১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ গড় মূল্যস্ফীতি ২০২৪ অর্থবছরে
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মূল্যস্ফীতি ধরে রাখতে পারেনি সরকার। দেশে–বিদেশে উভয় জায়গায় অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে পণ্য ও সেবার মূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে।
বোরবার (৭ জুলাই) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই—জুন সময়ের মধ্যে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯.৭৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে— যা ১৩ অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গত অর্থবছরে সরকার মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। পরে অবশ্য সংশোধন করে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৭.৫ শতাংশ। যদিও সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে এ অর্থবছরের মূল্যস্ফীতি।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই–জুন সময়ে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.০২ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্যমতে, মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে উঠে আসে।
২০২৫-১৬ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের কম ছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৬.১৫ শতাংশ হয়। এর আগে, ১৩ বছর পূর্বে সর্বোচ্চ ১০.৯২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি রেকর্ড করা হয়েছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, "গত দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তির দিকে। শুরুর দিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আমরা (সরকার) করিনি। মূল্যস্ফীতি নিয়িন্ত্রণে যে সমস্ত অর্থনৈতিক টুলস আছে, যেমন— মুদ্রানীতি; এটি ব্যবহার করা দরকার ছিল, তা করা হয়নি। এসব টুলস আমাদের অনেক পরে ব্যবহার করা হয়েছে। গত জুলাই থেকে মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতিতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি পদক্ষেপ তো দ্রুত প্রভাবিত করে না।"
তিনি বলেন, "আমাদের দেশে শুধুমাত্র মুদ্রানীতির ব্যবহার করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। যেখানে বাজার অব্যবস্থাপনা এতো বেশি— সেখানে শুধু মুদ্রানীতি কাজ করে না। আমাদের দেশে মার্কেট ম্যানিপুলেশন (বাজার কারসাজি), অলিগো-পলিক (একচেটিয়া) আচরণের কারণে বাজারে চাহিদা ও যোগানের মাধ্যমে মূল্য কমার স্বাভাবিক প্রবণতা বাধাগ্রস্ত করে। এর একটা উদহরণ হলো– দেশীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য যথেষ্ট সরবরাহ থাকার পরেও কৃত্রিমভাবে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়। তার মানে হচ্ছে, এখানে একটা সিন্ডিকেটের বিষয় রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমাদের আর্থিক পলিসির সঙ্গে মুদ্রানীতির একটা সমন্বয় করতে হয়। গত অর্থবছরে আর্থিক পলিসিটা সংকোচনমূলক করা হয়নি; বরং সম্প্রসারণমূলক আর্থিক পলিসি করা হয়েছে। সেখানে সরকারি ব্যয় কমেনি। সরকারের পরিচালন ব্যয়, প্রশাসনিক ব্যয় অনেক বেশিই ছিল। চলতি অর্থবছরেও সরকারের এসব ব্যয় অনেক বেশি। ওইরকম একটা পরিস্থিতিতে শুধু মুদ্রানীতি টাইট করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।"
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, "দুটি কারণে মূল্যস্ফীতির নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। একটি হলো মুদ্রাবিনিময় হার; ডলারের দাম ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা করা হয়েছে। এখানে বড় জাম্প হয়েছে। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো সুদহার; সদের হার বাড়ালেও এর প্রভাব আমরা এখানো পুরোপুরি পায়নি। মানি সাপ্লাই এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি । এসব কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য আর্জিত হয়নি।"
জুনে মূল্যস্ফীতি অতি সামান্য কমছে
বিবিএসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুনে খাদ্য ও খাদ্য বর্হিভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কমার প্রভাবে সাধারণ মূল্যস্ফীতিও সামান্য কমেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্টে ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.৭২ শতাংশ— যা এর আগের মাসে ছিল ৯.৮৯ শতাংশ।
এ সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ১০.৪২ শতাংশ— যা মে মাসে ছিল ১০.৭৬ শতাংশ। জুনে খাদ্য বর্হিভূত মূল্যস্ফীতি কমে ৯.১৫ শতাংশ হয়েছে— যা এর আগের মাসে ছিল ৯.১৯ শতাংশ।
জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, "দেরিতে নেওয়া হলেও গত ৬ থেকে ৯ মাসের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ এখন কাজ করতে শুরু করেছে। একটা হলো কন্ট্রাকশনারি মনিটারি পলিসি; বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধির লাগাম টানা এবং সুদ হারের পুরোপুরি লিবারেলাইজ করার প্রভাবে জুনে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে ধারণা করা যায়।"
তিনি বলেন, "এছাড়া, সরবরাহ ব্যবস্থায় গড় আনতে, এলওসি ওপেনিং সামন্য বেড়েছে। এর ফলে আমদানিকৃত পণ্যের সরবরাহ আগের তুলনায় সামন্য ভালো হয়েছে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এসব কারণে জুনে এসে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। কিন্তু এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি রয়ে গেছে।"
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, "এক-দেড় মাসে ডলারের মূল্য বেড়েছে। যদিও এর প্রভাব এখনো আসেনি। এর প্রভাব আমরা আরও দুই-তিন মাস পরে পাবো।"
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ পর্যায়ে জুনে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে শতকরা ৯.৮১ শতাংশ— যা মে মাসে ৯.৯৯ শতাংশে পৌঁছায়। গ্রামে জুন মাসে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১০.৩৯ শতাংশ এবং ৯.২৬ শতাংশ; মে মাসে যা ছিল যথাক্রমে শতকরা ১০.৭৩ শতাংশ ও ৯.৩১ শতাংশ।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, জুনে শহর এলাকায় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ— যা মে মাসে ছিল ৯.৭২ শতাংশ। জুনে খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি হয়েছে যথাক্রমে ১০.৫৪ শতাংশ এবং ৮.৯৮ শতাংশ— যা মে মাসে ছিল ১০.৮৬ শতাংশ এবং ৯.০৩ শতাংশ।
এদিকে, জুনে জাতীয় পর্যায়ে মজুরি হার (সাধারণ) বেড়ে হয়েছে ৭.৯৫ শতাংশ— যা মে মাসে ছিল ৭.৮৮ শতাংশ। গত ২৯ মাস ধরে মজুরি বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির নিচে চাপা পড়ে আছে।