৬ মাসে ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর ঋণ বেড়েছে আমানতের নয়গুণ
২০২৪ অর্থবছরের নভেম্বর-এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসে ইসলামী ধারার ১০ ব্যাংকে যে পরিমাণ আমানত বেড়েছে— তারচেয়ে ঋণ বেড়েছে ৯ গুণের বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ৬ মাসে আমানত বাড়িয়েছে ২,৮০৮ টাকা; এর বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে ঋণ বেড়েছে ২৫,৭৯০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের এপ্রিল শেষে এসব ব্যাংকে মোট আমানতের পরিমাণ ছিল ৩.৮৩ লাখ কোটি টাকা— যেখানে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪.৬৪ লাখ কোটি টাকা।
এই ১০ শরিয়াহ ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলো হলো— ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ব্যাংক এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংক।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসলামী ধারার শীর্ষস্থানীয় একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বলেন, "আমরা রেমিট্যান্স আয়ে বেশ ভালো অবস্থানে আছি। ইসলামী ধারার তিনটি ব্যাংক মিলেই দেশে আসা মোট রেমিট্যান্সের তিনভাগের মধ্যে একভাগ নিয়ে আসছে। তবে, আমরা লক্ষ্য অনুযায়ী ডিপোজিট সংগ্রহ করতে পারছি না।"
তিনি বলেন, "মূলত ইসলামী ধারার কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ বিতরণ নিয়ে গণমাধ্যমে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে আমাদের ডিপোজিট সংগ্রহ কমে গেছে। অনেক গ্রাহকই এখন আগের মতো ব্যাংকগুলোতে টাকা জমা করার ক্ষেত্রে আস্থা পাচ্ছেন না। তবে আমরা গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে কাজ করছি।"
ডিপোজিটের গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধি কম হলেও ঋণ বিতরণের প্রবৃদ্ধি এত বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "নতুন ঋণ খুব বেশি পাস হয়নি। তবে, অনেক ঋণ আছে যেগুলোর কিস্তি ঠিকমতো আদায় হচ্ছে না। ফলে আমাদের বকেয়া ঋণ বেড়েছে।"
আমানতের প্রবৃদ্ধি ভালো থাকলে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না বলে মন্তব্য করেন এই ব্যাংকার।
একই সময়ে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ইসলামী ব্যাংকিং শাখা আমানত সংগ্রহ করেছে ৪,৫০৭ কোটি টাকা এবং ঋণ বিতরণ করেছে ৩,৩২৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, প্রচলিত ব্যাংকের অভ্যন্তরে ইসলামী ব্যাংকিং উইন্ডোতে (বুথ নামেও পরিচিত) আমানত এবং ঋণ— উভয়ই গত ছয় মাসে হ্রাস পেয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইসলামী ধারার অনেক ব্যাংক বর্তমানে তারল্য সংকটে আছে। বেশ কয়েকটি ইসলামী ধারার ব্যাংক ঠিকমতো সিআরআর এবং এসএলআর রাখতে পারছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওই ব্যাংকগুলোর লেনদেন সচল রাখতে বিশেষ ব্যবস্থায় তারল্য সহায়তা দিতে হচ্ছে।
বাণিজ্যিক ও ইসলামী ব্যাংকগুলোকে মোট আমানতের ৪ শতাংশ সিআরআর হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। আর ইসলামী ব্যাংকগুলোকে আমানতের ৫.৫ শতাংশ এসএলআর হিসাবে নগদ অর্থ, স্বর্ণ বা অন্য কোনো সিকিউরিটিজের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়।
মূলত গ্রহককে ঋণ দেওয়ার আগে এটি ব্যাংকগুলোর একটি রিজার্ভ সংরক্ষণের ব্যবস্থা। প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১৩ শতাংশ এসএলআর রাখতে হয়।
ইসলামী ধারার অনেক ব্যাংকই এখন নিয়ম অনুযায়ী অ্যাডভান্সেস টু ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) রাখতে পারছে না মন্তব্য করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, "ব্যাংকগুলো ইতোমধ্যে লিমিটের বেশি ঋণ দিয়ে ফেলেছে। তাই, নিয়মিত কার্যক্রম চালাতে গিয়ে তারা সংকটে পড়ছে।"
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, প্রচলিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৮৭ শতাংশ এবং শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলিকে ৯২ শতাংশ এডিআর বজায় রাখতে হয়। অর্থাৎ, প্রচলিত ব্যাংকগুলো শতকরা হিসেবে প্রতি ১০০টাকা আমানতের বিপরীতে ৮৭ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে এবং শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকগুলো পারে ৯২ টাকা।
মূল্যস্ফিতির কারণে আমানত সেভাবে বাড়ছে না উল্লেখ করে আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমান আর চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমাদের অনেক গ্রাহক মূল্যস্ফীতির চাপ মেটাতে অনেক ডিপোজিট তুলে নিচ্ছেন। ডিপোজিট কমার পেছনে এটি একটি বড় কারণ।"
বকেয়া ঋণ কেন বাড়ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলোয় কোয়ার্টারলি ইন্টারেস্ট (প্রফিট) চার্জ করা হয়। নতুন করে ঋণ দেওয়া না হলেও চার্জ করা সুদ ঋণের আউটস্ট্যান্ডিং বা বকেয়াকে বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, ব্যাংকগুলো অনেক ঋণ পরিশোধে কিস্তির টাকা ঠিকমতো পাচ্ছে না।"