মতিউর রহমান, তার স্ত্রীরা–সন্তানেরা কোথায়?
তার মোবাইলে কল যেতে থাকে, কিন্তু তিনি ধরেন না। হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইল অনুযায়ী, তিনি অ্যাপ্লিকেশনটি শেষ ব্যবহার করেছেন সোমবার (২৪ জুন) দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক সদস্য মতিউর রহমান বর্তমানে কোথায় আছেন, তা কেউ জানেন না।
আগারগাঁওয়ে এনবিআর সদর দপ্তরের কর্মকর্তাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা — মতিউর রহমান পালিয়েছেন। তিনি দেশ ছেড়েছেন বলে মনে করছেন তারা।
দ্বিতীয়পক্ষের সন্তান ১৫ লাখ টাকা খরচ করে একটি ছাগল কেনার পরে দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন মতিউর রহমান। কিন্তু দেখা গেল, তার বিপুল পরিমাণ গোপন সম্পদের কেবল একটি কণামাত্র ১৫ লাখ টাকার ওই অজ।
৪ জুন তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে দেখা যায়, পুবাইলে মতিউর রহমানের নামে ৫৫ বিঘা জমি, একটি পার্ক, আরও ৩০০ বিঘা জমি, একটি জুতার কারখানা, দামি গাড়ি এবং তার বা তার আত্মীয়স্বজনের নামে বাড়ি রয়েছে।
এর আগে আজ সোমবার ঢাকার একটি আদালত মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী এবং তাদের সন্তানের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
এদিন মতিউরকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের পরিচালক পদ থেকে অপসারণের জন্য সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠিও দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এর আগে তাকে এনবিআর কাস্টমস, এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছিল। এনবিআরের কোনো ট্রাইব্যুনাল প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এ প্রথম এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
মতিউরকে এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে (আইআরডি) সংযুক্ত করা হয়। কিন্তু নতুন কর্মস্থলে তাকে কোনো নির্দিষ্ট পদবি দেওয়া হয়নি, অর্থাৎ তিনি বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হন।
এদিকে মতিউরও তার নতুন কর্মস্থলেও উপস্থিত হননি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে কথা বলার সময় আইআরডি'র যুগ্মসচিব মোহাম্মদ আব্দুল গফুর অবশ্য বলেছেন, 'তার [মতিউর] নতুন পদে যোগদানের কাগজপত্র আমার পাওয়ার কথা, তবে সেগুলো এখনও আমার হাতে আসেনি।'
গত ১৮ জুন শেষ হওয়া ঈদের ছুটির পরও মতিউর রহমান তার অফিসে যাননি।
যোগাযোগ করা হলে মতিউরের অবস্থান সম্পর্কে কিছু জানাতে পারেননি পুলিশ কর্মকর্তারাও। মতিউর দেশ ছেড়ে গেলেও তিনি কোনো আনুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার করবেন না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
মতিউর রহমানের সম্ভাব্য অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
একটি পত্রিকার খবর অনুযায়ী, তিনি আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশ ছেড়েছেন। বিষয়টি ওই পত্রিকার কাছে নিশ্চিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
একটি প্রতিবেদনে এমনকি এ-ও দাবি করা হয়েছে যে, মতিউর ধরা পড়া এড়াতে তার 'মাথা ন্যাড়া' করে ফেলেছেন। বিদেশে লোক পাচারে পারদর্শী একটি সিন্ডিকেট মতিউরকে এ পরামর্শ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তবে রাজস্ব বোর্ডের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মতিউর এখনো দেশেই আছেন।
অতীতে দুদক তার বিরুদ্ধে চারবার তদন্ত করেছিল। সেগুলোর কথা উল্লেখ করে এ কর্মকর্তা বলেন, 'তিনি এর আগে ঝামেলা কাটিয়ে উঠেছেন। সম্ভবত তিনি এবারও তা করতে পারবেন।'
পারিবারিক কড়চা
ঈদুল আজহার কয়েকদিন আগে মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান ইফাত রহমান 'কুখ্যাত' ছাগলটি কেনার পর মতিউর রহমানের বিলাসী জীবনের কথা প্রথম প্রকাশ্যে আসে।
ছাগলটি সাদিক এগ্রো থেকে কেনা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি দাবি করেছে, ছাগলটির জন্য মাত্র এক লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে।
এরপর থেকে মতিউর ও তার পরিবার সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। ছেলে ইফাত ৭০ লাখ টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছে বলেও জানা যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অনুসন্ধিৎসু ব্যবহারকারীরা তার প্রথমপক্ষে মেয়ের একটি দামি গাড়িতে চড়ার ছবিও খুঁজে বের করে।
এরপর আরও একাধিক গাড়ি, জমি, বাংলো, ঘড়ি ইত্যাদি সম্পদের হদিসও অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে।
মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, তাদের ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণবের বর্তমান অবস্থানও অজানা। তার দ্বিতীয় স্ত্রীও দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
ইফাতকে — যার কল্যাণে 'কেঁচো খুঁড়তে সাপ' — মালয়েশিয়ায় পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে, যদিও দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি।
অতীতের তদন্তে অপরাধের 'প্রমাণ মেলেনি'
এর আগে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্তকারী দুর্নীতি দমন কমিশন তাকে নিরপরাধ হিসেবে রায় দিয়েছিল।
দুদক সূত্র জানায়, গত ১৮ বছরে এ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪, ২০০৮, ২০১৩ ও ২০২১ সালে তদন্ত করা হয়।
তবে অভিযোগের কোনো সত্যতা না পাওয়ায় দুদক এসব তদন্ত বন্ধের ঘোষণা দেয়। পরে মতিউর রহমানের বিষয়ে কমিশনের তদন্ত ও পরবর্তী কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে দুদক কমিশনার জাহারুল হক বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা হয়তো তার বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পাননি।
'তবে দুদকের দিক থেকে কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে,' বলেন তিনি।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান টিবিএসকে বলেন, এখন যেহেতু তদন্ত শুরু হয়েছে, দুদক আগের অভিযোগগুলোও খতিয়ে দেখবে।