্তি
আমেরিকার লুজিয়ানা রাজ্যে মিসিসিপি নদীর পাড়ে নিউ অরলিন্স শহর। অনলাইন তথ্য ভান্ডার উইকিপিডিয়ার মতে ১৮০৮ সালে নিউ অরলিন্স ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বড় দাস কেনা বেচার শহর। সেই সময় প্রায় এক মিলিয়ন দাস কেনাবেচা হয়েছিল এই শহরটিতে। বর্ণনা শুনলেই বোঝা যায় যে শহরটি ছিল বর্ণবাদের আখড়া। ১৮০৩ সালে ফরাসীদের কাছ থেকে রাজ্যটি কেনার পর থেকে সেখানে আ্যংলো আমেরিকানদের বসত গড়ার হিড়িক পড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই ১৮৩০ সাল থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত লুজিয়ানার জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। নিউইয়র্ক এবং বাল্টিমোরের পরেই নিউ অরলিয়েন্স অন্যতম ঘনবসতির শহরে পরিণত হয়। প্রচুর পরিমাণে আমেরিকান, ইউরোপিয়ান ব্যাবসায়ীদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নিউ অরলিয়েন্স শহরটি অর্থনৈতিকভাবে এক বিশেষ জায়গা তৈরি করে নিতে সমর্থ হয় মার্কিন মুলুকে।
খুব স্বাভাবিকভাবেই আফ্রোআমেরিকান, লাতিন আমেরিকান এবং ভারতবর্ষের শ্রমজীবী মানুষদের দৃষ্টি পরে এই শহরটির ওপর। পূর্ব বাংলা থেকে আগত শিপজাম্পারদের বসত গড়ার তালিকায় নিউ অরলিয়েন্সের নাম ছিল সর্বাগ্রে। ফেরিওয়ালা, ফুড ভেন্ডারসহ বিভিন্ন রকম কাজকর্মের চমৎকার সুযোগ তৈরি হয়েছিল সেখানে। শুধু তাই নয় প্রচুর পরিমাণে আফ্রো-আমেরিকান কালো মানুষ নিউ অরলিয়েন্সে স্থায়ীভাবে চলে আসার কারনে শহরটি পুরো একটি অভিবাসীদের শহরে পরিনত হয়ে পড়ে।
তৎকালীন সময়ে পূর্ব বাংলা থেকে আসা জাহাজিদের চোখ নিউ অরলিন্সের দিকে থাকতো দুটো কারনে। এর মূল কারণ ছিল, সেখানে আশানুরূপ পর্যটকের সমাহার। পর্যটন মানেই কাজকর্মের সুবিধা আর সেই সঙ্গে দেশ থেকে নিয়ে আসা বিলাসদ্রব্য ফেরি করে বিক্রি করার সুবর্ণ সুযোগ। আর নিউ অরলিন্সের সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা্র বিবেচনায় থাকতো। এখান থেকে খুব দ্রুত যে কোন সময়ে আরেক শহরে চলে যাওয়া যায়। পূর্ব বাংলা থেকে নিয়ে আসা তৈজষপত্র, কার্পেট, শাল, চাদর, উড়না, সিল্কের কাপড়, মাফলার ইত্যাদি জিনিষপত্র তখুনি নিউ অরলিয়েন্সে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। শহরের বিশেষ ভদ্র সমাজেও ভারতীয় পণ্যের বিশেষ কদর তৈরি হয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ১৮৮৫ সালে নিউ অরলিয়েন্সে অনুষ্ঠিত হয়েছিল 'আন্তর্জাতিক কটন এক্সিবিশিন'। এই সূতিবস্ত্রের বানিজ্যিক মেলায় পূর্ব বাংলা থেকে আসা মনোহারী চটের ব্যাগ, তৈজষপত্র বেশ নজর কাড়ে স্থানীয় ও পর্যটকদের।
বাঙালিদের উপস্থিতি ছাড়াও ধীরে ধীরে উনিশ শতকের দিকে নিউ অরলিয়েন্স হয়ে উঠে রাশান, আফ্রিকান, পোলিশসহ বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের মিলন মেলা। শহরটিতে গড়ে উঠে বিশাল চায়না টাউন, ফ্রেঞ্চ মার্কেট, সিসিলিয়ান মার্কেট, সেন্ট মেরি মার্কেটসহ অনেক বড় বড় মার্কেট। বহুভাষী, বহুবর্ণের মানুষ: জার্মান, ফরাসি, চাইনিজ, বাঙালি, নেটিভ ইন্ডিয়ান, স্প্যানিশসহ বিভিন্ন জাতির মিলিত প্রচেষ্টায় নিউ অরলিয়েন্সে অনন্য এক পর্যটন নগরীতে পরিণত হয়। ১৯০০ সালের পর নিউ অরলিয়েন্সে ছিল পুর্ব বাংলার বাঙালিদের জন্যে সবচেয়ে বেশ নিরাপদ এবং কর্মসংস্থানের জন্য আদর্শ শহর।
১৮৯০ সাল থেকে ১৯১৫ সালে সবচেয়ে বেশি বাঙালিদের আগমণ ঘটে নিউ অরলিন্সে। এখানকার প্রথম, এবং আদি বাঙালির নাম হাজি হক। আমেরিকার নিউ অরলিন্সে যখন তিনি থিতু হয়েছেন তখন তার বয়স আটত্রিশ। তিনি রাস্তায় রাস্তায় ভারতীয় রেশমের কাপড় ফেরি করে করেন। থাকেন নর্থ জনসন স্ট্রিটে, আরো অনেক বাঙালি শিপজাম্পারের সঙ্গে। তার এক সঙ্গীর নাম আবদুল আজিজ। তার বয়স পয়ষট্টি। তিনি আমেরিকায় এসেছেন আরো দশ বছর আগে, অর্থাৎ ১৮৯৭ সালে। নিউইয়র্কের এলিস আইল্যান্ডে তার জাহাজ ভিড়েছিল। জাহাজ থেকে নেমে আরও দুই বাঙালির সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তিনি এসে থিতু হয়েছেন নিউ অরলিয়েন্স।
হাজি হক আর আবদুল আজিজ ছাড়া আরো দুজন প্রথম দিককার বাঙালি আছেন নিউ অরলিয়েন্সে, তারাও অনেক দিন ধরেই আছেন। সোলায়মান মন্ডল এবং ফজলে রহমান। তারা দুজনই থাকেন নর্থ রোমান স্ট্রিটে, ছোট একটা ভাড়া বাড়িতে। আরও দুজন পূর্ব বঙ্গীয়; বয়সে প্রবীণ, ৫১ বছর বয়সি আবদুল গাফ্ফার এবং ৪৬ বছর বয়সি আবদুল মজিদ থাকেন নর্থ ক্লেইবোর্ন এভিনিউতে। সাধারণত যারা নতুন আসেন তাদেরকে বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে শলাপরামর্শ দেওয়া তাদের অন্যতম কাজ।
তারা দুজন এসেছিলেন ১৮৮৮ সালে নিউ অরলিয়েন্সের ক্যাসেল গার্ডেন শহরে। সাধারণত ওই সয়ে, সবাই পৌঁছাতে এলিস অঅেইল্যান্ডে। তারা দুজনও তাই। প্রথম নিউইয়র্কের এলিস আইল্যান্ড, তারপর চলে আসেন নিউ অরলিয়েন্সে, এখানে আসেন মূলত গা ঢাকা দিয়ে থাকার জন্য। তখনও তাদেরবৈধ কাগজপত্র হয়নি। ওই সময়ে আমেরিকায়, তাদের মতো একই উদ্দেশ্যে আসা জাহাজীদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। ১৮৯০ সাল থেকে শুরু করে ১৯১০ পর্যন্ত এটা ভালোভাবেই অব্যাহত থাকে।
১৯০৩ সালে মিসিসিপি থেকে প্রকাশিত 'বিলক্সি ডেইলি হেরাল্ড' পত্রিকার একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল: 'ইস্ট ইন্ডিয়া পেডলারস' প্রতিবেদক এখানে লিখছেন:
'নিউ অরলিন্সের রাস্তায় সর্বত্রই এখন পূর্ব ভারত থেকে আসা জাহাজীদের দেখা যাচ্ছে। ১৯০০ সাল থেকেই এদের উপস্থিতি উলেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে এবং বর্তমানে এদের সংখ্যা নিউ অরলিন্সে এতই বেড়েছে যে তাদেরকে দেখে খুব সহজেই চেনা যায়...'
এই জাহাজ পলাতকদের নিউ অরলিয়েন্সে আগমন ঘটার কয়েকটি কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এখন সবচেয়ে চিত্তার্কষক কারণটি উল্লেখ করা যেতে পারে: আগেই বলা হয়েছে নিউ অরলিন্সে প্রচুর ভিনদেশিদের ভিড় রয়েছে, কাজের সুবিধা ভালো, প্রচুর বাঙালি আছে, আর বাঙালিরা এখানে খুব সহজেই; কোনো রকম হুজ্জোত ছাড়া আফ্রিকান মেয়েদের বিয়ে করে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিতে পেরেছে। এই সুবিধাটি আমেরিকার নিউইয়র্ক বা নিউজার্সিতে এত সুলভে সম্ভবত হতো না। কারণ নিউইয়র্কে আফ্রিকান-আমেরিকান কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারাটা ছিল যেন ভাগ্যের ব্যাপার এবং ব্যয় সাধ্যও। নিউইয়র্কে যারা, হারলেমে ছিলেন তারা এ কারণেই বিয়ে করতেন পুয়ের্তোরিকান মেয়েদের। ধারণা করা হয় পুয়ের্তোরিকান মেয়েদের স্বভাব চরিত্রে বাঙালি রমনীদের সঙ্গে মিল পাওয়া যেত, তারা ঘর-গৃহস্থালী কাজেও দক্ষ ছিল।
তবে নিউ অরলিয়েন্স বাঙালির জন্য সবচেয়ে নিরাপদ ছিল, তবে পুয়ের্তোরিকান মেয়েরা নয়, এখানে ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান মেয়েরা।
গোড়া থেকেই নিউ অরলিন্সে বাঙালিরা বেশ সুনামের সঙ্গেই বসবাস করে আসছিল। তারা নিরীহ, কোনো রকম মাদক ব্যাবসার সঙ্গেও জড়িত না। আর বউ অনুরক্ত। সৎ উপার্জন আর সাধারণ জীবন যাপন তাদের ধর্মীয় আচরণের মধ্য থেকে এসেছে, আর শেতাঙ্গদের সঙ্গেও কোনো বিরোধে যায় না। এসব কারণে বিয়ের বাজারে তাদের কোনো অখ্যাতি ছিল না। কাজেই বিয়ে এবং ব্যাবসাপাতি এ দুটোকে মেলানোর জন্য নিউ অরলিয়েন্স এসে ভিড় করেছে বাঙালি শিপজাম্পাররা।
প্রচন্ড গরমে শহরের বিভিন্ন স্থানে পর্যটকদের জন্যে দেশি কায়দায় লাল নীল রং মিশিয়ে মনোহারি শরবত বিক্রি করেও অনেক বাঙালি জীবিকা নির্বাহ করেছে শুরুর দিকে। যদিও এভাবে খোলা রাস্তায় শরবত বিক্রি করার কোনো অনুমতি তখন তাদের ছিল না।
নিউ অরলিন্সের পথে পথে
বাঙালিরা আবাসস্থল হিসেবে কালো আফ্রিকান-আমেরিকান প্রধান্ এলাকাকেই বেছে নিত। শুধু নিউ অরলিয়েন্সে নয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্য যে কোন শহরেই জাহাজী শ্রমিকরা এই উপায় অনুসরণ করত, শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত অঞ্চলের চেয়ে বসতি স্থাপনের জন্য শিপজাম্পারদের জন্য নিরাপদ ছিল শ্রমিক শ্রেনি আর কালো, স্প্যানিশ প্রধান এলাকা। নিউইয়র্কের বাঙালিরাও কালো এবং স্প্যানিশ অধ্যুষিত এলাকা হারলেম এবং লোয়ার ইস্ট সাইডে আবাস গড়ে তুলেছিল।
নিউ অরলিয়েন্সের মূল শহরের কেনেল স্ট্রিট মূলত শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত ছিল, আর শহর থেকে কিছুটা দুরে কালোদের শহর ছিল নর্থ ক্লেইবোর্ন, সেন্ট লুইস স্ট্রিট, রবার্টসন স্ট্রিট এবং ট্রেমে। এই শহরগুলোতে আফ্রিকান, স্প্যানিশদের সঙ্গেই বাঙালিরাও থাকা শুরু করেছিল। তবে খারাপ দিক ছিল আফ্রিকান অধ্যুষিত এই এলাকাগুলোতে নিত্যদিন খুন-গুম লেগেই থাকতো। আর উল্লেখ করার মতো বিষয় হল: এ অঞ্চলেই নিউ অরলিয়েন্সের একমাত্র পতিতালয়টির অবস্থান ছিল। এ কারনে বন্দরের জাহাজের খালাসি এবং পর্যটকদের যত সমাগম হত শহরের এ অংশেই ।
পর্যটক আসা মানেই ব্যাবসা বানিজ্যের সুযোগ তৈরি হওয়া। এ কারণে এই শহরগুলোকে আকড়ে ধরেই ধীরে ধীরে বাঙালি বসতি দানা বাঁধতে শুরু করে। এই শহরের অলিগলিতে বাঙালি খুদে ব্যাবসায়ীরা ভারতবর্ষ থেকে আসা সৌখিন সিল্কের কাপড়, তৈজষপত্রসহ বিভিন্নরকম জিনিষপত্র বিক্রি করতো। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে নিউ অরলিয়েন্সে প্রথম সিল্কের কাপড় বিক্রি শুরু করেন আলিফ আলি, মোকসুদ আলি, জয়নাল আবেদিন এবং আয়নুদ্দিন মন্ডল। তারা কীভাবে কোথায় সহজভাবে খদ্দের পাওয়া যাবে এবং স্থানীয় ব্যাবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজস করে সঙ্গে আনা জিনিষপত্রগুলো সহজে বিক্রি করা যাবে এ বিষয়ে নবাগত বাঙালিদের পরে তালিমও দিতেন।
বৈধতার লোভে অনেক বাঙালি দেশে স্ত্রী রেখে আমেরিকায় এসে আরেকটি বিয়ে করতেন। কিন্তু সাধারণত যা হত। শুরুতে তারা শুধু কাগজপত্রের জন্য বিয়ে করলেও, দেশের স্ত্রীর কাছে আর ফেরা হত না কোনোদিনই। এক সময় আমেরিকাতেই স্থায়ীভাবে হয়ে যেতেন। ওদিকে স্বামীর পথ চেয়ে পূর্ব বাংলার সহজ সরল কোনো বাঙালি বধূ হয়তো তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অপেক্ষার প্রহর গুণেই যেত। এমন ঘটনাও প্রচুর আছে।
আমেরিকায় অবস্থানরত এই খাটো, কালো বাঙালিদের স্থানীয় আফ্রিকানরা ডাকতো 'হিন্দু' বলে। তাদের ধারণা ছিল যারাই ভারতবর্ষ থেকে আসত যারা, তারা সবাই হিন্দু। এই হিন্দু বনাম নিগ্রোদের মাঝে ঝামেলাও কম হয়নি। উদাহরণ হিসেবে এক আবু কয়সারের কথা বলা যাক। তিনি পূর্ব বাংলা থেকে এসেছিলেন ১৯০৮ সালে এবং এসেই তিনি কালোদের এলাকা ট্রেমের একজন পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানকার এক আফ্রিকান আমেরিকান মেয়ে, নাম আদেলে ফোরটেনিও। এক পর্যায়ে তার সঙ্গে আবু কায়সারের মন দেওয়া নেওয়া শুরু হল। কিন্তু কিছুদিন পর বজ্রপাতের মতো আবু কায়সার আবিস্কার করলেন যে আদেলে মূলত স্থানীয় এক কালো মাফিয়ার রক্ষিতা। ফলে আবু কয়সারকে প্রাণ বাঁচাতে ওই এলাকা ছাড়তেই হলো।
অবশ্য সবাইকে আবু কায়সারের পরিণতি বরণ করতে হয়েছে তাও নানি। অনেকেই আফ্রিকান আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে সুখিও হয়েছেন। এরকম একজন আলিফ আলি। তার স্ত্রী আফ্রিকান আমেরিকান। নাম এমিলি। তিনি বিয়ে করেন সেন্ট লুইস এলাকায়।
আরেকজন জয়নাল আবেদিন বিয়ে করেছিলেন ফ্লোরেন্স প্রেজ নামের এক কালো আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলাকে। মোকসুদ আলি বিয়ে করেন এডাকে, সফুর আলি বিয়ে করেন সান্তা ক্রুজকে, এবং হাসান আবদুল বিয়ে করেন ভায়োলা উইলসন নামের এক মহিলাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই নারীদের সবাই ছিলেন সেখানকার স্থানীয় হতদরিদ্র আফ্রিকান-আমেরিকান সমাজের।
আলিফ আলির স্ত্রী বিয়ের কিছুদিন পরই মারা যান। আলিফ আলি তখন দুই সন্তানের জনক। তিনি আর বিয়ে করেননি। তিনি তার দুই সন্তান নিয়ে নিজ জন্মভুমিতেও একবার ঘুরে গিয়েছিলে বলে জানা যায়।
তবে আলিফ আলির মতো স্ত্রীভাগ্য সবার হয়নি। মোকসুদ আলির সঙ্গে স্ত্রী এডা ওয়ালেসের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় বিয়ের তিন বছরের মাথাতেই। আলাউদ্দিন মন্ডলেরও একই দশা হয়। স্ত্রী রিটা আলবার্টের সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয় বিয়ের চার বছরের ব্যাবধানে। তবে অনেকেই বৈধকাগজপত্র পেয়ে যাওয়ার পরও সংসারকে আকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে গেছেন এবং সফলও হয়েছেন।
নিউ অরলিন্সের তিন বাঙালি শিপজাম্পার
নিউ অরলিন্সে যে তিনজন জাহাজ পলাতক বাঙালির নাম সবার আগে আলোচিত হয় তারা হলেন সফুর আলি, জয়নাল আবেদীন এবং মোকসেদ আলি। এই তিন বাঙালিই ছিলেন তৎকালীন সময়ের নিউ অরলিয়েন্সের উল্লেখযোগ্য বাঙালি ব্যক্তিত্ব। আমেরিকায় নিউ অরলিয়েন্সে এই তিন বাঙালি শুধু নিজেরা বসত গড়েননি পাশাপাশি উপমহাদেশ থেকে আসা অগনিত জাহাজ পলাতকদের জন্যেও তারা ছিলেন বাতিঘরের মতো।
সফুর আলি
সফুর আলি নিউ অরলিয়েন্সে এসেছিলেন ১৮৯৫ সালে। ১৮৯৫ সালের বসন্তে তিনি তৎকালীন পূর্ব বাংলার সিলেট থেকে কলকাতা হয়ে, আরো কুড়ি জন জাহাজির সঙ্গে আমেরিকার নিউ জার্সিতে এসে গা ঢাকা দেন। নিউজার্সি রাজ্যে গোপনে পাঁচ বছর থাকার পর অর্থাৎ ১৯০০ সালে সফুর আলি পাড়ি দেন নিউ অরলিয়েন্সে। সেখানে ১৪২০ সেন্ট লুইস স্ট্রিট ঠিকানাটি ছিল বাঙালি শিপজাম্পারদের জন্যে সদা উন্মুক্ত একটি আস্তানা। সফুর আলি যখন এই বাড়িতে উপস্থিত হন, তখন এ বাড়ির বাসিন্দা ছিলেন সোলায়মান মন্ডল, এসরাক আলি, আবুদল সোবহান। তারা আরো কিছু বাঙালিসহ আগে থেকেই এখানে থানা গেড়েছিলেন।
সুদূর পূর্ব বাংলা থেকে আমেরিকার এই অচেনা শহরে আসা জাহাজ পলাতকদের জন্য এই বাড়িটাই ছিল প্রথম ঠিকানা। এ বাড়িতে থেকেই শুরু হত তাদের কাজ জোগাড়ের চেষ্টা, তারপর বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়া। বৈধ কাগজপত্র অথবা কাজকর্মের কুল-কিনারা হলে তারা তখন নতুন ঠিকানায় উঠে যেতেন।
সফুর আলিও অন্যদের মতই এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েই শুরু করেছিলেন তার আমেরিকায় বৈধ হওয়ার সংগ্রাম। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পলাতক জাহাজীদের জন্য সবচেয়ে সহজ পথে বৈধ হওয়ার পথ ছিল দ্রুত একজন আমেরিকান নারীকে বিয়ে করে ফেলা। সফুর আলিও ওই একই চেষ্টা করে দ্রুতই সফল হন। তিনি সান্তা ক্রুজ নামের এক অফ্রিকান-আমেরিকান নারীর সন্ধান পেলেন। সান্তা ক্রুজের জন্ম লুজিয়ানা অঙ্গরাজ্যে। তার বাবা ছিলেন কিউবান নিগ্রো দাস, আর মাও কিউবান।
সান্তা ক্রুজ আর সফুর আলীর বিয়ে হয় স্থানীয় চার্চে। ১৯০৬ সালে। ১৯১০ সালের মধ্যে সফুর আলি তিন সন্তানের জনক হন। আব্রাহাম, আইজাক এবং মোহাম্মদ।
সফুর আলি প্রথমে রাস্তায় ফেরিওয়ালার কাজ দিয়ে জীবিকা শুরু করেছিলেন। ব্যবসায় প্রসার হলে, রাস্তায় ঘুরে ফেরি করা ছেড়ে দিয়ে ১৯২০ সালে নিউ অরলিন্সে মুদি দোকান দিয়ে বসেন তিনি। মুদির দোকানের ভার তিনি একসময় তুলে দেন, স্ত্রী এবং পুত্রদের হাতে। সফুর আলি পরে আরও তিন সন্তানের বাবা হন। আবদুল, বেলি এবং ফাতিমা। ১৯৩০ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার বছরে সফুর আলির ব্যাবসাতেও চরম ধ্বস নেমে আসে। তবে সফুর আলি সেই মন্দাও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাটিয়ে উঠেছিলেন।
সফুর আলি নিউ অরলিন্সের এন স্ট্রিটে থাকতেন। সম্ভবত ওই সময়েই 'ড্রাই গুড সপ' দোকান তিনি বিক্রি করে দেন। দোকান বিক্রি করে দিয়ে তিনি আবার তার পুরনো স্ট্রিট ভেনডরের কাজে ফিরে যান। ততদিনে তার ঠিকানারও বদল হয়েছে। এন স্ট্রিট থেকে তিনি নিউ অরলিয়েন্সে নতুন ঠিকানায় চলে এসেছেন। এবং তার নতুন ঠিকানাও পূর্ব বাংলা থেকে আগত নতুন জাহাজিদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।
১৯০৮ সালে পূর্ব বাংলা থেকে আসা তসলিম মন্ডল এবং ফটিক শেখ তার এই বাড়িতেই উঠেছিলেন। পরবর্তীতে সফুর আলি স্থানীয় 'ব্ল্যাক ক্যাথলিক চার্চ' এবং স্থানীয় বিভিন্ন রকম মানবতাবাদী এবং মানব উন্নয়ন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হন। পূর্ব বাংলা থেকে আসা নতুনদের সঙ্গে স্থানীয় আমেরিকানদের সৌহার্দের মেলবন্ধন তৈরির উদ্দেশ্যে চার্চে 'ওয়েলকাম সেন্টার' খুলেন তিনি। তার ওয়েলকাম সেন্টারের কাজ ছিল নতুন আগন্তকদেরকে বৈধ হওয়ার কাগজপত্র, ইংরেজি শিক্ষা, কাজকর্মের প্রশিক্ষণ, বাসা ভাড়া এবং অভিবাসনের আইনগত জটিলতাসহ নানা বিষয়ে সহযোগীতা করা। সফুর আলির সঙ্গে আরও যোগ দেন স্থানীয় কিছু শিক্ষিত শ্বেতাঙ্গ এবং আফ্রিকান-আমেরিকান, তারা আগেও অভিবাসীদের বিভিন্ন রকম মানবিক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
জয়নাল আবেদীন
জয়নাল আবেদীন পূর্ববঙ্গের আরেকজন। তিনি নিউ অরলিয়েন্সে এসেছিলেন ১৮৮৮ সালে। পূর্ব বংলার নোয়াখালি থেকে। জয়নাল আবেদীনও ঠিক সফুর আলীর মতই শিপজাম্পাদের অকাতরে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছেন। তিনি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। স্থানীয় বাঙালিদের বিয়ে পড়ানো থেকে শুরু করে সব রকম ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান তিনিই করতেন। গবেষক এবং লেখক ভিভেক ব্লাল্ডের গ্রন্থ 'বেঙ্গল হারলেম' থেকে জানা যায় ১৮৯২ সালে বাঙালি মুসলিম ছেলে মোকসেদ আলির সাথে আফ্রিকান-আমেরিকান মেয়ে আডা ওয়ালেসের বিয়ের মূল আয়োজক ছিলেন জয়নাল আবেদীন। জয়নাল ছিলেন মোকসেদ আলির বন্ধু। পরবর্তীতে ১৯০০ সালে জয়নাল আবেদীন বিয়ে করেন ফ্লোরেন্স প্রেজ নামের এক পুয়ের্তোরিকান মহিলাকে। তাদের চার ছেলেমেয়ে: আর্থার, নফসুর, খাদিজা এবং জয়নাল জুনিয়র। কিন্তু জয়নাল দীর্ঘায়ূ হননি, যক্ষা রোগে ১৯০৫ সালে মাত্র ৪০ বছর বয়সে মৃতুবরণ করেন।
মোকসেদ আলি
মোকসেদ আলি ছিলেন ১৮৮৮ সালে পুর্ব বাংলা থেকে নিউ অরলিয়েন্স আসেন। তিনি এলা নামে এক আফ্রিকান-আমেরিকানকে বিয়ে করেন। এলারা এসেছিল আমেরিকার টেনেসি অঙ্গরাজ্য থেকে, তার জন্মও ওখানে।
মোকসেদ ও এলার বিয়ে হয় ১৮৯৫ সালে। বিয়ের এক বছরের মাথাতেই তাদের পুত্র সন্তান হয়, তার নাম রাখা হয় মনজুর আলি। মোকসেদ আলিও পেশায় ছিলেন ফেরিওয়ালা। তিনি রাস্তায় ফেরি করে সিল্কের কাপড় বিক্রি করতেন। পরবর্তীতে মোকসেদ এবং এলা দুজনেই নিউ অরলিয়েন্সে ১৪২০ স্ট্রিটে উঠে আসেন। এই বাড়ির দরজাও শিপজাম্পারদের জন্যে উন্মুক্ত ছিল। জীবনের শেষ দিকে মোকসেদ আলী স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মিশিগান চলে যান। তাদের বংশধররা এখন নিউইয়র্কের হারলেমে বসবাস করেন।
নিউ অরলিয়েন্সে বাঙালির ব্যবসা
১৯১০ সালের চৈত্রের এক দুপুর। ক্লেইনবোর্নের বড় রাস্তাটা তখন খুব ফাঁকা। এই ভর দুপুরে খদ্দের আসবে কোথা থেকে? তারপরও রাস্তার দু'পাড়ে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট দোকানের দোকানীরা খদ্দেরের আশায় অপেক্ষমান। লক্ষণীয় হল এই দোকানের মালিকদের দেখলেই বোঝা যায় তারা সবাই ভারত উপমহাদেশ থেকে এসেছে। গায়ের রং চাপা, তামাটে। মাঝারি গড়ন। চোখে মুখে ইস্পাতের মত দৃঢ় প্রত্যয়। বয়সে সবাই তরুণ। সবার বয়স আঠারো থেকে পয়ত্রিশের মধ্যে। এরা বেশির ভাগই সিল্ক কাপড় বিক্রেতা। কেউ কেউ জাহাজে নিউইয়র্কে আসা অন্য বাঙালিদের সঙ্গে আনা কাপড়, বিভিন্নরকমের তৈজষপত্রের পসরা নিয়েও বসেছে। এ সময়ে পূর্ব বঙ্গ থেকে হুগলি, হুগলি থেকে ইংল্যান্ড তারপর নিউইয়র্ক হয়ে রেলপথে নিউ অরলিয়েন্স-এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসত ভারতীয় এবং বঙ্গদেশিয় পণ্য। ক্লেইবোর্ন এভিনিউর প্রথম দোকান ছিল পূর্ব
বাংলা থেকে আগত সফুর আলির। কাপড়ের দোকান। দোকানের নাম 'ড্রাই গুড শপ' তেমন আহামরি খদ্দের হয় না। সফুর আলি একাই দোকান চালান। সামনে ৮২৬ নর্থ ক্লেইবোর্ন এভিনিউর ডানে মোর নিতেই চোখে পড়বে পিটার স্ট্রিট। এই পিটার স্ট্রিটের শেষ প্রান্তে আবদুর রহমানের সদ্য নির্মিত কাপড়ের দোকান 'লেডিস ড্রেস স্টোর'। আরেকটু সামনে, ৯০০ নর্থ ক্লেয়ারবোর্ন রাস্তার ঠিক পশ্চিম পাশেই তাওয়াক্কুল হালদার এবং আবদুল জলিলের যৌথ মালিকানার কাপড়ের দোকান 'রেডি-টু-অয়ার স্টোর'। নাম দেখেই বলে দেওয়া যায়, এটিও কাপড়ের দোকান। আরেকটু সামনে গেলে ৯১৪ নর্থ ক্লেইবোর্ন এভিনিউর ঠিক চৌমাথায়, একটা দরজি কাম কাপড়ের দোকান। এই দোকানের মালিক আবদুর রহিম সরকার। তিনি এই দোকানের নাম রেখেছেন 'ইস্ট ইন্ডিয়া ফেনসি নিডলওয়ার্ক'। তিনি মূলত সেলাই শিল্প থেকে শুরু করে সিল্কের এম্ব্রোয়ডারি কাজ করেন নিখুতভাবে। ৯২৮ নর্থ ক্লেইবোর্নের পাশেই রয়েছে আরেকটি হালকা পানীয় আর শুকনো খাবারের দোকান। এই দোকানের মালিক আবদুল হামিদ। তিনি প্রথম নিউইয়র্কে ছিলেন পরে, এখানে নিউ অরলিয়েন্সে এসে হালকা পানীয় আর স্টেশনারির ব্যবসা খুলে বসেছেন।
উপরের এই ব্যক্তিরা নানা ঝড়, বাধা মোকাবেলা করে আমেরিকার বুকে বসতি গড়েছেন। যতদিন গেছে তত এই শিপজাম্পাররা আমেরিকার বুকে তাদের শেকড় গভীর করেছেন। এখন সাড়া আমেরিকা জুড়েই ছড়িয়ে আছে তাদের বংশধররা। উপরের বর্ণনা তাদের সেই ভিত রচনার টুকরো কিছু ছবি মাত্র।
তথ্যসূত্রঃ
(https:/ww/w.myheritage.com/research/collection-10017/passenger-immigration-lists-1500-1900?)