করোনাভাইরাস কখনই পুরোপুরি যাবে না!
করোনা গোত্রের নতুন যে ভাইরাসটি কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ি, ইতোমধ্যেই তা বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের ২ কোটি মানুষকে আক্রান্ত করেছে। এর আগে যেখানে ভাইরাসটির উপস্থিতি ছিল না, এমন দেশেও তা ছড়িয়েছে। আবার যেসব দেশে ইতোপূর্বে এর উপস্থিতি ধরা পড়েছিল- সেখানে সংক্রমণ বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে।
মহামারি বর্তমানে যে অবস্থায় পৌঁছে গেছে, ভাইরাসের বিস্তার নির্দিষ্ট একটি দেশে সীমাবদ্ধ রাখার সময় আর সুযোগের সবটাই সম্ভবত আমরা হারিয়েছি। এ অবস্থায় ভাইরাসটির হুমকি যে কখনই আর দূর হবে না; ভবিষ্যতের এমন একটি চিত্র পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন।
যে কারণে এমন হুমকি তৈরি হয়েছে তার অন্যতম কারণ হল; ইতোমধ্যেই নতুন জীবাণুটির ব্যাপক বিস্তার এবং সহজে সংক্রমণ ছড়ানোর সক্ষমতা।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, একটা পর্যায়ে এসে বিপুল সংখ্যক মানুষের দেহে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (অ্যান্টিবডি) তৈরি হওয়া এবং ভ্যাকসিন প্রয়োগের সুবাদে বিশ্বমারি থামবে বটে- কিন্তু তারপরও এটি সীমিত আকারে ছড়াতেই থাকবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন সংক্রমণ ধরা পড়ার ঘটনা বাড়বে আবার স্থিতিশীল হবে। কিছু কিছু স্থানে মাঝেমধ্যেই এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাবে। বহুল প্রত্যাশিত ভ্যাকসিন আসার পরও- সেগুলো সম্পূর্ণরূপে ভাইরাসটিকে নির্মূলে সক্ষম হবে না, এমন আশঙ্কাই করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাটি অমূলক তো নয়ই, বরং দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়; মানবদেহে নানা প্রকার রোগের জন্ম দেয় এমন জীবাণু প্রতিরোধে বাজারে ভ্যাকসিন থাকা স্বত্বেও- কেবলমাত্র গুটিবসন্ত নির্মূলেই সফলতা এসেছে। ১৫ বছর ধরে পরিচালিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় এ সফলতা আসে। অতীত ভ্যাকসিন সাফল্যের আলোকেই বলা যায়, নতুন করোনাভাইরাস জনিত ব্যাধিটির হুমকি সঙ্গে করেই অনেকের জীবনকাল কেটে যাবে- এমন পূর্বাভাস খুবই বাস্তব।
বছরের শুরুতেও সার্স কোভ-২ নামক কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ি ভাইরাসটিকে প্রতিরোধের ব্যাপারে খুবই আশাবাদী ছিলেন নানা দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ। এর কারণ, ইতোপূর্বে সার্স ভাইরাসের প্রথম সংস্করণ খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। ২০০২ সালের শেষদিকে হানা দেওয়া সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হন মাত্র ৮ হাজার জন। কিন্তু, পরিবর্তীকালে এর সংক্রমণ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়; আক্রান্ত রোগীদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার উদ্যোগ, সংক্রমণ উৎস শনাক্তকরণ এবং কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে। সামগ্রিক প্রচেষ্টায় ২০০৪ সালের দিকেই ভাইরাসটি মানবদেহে সংক্রমণ ছড়ানোর সুযোগ না পেয়ে দূর হয়।
তবে সার্স এবং সার্স কোভ-২ (নতুন করোনাভাইরাস) একই জীবাণুর এ দুটি সংস্করণ হলেও একে-অপর থেকে নানাদিক থেকে ব্যতিক্রমী। নতুন ভাইরাসটি সহজে যেমন বিস্তার লাভ করে- ঠিক তেমনি, অনেক সময় কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তিরাও বুঝতে পারেন না যে- তারা আসলে এর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন।
এ ব্যাপারে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ স্টিফেন মোর্স বলেন, ''সার্স মোকাবিলায় সফল হয়ে আমরা যে বিজয় উদযাপন করেছি, এক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা খুবই কম মনে হচ্ছে।''
অদৃশ্য জীবাণুর বিরুদ্ধে যদি বিজয় না আসে, তাহলে কোভিড-১৯ রোগ নিয়ে মানবজাতির ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে?- এমন প্রশ্নের উত্তর দেন হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ গবেষক জনাথন গ্রাড। তার মতে, সফলতা আসবে কিনা- পরিবর্তিত পরিস্থিতির উপর তা অনেকটা নির্ভর করবে।
গ্রাড এবং তার সহকর্মী গবেষকরা চলমান মহামারির গতি-প্রকৃতি বিষয়ক বেশকিছু মডেল তৈরি করেছেন।
তিনি জানান, ''ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (অ্যান্টিবডি) যদি মাত্র কয়েকমাস স্থায়ী হয়, তবে প্রতি বছরই সীমিত আকারে কিছু প্রাদুর্ভাব দেখা দেবে। তারপরই আসবে বড় পরিসরের মহামারি। আর যদি অ্যান্টিবডি দুই বছরের মতো দীর্ঘসময় স্থায়ী হয়, তাহলে তৃতীয় বছরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাবে।''
অর্থাৎ, ব্যাপক সংক্রামক বৈশিষ্ট্যর কারণেই সার্স কোভ-২ মানবজাতির জন্য সুপ্ত হুমকি হিসেবে থেকে যাচ্ছে।
সবচেয়ে বড় কথা, এর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া দেহের অ্যান্টিবডি কতদিন স্থায়ী হয়, তা এখনও সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা করোনাগোত্রের অন্য ভাইরাসের অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব সম্পর্কে জানেন। ওই সব তথ্য বিশ্লেষণ করেই তা থেকে কোভিড-১৯ পূর্বাভাস মডেল তৈরি করেন হাভার্ড বিশেষজ্ঞরা।
জনাথন গ্রাড জানান, ''অ্যান্টিবডির উপস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী হলে পূর্ব প্রস্তুতির নানা আয়োজনের মধ্যে দিয়ে এর সংক্রমণ সীমিত রাখার সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু, স্বল্পস্থায়ী হলেই দেখা যাবে বিপরীত অবস্থা। এ অবস্থায় কবে নাগাদ মহামারি সৃষ্টিকারী জীবাণুটি সম্পূর্ণ নির্মূল করা যাবে- এমন পূর্বানুমান করাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।''
- সূত্র: দ্য আটলান্টিক