দেশের বাজারে অবাধে বিকোচ্ছে ৬৫ হাজার টাকার ‘ভুয়া’ ক্যান্সার ইনজেকশন
বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির বলেছেন, ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয় এমন একটি আমদানিকৃত ইনজেকশন বাজার থেকে সংগ্রহের পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে- সেই ওষুধে ক্যান্সার প্রতিষেধকের কোন কিছু নেই। অথচ এই ইনজেকশনের একটির দাম ৬৫ হাজার টাকা। ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস এই পরীক্ষা করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার (৩০ মে) সকালে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ইনসেপ্টার প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান মুক্তাদির। বাজারে নিম্নমান ও মানহীন ওষুধ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি এ তথ্য দেন। আব্দুল মুক্তাদির ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
সংবাদ সম্মেলনের পরে আব্দুল মুক্তাদিরের কাছে টিবিএসের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিলো যে, ওই পরীক্ষার পরে ইনসেপ্টা কি সরকারের কোন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানিয়েছে? জবাবে তিনি বলেন, "এগুলো ছিল র্যান্ডমলি (দৈবচয়ন) সংগ্রহ করা অজ্ঞাত (ব্র্যান্ড নামহীন) সব নমুনার। আমরা এগুলো কোথাও জানাইনি, যেসব পণ্যের কোনো ব্র্যান্ড নেম নেই— সেগুলোকে বোঝাতে আমি এই উদাহরণ দিয়েছি।"
তিনি বলেন, দেশের বাজারে মানসম্পন্ন, নিম্নমানের ও মানহীন ওষুধ রয়েছে। বর্তমানে চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশনে) ওষুধের জেনেরিক নাম না লিখে– কোম্পানির ব্রান্ড নেম লেখে। অনেকে প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার কথা বলেন। এটা করা হলে রোগীরা কোন ওষুধ খাবেন, তা নির্ভর করবে বিক্রেতা ও ইন্সুরেন্স কোম্পানির ওপর। এতে নিম্নমান বা মানহীন ওষুধের প্রসার বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকবে। আবার ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হবে।"
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, ওষুধের কাঁচামালের দাম, আমদানির শুল্ক এবং ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির প্রভাবে ওষুধ শিল্পের পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের কথা রয়েছে। এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরে ওষুধের পেটেন্ট (মেধাস্বত্ব) ও রপ্তানি বাজারে তার প্রভাব ও প্রস্তুতি এবং ওষুধের মান আর দামে বিপণন খরচের প্রভাব নিয়েও কথা বলেন।
আব্দুল মুক্তাদির বলেন, দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয় ওষুধ কোম্পানিগুলো সরবরাহ করে। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের অবিরত সহায়তায় এ অবস্থানে আসা সম্ভব হয়েছে। একইভাবে ওষুধ শিল্প দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখছে।
"টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এ শিল্পে অনেক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে প্রতি ডলার ১১৭.৫০ টাকা বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। গ্যাস- বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। বর্তমানে ইনসেপ্টাকে প্রতি মাসে ১৯ কোটি টাকা গ্যাস-বিদ্যুতের বিল দিতে হয়। যা দুই বছর আগেও ছিল ৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়েছে। আগে যেখানে ৭-৮ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যেত, বর্তমানে সেখানে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ সুদে চলতি মূলধন নিতে হচ্ছে। কর্মীদের বেতন বাড়াতে হয়েছে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। এতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু, উৎপাদন খরচ যতটা বেড়েছে, সেই হারে ওষুধের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। কারণ তাতে ওষুধ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। এতে ওষুধ কোম্পানি মুনাফা কমেছে। সামগ্রিকভাবে ওষুধ শিল্প ক্রান্তিকাল পার করছে।"
তিনি বলেন, ওষুধ খাতের উদ্যোক্তারা মনে করছেন এই দুঃসময় সাময়িক। এখন পরিস্থিতি মেনে নিতে হবে। এটা কেটে যাবে। ২০২২ সালে দেশে ওষুধের বাজার ছিল ৩২০ কোটি ডলারের। এই বাজার কমে বর্তমানে ২৬০ থেকে থেকে ২৭০ কোটি ডলারে নেমেছে। আগামীতে আবার বাজার বাড়বে।
এসময় এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি বলেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে ওষুধের বাজার ছোট হয়েছে।
তিনি বলেন, "সরকার একই বৃত্ত থেকে (কর) সংগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দেশে কর দেওয়ার মত অনেক মানুষ রয়েছে, যারা কর দিচ্ছেন না। তাদের থেকে কর সংগ্রহ করার উদ্যোগ দরকার।"
ওষুধের মূল কাঁচামাল আমদানিতে বর্তমানে ৭.৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। আর প্যাকেজিং পণ্য আমদানিতে শুল্ক ১৫.৫ শতাংশ। এগুলো কোনোভাবেই বাড়ানো ঠিক হবে না বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, হৃদরোগ, হাপানি রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ষ্প্রের জন্য এক ধরনের প্লাস্টিক আমদানি করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এই প্লাস্টিককে সাধারণ প্লাস্টিক বর্ণনা করে ১২৭ শতাংশ নিচ্ছে। কিন্তু এগুলোকে ওষুধের কাঁচামাল বিবেচনা করে শুল্কহার ১৫.৫ শতাংশ করা উচিত।
মুক্তাদির বলেন, ওষুধ রপ্তানি করতে হলে রেজিষ্ট্রেশন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশে খরচ করতে হয়। এই খরচ ৫০ হাজার থেকে ৩ লাখ ডলার পর্যন্ত হয়। এ ছাড়া, ওষুধ রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলোর বিদেশে লিয়াজোঁ অফিস ও কর্মীদের বেতন বাবদও খরচ পাঠাতে হয়। এসব অর্থ পাঠাতে বর্তমানে ৪০ শতাংশ কর দিতে হয়। ওষুধ রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে আগামী অর্থবছরের বাজেটে এই কর হার প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
ওষুধের মেধাস্বত্ত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পরে পেটেন্ট ছাড়া ওষুধ উৎপাদন করা যাবে না। মূল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান যাতে পেটেন্ট না পায়– সেজন্য সরকারের সাথে ওষুধ শিল্প সমিতি কাজ করছে। পাশাপাশি ২০২৬ সাল পর্যন্ত নতুন যেসব ওষুধ আসবে– সেগুলোর পেটেন্ট যাতে বাংলাদেশের কোম্পানি পেতে পারে সে বিষয়ে চেষ্টা চলছে।
তিনি জানান, বর্তমানে দেশে ১,৯০০ ধরনের ওষুধ তৈরি হয়। আর রপ্তানি হয় ৩০০ ধরনের ওষুধ। এরমধ্যে বেশ কিছু ওষুধের পেটেন্ট বাংলাদেশের কোম্পানি নিয়েছে। তবে সেই সংখ্যা তিনি জানাতে পারেননি। ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের প্রয়োজনীয় ওষুধের শতভাগ রেজিষ্ট্রেশন করা সম্ভব বলে মনে করেন মুক্তাদির।