১৯৫২ থেকে ২০১৯: এক নজরে ভারতের শাসনক্ষমতার পালাবদল
ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা হবে আগামীকাল মঙ্গলবার (৪ জুন)। এর আগে গত ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া সাত পর্বের এ নির্বাচন শেষ হয় গত শনিবার (১ জুন)।
নির্বাচনে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে তা নিয়ে শুরু থেকেই আলোচনা তুঙ্গে। নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত চলেছে বিভিন্ন জরিপও। তবে বেশিরভাগ জরিপেই এনডিএ জোটের বিজয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, যদি এসব জরিপের তথ্য সত্য হয়, তাহলে ২০১৯ সালের চেয়েও বেশি আসন পাবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির (৭৩) দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।
যদিও এ জরিপের তথ্য আমলে নিচ্ছে না বিরোধী দলীয় জোট 'ইন্ডিয়া'র নেতারা। বরং শেষ হাসিটা তাদেরই হবে এমন প্রত্যাশাই তাদের।
স্বাধীন ভারতে সর্বপ্রথম লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫১-৫২ সালে। এবার ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হলো অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন। শুরু থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচনগুলো কেমন ছিল, ভোটার উপস্থিতি কেমন ছিল এসব চিত্র তুলে ধরেছে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। চলুন সেগুলো জেনে নেওয়া যাক:
প্রথম সাধারণ নির্বাচন (১৯৫১-৫২)
১৯৫১-৫২ সালে চার মাসেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীন ভারতের প্রথম লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবার দেশজুড়ে লোকসভার ৪৮৯টি আসনে নির্বাচন হয়।
নির্বাচনে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস (আইএনসি) ৩৬৪টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠন করে। এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জওহরলাল নেহরু। ১৬টি আসন পেয়ে নির্বাচনে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই)।
নির্বাচনে ভারতের এক রুপির নোটের আকারের সমান ব্যালট পেপার ব্যবহার হয়েছিল।
দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন
১৯৫৭ সালে দেশজুড়ে ১৪টি রাজ্য ও ছয়টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে লোকসভার ৪৯৪টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৩৭১টি আসন পেয়ে জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস পুনরায় সরকার গঠন করে। আর ২৭টি আসন নিয়ে আবারও দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল সিপিআই।
তৃতীয় সাধারণ নির্বাচন (১৯৬২)
১৯৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর অধীনে কংগ্রেস নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ৪৯৪টি আসনের মধ্যে দলটি ৩৬১ আসনে বিজয়ী হয়ে আবারও ক্ষমতায় আসে। সিপিআই পেয়েছিল ২৯টি আসন।
নির্বাচনে মোট প্রার্থীর সংখ্যা ছিল এক হাজার ৯৮৫ জন। মোট ২১ কোটি ৬৩ লাখ ভোটারের মধ্যে ৫৫.৪৩ শতাংশ ভোটার নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন।
চতুর্থ সাধারণ নির্বাচন (১৯৬৭)
১৯৬১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে ৫২০টি আসনে চতুর্থ লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ২৮৩টি আসনে বিজয়ী হয়ে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসে কংগ্রেস।
তবে ক্ষমতায় এলেও নির্বাচনের এই ফলাফলে বেশ ধাক্কা খেয়েছিল দলটি। কারণ প্রথমবারের মতো দলটি ৩০০টিরও কম আসন পেয়েছিল।
১৯৬৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত হন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী। ১৯৬৬ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন ইন্দিরা গান্ধী।
নির্বাচনে সি রাজাগোপালাচারীর স্বতন্ত্র পার্টি ৪৪টি আসন নিয়ে লোকসভায় বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়।
পঞ্চম সাধারণ নির্বাচন (১৯৭১)
আগেরবার ৩০০টিরও কম আসন পেলেও ১৯৭১ সালে পঞ্চম সাধারণ নির্বাচনে ৩৫০টিরও বেশি আসন পায় কংগ্রেস। সেবার লোকসভার ৫১৮টি আসনের মধ্যে ৩৫২টি আসন পেয়েছিল দলটি।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৫টি আসন পেয়েছিল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) (সিপিএম)।
ষষ্ঠ সাধারণ নির্বাচন (১৯৭৭)
১৯৭১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে লোকসভার আসন বাড়িয়ে ৫৪৩টি করা হয়। ১৯৭৭ সালে ষষ্ঠ সাধারণ নির্বাচনে জনতা পার্টি (ভারতীয় লোক দল) একক বৃহত্তম দল হিসেবে ২৯৮টি আসনে জয়ী হয়।
এ নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো পরাজিত হয়ে বিরোধী দল হয় কংগ্রেস। দলটি পেয়েছিল ১৫৪টি আসন।
সেবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন মোরারজি দেশাই।
সপ্তম সাধারণ নির্বাচন (১৯৮০)
এ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ৫২৯টি আসনের মধ্যে ৩৫৩টি আসন জিতে দেশটির ক্ষমতায় ফেরে।
৪১টি আসন নিয়ে লোকসভায় বিরোধী দল হয় জনতা পার্টি (ধর্মনিরপেক্ষ)।
অষ্টম সাধারণ নির্বাচন (১৯৮৪)
ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর কংগ্রেসের প্রতি মানুষের ব্যাপক সহানুভূতি তৈরি হয়। যার প্রতিফলন দেখা যায় অষ্টম সাধারণ নির্বাচনে। সেবার রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস ৫১৪টি আসনের মধ্যে ৪০৪টি আসনে জয়লাভ করে।
এই প্রথম এবং একমাত্র রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস লোকসভায় ৪০০টিরও বেশি আসন পায়। লোকসভায় সেবার বিরোধী দল হয় তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি)। দলটি ৩০টি আসন পেয়েছিল।
নবম সাধারণ নির্বাচন (১৯৮৯)
এ নির্বাচনে রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস একক বৃহত্তম দল হিসেবে ১৯৭টি আসন পায়। তবে স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সেবারই প্রথমবারের মতো প্রতিটি দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হয়।
সে সময় রাজীব গান্ধী সরকার গঠনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার পর জনতা দলের নেতৃত্বে একটি ন্যাশনাল ফ্রন্ট জোট ক্ষমতা গ্রহণ করে। জনতা দল ১৪৩টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল।
সেবার জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং।
দশম সাধারণ নির্বাচন (১৯৯১)
দশম সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস ৫২১টি আসনের মধ্যে ২৩২টি আসনে জয় পায়। ১২০টি আসন পেয়ে লোকসভায় বিরোধী দল হয় বিজেপি।
এ নির্বাচনের কয়েক দিন আগে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন রাজীব গান্ধী।
সেবার জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সেবার শপথ নেন পিভি নরশিমা রাও।
একাদশ সাধারণ নির্বাচন (১৯৯৬)
অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি একাদশ সাধারণ নির্বাচনে ১৬১টি আসন জিতে নিম্নকক্ষের (লোকসভা) বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। সেবার ১৪০টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ছিল কংগ্রেস। স্বাধীনতার পর সেবারই প্রথম কংগ্রেস এত কম আসন পায়।
অটল বিহারী বাজপেয়ীর অধীনে বিজেপি মাত্র ১৩ দিনের জন্য সরকার গঠন করেছিল।
দ্বাদশ সাধারণ নির্বাচন (১৯৯৮)
এবারও ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ১৮২টি আসন জিতে ভারতীয় জনতা পার্টি লোকসভার বৃহত্তম দলে পরিণত হয়। কংগ্রেস পায় ১৪১টি আসন।
এ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো লোকসভার ১৬টি আসনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার হয়েছিল।
ত্রয়োদশ সাধারণ নির্বাচন (১৯৯৯)
অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি আবারও ১৮২টি আসন জিতে নিম্নকক্ষে বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। ১১৪টি আসন পেয়ে বিরোধী দল হয় কংগ্রেস। এনডিএ জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন অটল বিহারী বাজপেয়ী।
চতুর্দশ সাধারণ নির্বাচন (২০০৪)
চতুর্দশ সংসদ নির্বাচনে সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস ১৪৫টি আসন জিতে ইউপিএ জোটের অধীনে সরকার গঠন করে। ভারতের ১৩তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ড. মনমোহন সিং। ১৩৮টি আসন পেয়ে লোকসভায় বিরোধী দল হয় বিজেপি।
পঞ্চদশ সাধারণ নির্বাচন (২০০৯)
৫৪৩টি আসনের মধ্যে একক বৃহত্তম দল হিসেবে এ নির্বাচনে ২০৬টি আসন পায় কংগ্রেস। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে বিজেপি ১১৬টি আসন পায়।
ষোড়শ সাধারণ নির্বাচন (২০১৪)
নরেন্দ্র মোদির অধীনে বিজেপি লোকসভার ২৮২টি আসন জেতে। ১৯৮৪ সালের পর এই প্রথম কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কংগ্রেস পায় মাত্র ৪৪টি আসন।
সপ্তদশ সাধারণ নির্বাচন (২০১৯)
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি আবারও ৩০৩টি আসন জিতে আবারও ক্ষমতায় আসে। ৫২ আসন নিয়ে কংগ্রেস হয় বিরোধী দল।
এ নির্বাচনে আগের যেকোনো বারের চেয়ে ভোটার উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি, ৬৭ শতাংশ।
অষ্টাদশ নির্বাচনে এবার কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে চলেছে, কোন দল বা জোটের হাতে যাচ্ছে ভারতের শাসনভার, সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্যই এখন সবার অপেক্ষা।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক