প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আপত্তির মুখে আজ সোমবার (১ জুলাই) থেকে প্রত্যয় স্কিম চালু করছে সরকার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন। সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোতে কর্মরত কর্মচারীরা এ পেনশন স্কিমের আওতায় আসবেন।
গত মার্চে প্রত্যয় স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। এর অংশ হিসেবে আজ সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সকল ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
এদিকে, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বলেছে, আজ থেকে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পেনশন স্কিম চালু করার জন্য তারা প্রস্তুত।
দেশের সন নাগরিককে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনার লক্ষ্যে গত বছরের আগস্টে বেসরকারি খাতের জন্য চারটি স্কিম চালু করে সরকার।
প্রবাসীদের জন্য প্রবাস, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য প্রগতি, স্বকর্ম ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতদের জন্য সুরক্ষা এবং স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের জন্য সমতা স্কিম চালু করা হয়।
এরপর গত ১৩ মার্চ স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রত্যয় স্কিম যুক্ত করে সরকার জানায়, এসব প্রতিষ্ঠানে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে যারা যোগদান করবেন, তারা সবাই বাধ্যতামূলকভাবে এই স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন। তবে ২০২৪ সালের ১ জুলাইয়ের আগে এসব প্রতিষ্ঠানে যারা যোগদান করেছেন, তারা আগের মতোই পেনশন সুবিধা পাবেন।
নতুন বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদেরও সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় আনার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে যারা সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাবেন, তারাও বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাদের জন্য যে স্কিম চালু করা হবে, তার নাম 'সেবক'। নতুন এই স্কিমে কোন ধরনের সুবিধা থাকবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
প্রত্যয় স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এর বিরোধিতা করে এই স্কিম বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদেরও সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেওয়ার পর তারা সেবক স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা বলছেন। শিক্ষকরা মনে করছেন, প্রত্যয়ের তুলনায় সেবক স্কিমে বাড়তি সুবিধা থাকবে।
প্রত্যয় স্কিম বাতিলের দাবিতে ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারের কাছ থেকে কোন সাড়া না পাওয়ায় সোমবার থেকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষক সমিতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বলছে, প্রত্যয় স্কিম শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
সংগঠনটি বলছে, বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থায় যেসব সুবিধা রয়েছে, প্রত্যয় স্কিমে আর্থিক সুবিধা তার চেয়েও অনেক কম। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ও পুরাতন শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হবে, যা শিক্ষকদের আত্মমর্যাদার জন্য হানিকর। এতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না এবং শিক্ষার মানের অবনতি হবে।
তারা আরও বলছেন, প্রত্যয় ও সেবক নামে দুটি পৃথক স্কিম চালুর মাধ্যমে সরকারি চাকরিজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করে এক বছর পরে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সেবক স্কিম চালু করা হচ্ছে। সরকার যদি দুই স্কিমে কোনো বৈষম্য করতে না চায়, তাহলে শিক্ষকদেরও সেবক স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. নিজামুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পেনশন সুবিধা পেতে এখন শিক্ষকদের মাসে মাসে বেতন থেকে কোনো টাকা দিতে হয় না। প্রত্যয় স্কিম চালু হলে মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা করে জমা দিতে হবে।
তিনি বলেন, 'এখন একজন শিক্ষক অবসরে যাওয়ার সময় এককালীন ৮০-৮১ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত হলে এই সুবিধা থাকবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন পেনশনার মারা গেলে তার স্ত্রী বা স্বামী আজীবন এবং তারা মারা গেলে সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মাসিক পেনশন পান, যা প্রত্যয় স্কিমে থাকছে না। পেনশনার ৭৫ বছর বয়সে মারা গেলে তার পরিবার কোনো সুবিধা পাবে না। বিদ্যমান সুবিধায় পেনশনার আরও অনেক ধরনের ভাতা পান, যা প্রত্যয় স্কিমে নেই।'
দাবি আদায়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করা কতটা যৌক্তিক—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'প্রত্যয় স্কিম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আত্মমর্যাদার জন্য হানিকর। আমাদের যদি আত্মমর্যাদাই না থাকে, তাহলে কীভাবে ক্লাসে যাব?
'সরকার এই স্কিম চালুর আগে শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করেনি। আমাদের মর্যাদা রক্ষার জন্য ক্লাস বর্জন করছি। দাবি আদায়ের পর অতিরিক্ত ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।'
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা টিবিএসকে বলেন, '১ জুলাই থেকে বাস্তবায়নের জন্য আমরা আমাদের সিস্টেমে প্রত্যয় স্কিম অন্তর্ভুক্ত করেছি। এখন থেকে যারা এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পাবেন, তারা সরকারের এ সিদ্ধান্ত মেনেই চাকরিতে ঢুকবেন।'
এদিকে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, 'এই সিদ্ধান্ত নীতিনির্ধারণের অংশ, তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটি পরিবর্তন বা এর পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিষয়টি ভবিষ্যতে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।'
কী আছে প্রত্যয় স্কিমে?
যেসব প্রতিষ্ঠানে পেনশন চালু নেই, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কনট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর আওতায় চাকরিজীবী তার মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮.৩৩ শতাংশ দিয়ে থাকে।
প্রত্যয় স্কিমের আওতায়, প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫০০০ টাকা তার বেতন থেকে কেটে নেবে এবং সমপরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠান দেবে। এই উভয় অর্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্পাস অ্যাকাউন্টে জমা হবে। সিপিএফের তুলনায় প্রত্যয় স্কিমে প্রতিষ্ঠান ১.৬৭ শতাংশ বেশি অর্থ জমা দেবে।
উদাহরণস্বরূপ, প্রত্যয় স্কিমে কোনো ব্যক্তি মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে ৩০ বছর জমা দিলে ৬০ বছর বয়স থেকে তিনি মাসিক ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন। এক্ষেত্রে ৩০ বছরে ব্যক্তি ও তার প্রতিষ্ঠান প্রত্যেকে তার জন্য ৯ লাখ টাকা করে জমা দেবে। তিনি ৭৫ বছর বয়সে মারা গেলে ১৫ বছরে তিনি মোট পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখা ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা ওই চাকরিজীবীর জমার ১২.৪৭ শতাংশ।
চাকরিজীবীর বয়স ৬০ বছর পূর্ণ হলে তিনি তার অ্যাকাউন্টে জমা মূল অর্থ এবং সেখান থেকে প্রাপ্য মুনাফার আলোকে মাসিক পেনশন সুবিধা ভোগ করবেন।
অন্যান্য স্কিমের মতো প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্তরাও আজীবন পেনশন পাবেন। তবে পেনশনার ৭৫ বছর বয়সের আগে মারা গেলে তার বয়স ৭৫ না হওয়া পর্যন্ত তার নমিনি একই হারে পেনশন সুবিধা পাবেন।
সরকার বলছে, প্রত্যয় স্কিম চালুর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে না এবং তাদের পেনশন বা আনুতোষিক সুবিধা অক্ষুণ্ণ থাকবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারের ১২টি প্রতিষ্ঠান অর্থ বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই পেনশন সুবিধা ভোগ করছে। গত অর্থবছরের শুরু থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাদে বাকি ১১ প্রতিষ্ঠানের পেনশনের অর্থছাড় আটকে রাখে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে প্রত্যয় স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানগুলোর পেনশনের অর্থ ছাড় করে অর্থ বিভাগ।
২০২১-২২ অর্থবছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পেনশন বাবদ সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৮৯ কোটি টাকা।