লাস্ট অব আসের সেই ‘জম্বি’ ছত্রাক সত্যিই আছে, এবং সবচেয়ে দামি
২০১৩ সালে রিলিজের পরপরই গেমারদের মধ্যে তুমুল সাড়া ফেলেছিল লাস্ট অব আস। গেমটির কাহিনি-নির্ভর একটি টিভি সিরিজ ২০২৩ সালে প্রচার করেছে এইচবিও। এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে বিশেষ এক ধরনের ছত্রাককে ঘিরে। যেটি জীবদেহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পরিণত করে জম্বিতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই ছত্রাক মানবদেহকে আক্রান্ত করার সক্ষমতাও অর্জন করে। রাতারাতি পৃথিবীতে দেখা দেয় এক জম্বি এপোক্লিপস। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় চিরচেনা বিশ্ব। যারমধ্যেও বেঁচে থাকে কতিপয় মানুষ। তাদের টিকে থাকার লড়াই নিয়ে এগিয়ে যায় লাস্ট অব আসের কাহিনি।
কিন্তু, কাল্পনিক নয়, এই ছত্রাক কিন্তু সত্যিই আছে। আর তা পাওয়া যায় সুদূর তিব্বতে। অবশ্য মানুষ নয়, ভর করে পতঙ্গের দেহে।
তিব্বতীয় মালভূমির সুউচ্চ পরিবেশে জন্মায় এ ছত্রাক, যার বৈজ্ঞানিক নাম ওফিওকর্ডিসেপস সিনেনসিস বা ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস। অতি-বিরল হওয়ায় এর বাজারদরও চড়া, এমনকী স্বর্ণের চেয়েও বেশি।
স্থানীয় তিব্বতীয়দের অনেকে এই ছত্রাক সংগ্রহ করে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে। মা বেং নামের যুবক তাদেরই একজন। মুখে মাস্ক পড়ে মাটিতে বসা অবস্থায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন পাহাড় ছেয়ে রাখা বাদামি ঘাস। সাথে তাঁর বন্ধু ও পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন, তাঁরা পেছনে পেছনে আসছিলেন একইভাবে প্রতিটি ঘাসের গুচ্ছ আর ঝোপঝাড়ে সতর্ক দৃষ্টি রেখে।
সাগরপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ৪০০ ফুট বা এভারেস্ট বেজ ক্যাম্পের প্রায় কাছাকাছি উচ্চতায় তাঁদের অনুসন্ধান চলছিল। এত উঁচুতে বাতাসে অক্সিজেন খুবই সামান্য, পর্বতারোহীদের কথা বাদ দিলে– সমতলের আর পাঁচটা মানুষকে তা অনায়সে কাবুও করে ফেলে। তিব্বতীয়রা অবশ্য তাতে অভ্যস্ত। ফলে কারো মধ্যেই অক্সিজেন ঘাটতি জনিত কোনো সমস্যা দেখা যাচ্ছিল না।
অনায়সেই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলতে বলতে এগোচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু, সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখছিলেন মাটির দিকে।
কিছু সময় এভাবে কেটে যাওয়ার পরে– হঠাৎই উত্তেজিত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন দলের একজন। তিনি ঘাসগুচ্ছের কোণায় দেখতে পেয়েছেন কাঙ্ক্ষিত মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাসের একটি শিরা। দেখতে চারপাশের বাদামি ঘাসের থেকে সামান্যই মোটা। এজন্যই প্রতি ইঞ্চি পাহাড়ি ভূমি খুঁটিয়ে দেখে শনাক্ত করতে হয় ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাস।
এবার ফাঙ্গাসের শিরার চারপাশের মাটি খুব সাবধানে খুঁড়তে থাকলেন, অন্যরাও জড়ো হলেন দেখতে। একজন তো ঘটনাটি লাইভস্ট্রিম করতে থাকলেন ডোউইনে (টিকটকের চীনা সংস্করণ)। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ পরে মাটি থেকে মুক্ত করতে পারলেন ইস্পিত বস্তুটি। মৃত একটি ছোট্ট ক্যাটারপিলার বা শুঁয়োপোকা, যার মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে ফাঙ্গাসের লাল রঙা শিরা বা মূল।
এরপরে তামাকের একটি টিনের কৌটা খুলে, সেটিকে প্লাস্টিকে মুড়িয়ে খুবই যত্ন করে ভেতরে রাখা হলো। কাজটা শেষ হতেই আবার সবাই ফিরে গেল ফাঙ্গাস খোঁজার কাজে।
কর্ডিওসেপস বা ক্যাটারপিলার ফাঙ্গাসের তিব্বতীয় নাম হলো ইয়ার্তসা গুনবু, যার আক্ষরিক অনুবাদ হচ্ছে - "শীতে পোকা, গ্রীষ্মে ঘাস।" বৈজ্ঞানিক বিচারে এ নামকরণ হয়তো নির্ভুল নয়, কিন্তু এতে রয়েছে ছত্রাকটির জটিল বাস্তুতন্ত্র বা জৈবিক সম্পর্কের ধারণা।
অন্য জীবের সাথে এই জৈবিক সম্পর্কের সূচনা হয় মাটির তলে। গোস্ট মথ নামের প্রজাপতির একটি প্রজাতির লার্ভা প্রজাপতিতে রুপান্তরিত হওয়ার আগে শুঁয়োপোকা আকারে থাকে। এই শুঁয়োপোকা যদি কর্ডিসেপস বীজ বা স্পোর দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখনই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। এটিকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে নিতে থাকে ছত্রাক। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ছত্রাকটি তখন শুঁয়োপোকার নার্ভাস সিস্টেম বা স্নায়ুতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এই পরজীবী শুঁয়োপোকাকে মাটি খুঁড়ে উপরের দিকে উঠতে বাধ্য করে। কিন্তু, পুরোপুরি মাটির উপরে উঠে আসার আগেই সেটিকে মেরে ফেলে। এরপর শীতের পুরো সময়টা সুপ্তাবস্থায় থাকে ওফিওকর্ডিসেপস। জেগে ওঠে বসন্ত এলেই তখন শুয়োপোকার দেহের ভেতরের পুষ্টি উপাদান শুষে নিয়ে মাটি ফুঁড়ে উপরে উঠে আসে ফাঙ্গাসের শিরা।
তিব্বতে বহু শতাব্দী ধরে ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে ওফিওকর্ডিসেপস। কিন্তু, গত তিন দশকে চীনের বাজারে এর চাহিদা ফুলেফেঁপে উঠেছে বিপুল গতিতে। যার দরুণ দামও চড়া হয়েছে দিনকে দিন। ১৯৭০ এর দশক থেকে এক কেজি উচ্চ মানের কর্ডিসেপসের দাম বেড়েছে ৪০ হাজার গুণ! বর্তমানে কেজিপ্রতি দর হলো অবিশ্বাস্য ১ লাখ ১০ হাজার মার্কিন ডলার।
উচ্চ এই বাজারমূল্যের কারণেই প্রতিবছর শীতের শেষে হিমালয় পর্বতমালার সীমানায় ছুটে আসে শত শত ছত্রাক সংগ্রহকারী। বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার পরেও তিব্বত ঐতিহাসিকভাবেই এশিয়ার অন্যতম দরিদ্র একটি অঞ্চল। তাই এ আয়ের সম্ভাবনা খুবই গুরুত্বপূর্ণও বটে। এক মৌসুমে মাত্র কয়েকগ্রাম কর্ডিসেপস জোটাতে পারলেই- পুরো বছরের আয়ের সমান রোজগার হয়ে যায়।
তবে বাইরের মানুষজনকে এই ছত্রাক আহরণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। এটা পায় শুধু তিব্বতের হিমালয় উপত্যকার স্থায়ী অধিবাসীরা। সংগ্রহের অনুমতি দিতে যতই কড়াকড়ি থাক, দিনকে দিন কর্ডিসেপসের সংখ্যা কমে আসছে। আর এটা সংগ্রহকারীদের সকলেই লক্ষ করছেন। প্রতিবছরই আগের বছরের চেয়ে কম মিলছে ছত্রাকটি।
স্থানীয় মানুষ ও বিজ্ঞানীদের ধারনা, অতি-আহরণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেই এমনটা হচ্ছে। তাছাড়া, কর্ডিসেপস সংগ্রহে নানাবিধ নিয়মনীতি থাকলেও টেকসইভাবে আহরণের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা নেই। একইসাথে ছত্রাকের নতুন অঙ্কুরিত শিরার দরকার নির্দিষ্ট মাত্রার তাপমাত্রা, জলীয়বাস্পের উপস্থিতি ও তুষার আচ্ছাদন। পরিবেশগত এসব অবস্থাও আর আগের মতোন নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘটছে যার তারতম্য। ফলে পাহাড়ের নিচের দিকে ঢালে এখন আর পাওয়াই যায় না এই ফাঙ্গাস। আগে যেখানে এটি বিপুল পরিমাণে দেখা যেত।
পৃথিবীর সবচেয়ে দামি ছত্রাক
সংগ্রহস্থল থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরের ইউশু শহরে কর্ডিওসেপসের বড় বাজার বসে। সকাল তখনো ৮টা বাজেনি, কিন্তু বাজারে দেখা যায় তুমুল হাঁকডাক আর কর্মব্যস্ততা। তোয়ালেতে হাত ঢেকে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে চলছিল দর ডাকাডাকি, উপস্থিত সবাই ব্যস্ত এই নিলামে অংশ নিতে। দোকান-ভেদে দামও একেকরকম।
মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা কর্ডিওসেপস সংগ্রহকদের থেকে প্রায় ৫ ডলার দরে কিনে নিয়ে আসে ইউশুর এই বাজারে। এরপর বিক্রি করে বাজারের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের দোকানগুলোয়।
আর মৌসুমের সর্বোচ্চ সময়ে একজন কর্ডিওসেপসের দালাল দিনে ১,৫০০ পাউন্ডের বেশি পণ্য কিনে থাকে। কখনো এ পরিমাণে কিনতে খরচ হয়ে যায় লাখখানেক ডলার। অবশ্য সেটা পুষিয়ে যায় মুনাফায়। প্রতিকেজিতে ১০ থেকে ২০ শতাংশ মুনাফা রাখতে পারে তাঁরা।
বাজারে আসার পর কর্ডিওসেপস পরিষ্কার ও বাছাইয়ের কাজ চলে। মান অনুযায়ী বাছাইয়ের ভরা হয় ভ্যাকুয়াম-সিল করা প্লাস্টিক ব্যাগে। বাজারে আসার দিন সন্ধ্যা বা বিকেলেই চালানগুলো পাঠানো হয় পরবর্তী পর্যায়ের ক্রেতাদের কাছে।
এই প্রক্রিয়ায় চীনের বেইজিং, সাংহাইসহ অন্যান্য প্রধান প্রধান শহরের দামি বিপণীগুলোয় পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাম আরো দ্বিগুণ হয়ে যায়। ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানের চেয়ে কর্ডিওসেপস পাওয়া যায় বেশি বিলাসবহুল শপিং মলগুলোর বিপণীতে। চীনের অভিজাত ধনীদের কাছে এর কদর ব্যাপক। কারো সুনজরে আসতে বা ব্যবসায়ীক আনুকূল্যের জন্য তাঁকে কর্ডিওসেপস উপহার দেওয়ার চল রয়েছে। বহুমূল্য পার্টি গিফট হিসেবেও দেওয়া হয় প্রায়ই।
বেইজিংয়ের ওয়াং ফু জিং এলাকার এক বিক্রেতা বলেন, মূলত সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য ধনীরা এটি কেনেন, স্বাস্থ্যগত কোনো সুফলের জন্য নয়। কর্ডিওসেপস উপহার দেওয়া হয় রত্মখচিত মূল্যবান বাক্সে ভরে। ওই বিক্রেতার পেছনেই কাঁচের তাঁকে কর্ডিওসেপস ভর্তি এমন বাক্স থরে থরে সাজানো ছিল।
শুধু চীনেই নয়, পশ্চিমা বিশ্বেও বিকল্প ঐতিহ্যবাহী ওষুধের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। এর ফলে আগামীতে কর্ডিওসেপসের দাম আরো চড়া হবে।