প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর: জ্বালানি নিরাপত্তায় চীনের কাছে ১.৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ চায় সরকার
যোগাযোগ অবকাঠামোর পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে চীনের কাছে ১.৩৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ চাইছে বাংলাদেশ সরকার। এই ঋণের মাধ্যমে মহেশখালী থেকে এলএনজি পরিবহনের ২৯৫ কিলোমিটার গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করা হবে।
আগামী ৮ থেকে ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর শেষে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে।
ইতোমধ্যে ঋণের জন্য 'মহেশখালী-বাখরাবাদ থার্ড প্যারালাল গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন' প্রকল্পটি দূতাবাসের মাধ্যমে চীনের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এই প্রকল্প ছাড়াও ১৫ বিলিয়ন ডলারের ১২টি প্রকল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা হবে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে। একইসঙ্গে ১ শতাংশ নমনীয় সুদহারে ৫ বিলিয়ন ডলারে বাজেট সহায়তার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে চীনকে।
তালিকায় থাকা অন্য প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে— পিরোজপুরে চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু প্রকল্প, ভাঙ্গা-বরিশাল-কুয়াকাটা সড়ক প্রকল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্প, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সংস্কার, মিরপুরে পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প, মেট্রো রেল লাইন-২ এবং গ্রামীণ সড়কে উচ্চ প্রযুক্তির সেতু নির্মাণ প্রকল্প ইত্যাদি।
সমস্ত তালিকাভুক্ত প্রকল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এগুলো বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে উল্লেখ করে ঢাকায় চীনা দূতাবাসকে চিঠি দিয়েছে ইআরডি। একই চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে, আসন্ন উচ্চ-পর্যায়ের সফরের (প্রধানমন্ত্রীর সফর) সময় যেন একটি যৌথ বিবৃতিতে এই প্রকল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
মহেশখালীতে এলএনজি পাইপলাইন প্রকল্প
গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের তথ্যমতে, প্রস্তাবিত ২৯৫ কিলোমিটার মহেশখালী-বাখরাবাদ পাইপলাইন নির্মাণের কাজ আগামী ২০২৯ সালের মধ্যে শেষ হবে। এটি নির্মিত হলে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা এবং শিল্প ও বাণিজ্যিক ইউনিটে দৈনিক অতিরিক্ত ১,৮০০ মিলিয়ন স্ট্যান্ডার্ড ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, এ বছর এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে এবং আগামী ২০২৯ সালের মধ্যে এটি শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে।
জানুয়ারির শুরুতে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার টিবিএসকে বলেছিলেন, প্রস্তাবিত পাইপলাইনটি আমদানি করা এলএনজি প্রস্তাবিত ল্যান্ড-ভিত্তিক টার্মিনালের মাধ্যমে সরাসরি ঢাকায় পৌঁছে দেবে।
চেয়ারম্যান আরও বলেছিলেন, মূলত চট্টগ্রামের আনোয়ারা থেকে অতিরিক্ত দূরত্বে গ্যাস সরবরাহের জন্য নতুন পাইপলাইনটি নির্মাণ করা হবে।
"বিদ্যমান পাইপলাইনগুলো বাখরাবাদে এলএনজি সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত নয়," যোগ করেন তিনি।
২০৩১-৩২ সালের মধ্যে মাতারবাড়িতে একটি ল্যান্ড-ভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের পরিকল্পনাসহ, মহেশখালী থেকে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক ৩,৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পৌঁছানোর আশা করা হচ্ছে। এছাড়া, বঙ্গোপসাগরে সম্ভাব্য গ্যাস আবিষ্কারের প্রত্যাশাও রয়েছে।
এদিকে বুধবার (৩ জুন) এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফর প্রসঙ্গে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে জ্বালানি বিভাগ থেকে দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ চায় এসব প্রস্তাবে চীন অর্থায়ন করুক।
"তবে এগুলো এখনও চূড়ান্ত নয়। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঠিক করবে, কোন কোন প্রস্তাব নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা করা হবে," যোগ করেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, "মহেশখালী থেকে একটি গ্যাস সঞ্চালন লাইন করার পরিকল্পনা রয়েছে। জ্বালানি বিভাগ জি-টু-জি ভিত্তিতে এই সঞ্চালন লাইন স্থাপনে চীনের অর্থায়ন চায়। ইতোমধ্যে মহেশখালীতে দুটি ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) করা হয়েছে। আরও দুটি এফএসআরইউ করা হবে। এসব ক্ষেত্রে চীনের অর্থায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে।"
নসরুল হামিদ জানান, সরকারের লক্ষ্য হলো ২০২৭ সাল থেকে গ্যাস নিয়ে দেশে যেনো কোনো সংকট না থাকে— সে ব্যবস্থা করা। এরজন্য ৪৬টি গ্যাস কুপ খনন করা হচ্ছে। আরও ১০০টি গ্যাস কুপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি আরও জানান, সরকার অনশোরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে গ্যাস অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করছে। ২০২৭ সালে দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা হবে ৬০০ কোটি ঘনফুট। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা আছে।
অন্যান্য প্রকল্প
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে 'স্ট্রেথেনিং অ্যান্ড প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি কো-অপরেশন' শীর্ষক সমঝোতা স্মারক সই হয়। এখানে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের আশ্বাস রয়েছে।
যদিও এখন পর্যন্ত ৮.০৭৬ বিলিয়ন ডলারের ৯টি প্রকল্পের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বাকি প্রকল্পগুলো দ্রুত সই করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সফরে আলোচনা হতে পারে বলে জানায় ইআরডি সূত্র।
পুরনো তালিকার ৩টি প্রকল্প নতুন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পে ২২১ মিলিয়ন ডলার, ঢাকা শহরের দাশেরকান্দি এসটিপি ক্যাচমেন্টের অধীনে পয়ঃনিষ্কাশন সংগ্রহ ব্যবস্থা নির্মাণে ১৯৮ মিলিয়ন ডলার এবং নতুন ০৪ ভেসেল প্রকল্পের জন্য ২৩৬ মিলিয়ন ডলার ঋণের কথা ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে।
আলোচিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-২ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬০,৮৩৬ কোটি টাকা— যা ডলারে হিসাব করলে দাঁড়ায় ৫.২ বিলিয়ন।
ঢাকায় চীনা দূতাবাসে পাঠানো ইআরডির চিঠিতে বলা হয়েছে, মেট্রো লাইন-২ দেশে একটি আইকনিক প্রকল্প হিসাবে বিবেচিত। ফলে এখানে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশের নগর পরিবহনে অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের পাশাপাশি চীনও তার প্রযুক্তি ক্ষমতা প্রদর্শন করে নিজের পদচিহ্ন রাখার সুযোগ পাবে।
এছাড়া, ফরিদপুর-বরিশাল এবং বরিশাল-কুয়াকাটা চার লেনের সড়ক নির্মাণ প্রকল্পেও চীনের অর্থায়ন চাওয়া হতে পারে। এই প্রকল্পের আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩.০৪ বিলিয়ন ডলার।