করোনাঘাতে বিপর্যস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্প
বাজারে বিদেশি জুতার আধিপত্যে বেশ কয়েক বছর ধরেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা শিল্পে চলছে মন্দাভাব। বাজার ধরে রাখতে কয়েকটি কারখানা আধুনিকায়ন করে এখন মেশিনে তৈরি হচ্ছে জুতা। তবুও ব্যবসা ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের।
এর মধ্যেই সম্ভাবনাময় এই শিল্পে আঘাত হানে মহামারি করোনাভাইরাস। ফলে নতুন এক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এ শিল্পে। সবকটি কারখানার উৎপাদন গড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ী ও শ্রমিক-কর্মচারীরা। এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন পাদুকা ব্যবসায়ীরা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাদুকা শিল্পের উৎপত্তি
পাদুকা শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমারশীল মোড়ে একটি পাদুকা তৈরির কারখানা গড়েন ভারতের পাটনা শহর থেকে আসা ব্যবসায়ী মাহমুদ আলী। বর্তমানে জেলার পীরবাড়ি, রাজঘর, নাটাই ও ভাটপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় প্রায় দেড়শ কারখানা রয়েছে। এ সব কারখানায় কাজ করছেন প্রায় তিন হাজার শ্রমিক।
পাদুকা ব্যবসার মৌসুম
মূলত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করেই পাদুকা ব্যবসা। এই দুই ঈদে বড় কারখানাগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করে থাকে। আর ছোট কারখানাগুলো বাজারজাত করতে পারে গড়ে ২০ লাখ টাকার।
ঈদ মৌসুমে কারখানা মালিকরা যেমন কয়েক লাখ টাকা করে মুনাফা অর্জন করেন, তেমনি বাজারের চাহিদা মেটাতে রাত-দিন কাজ করে শ্রমিকরাও বাড়তি টাকা উপার্জন করেন। এ জন্য ঈদুল ফিতরের মাস দেড়েক আগে থেকেই চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন জুতা বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুতি নেন কারখানা মালিক-শ্রমিকরা।
গুণগত মান বজায় রেখে তুলনামূলক কম দামে জুতা তৈরি করায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জুতা নিয়ে যান। প্রতি জোড়া জুতা ৬০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় পাইকারদের কাছে।
করোনাভাইরাসের প্রভাব
করোনাভাইরাসের কারণে এবারের মৌসুমে ব্যবসা করতে পারেননি কারখানা মালিকরা। সরকারি নির্দেশনায় গত ২৫ মার্চ থেকে জেলার সবকটি জুতার কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে মালিকরা যেমন আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন, তেমনি শ্রমিকরাও কাজ হারিয়ে মানবেতর দিন যাপন করেন।
অবশ্য কয়েক মাস বন্ধ রেখে গত ঈদুল আজহার আগে খোলা হয় কারখানাগুলো। তবে এবারের ঈদুল আজহাতে অতীতের তুলনায় অর্ধেকেরও কম ব্যবসা হয়েছে। বড় কারখানাগুলো গড়ে ২০ লাখ টাকা আর ছোট কারখানাগুলো গড়ে পাঁচ লাখ টাকার জুতা বাজারজাত করেছে।
করোনাভাইরাসে কমেছে উৎপাদন
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে প্রতিটি কারখানারই উৎপাদন কমেছে। ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব শুরুর আগে বড় কারখানাগুলোতে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৯০০ জোড়া জুতা উৎপাদন হতো। আর ছোট কারখানাগুলোতে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ জোড়া। তবে ঈদুল আজহার আগে কারখানা খোলার পর এখন পর্যন্ত বড় কারখানাগুলোতে দৈনিক গড়ে ৫০০ জোড়া আর ছোট কারখানাগুলোতে গড়ে ১৫০ জোড়া জুতা তৈরি করছেন শ্রমিকরা।
তবে উৎপাদন কমলেও কারখানার খরচ আগের মতোই রয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউনের কারণে কয়েক মাস কারখানা বন্ধ রাখা হলেও কারখানার ভাড়াসহ আনুষাঙ্গিক সব ব্যায় মেটাতে হয়েছে মালিকদের। এ ছাড়া স্থায়ী সব শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ করেতে হয়েছে।
বড় কারখানার ক্ষতি বেশি
করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বড় কারখানাগুলো। দুই ঈদে বড় একেকটি কারখানা অন্তত এক কোটি টাকার জুতা বিক্রি করতে পারেনি। এ ছাড়া শ্রমিকরাও এবারের মৌসুমে বাড়তি আয় থেকে বি ত হয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পীরবাড়ি এলাকার সেভেন স্টার ফুটওয়্যারের ফিটিংম্যান শফিকুল ইসলাম জানান, পাদুকা কারখানায় কাজ করেই তার সংসার চলে। প্রতি ঈদে বাড়তি কাজ করে বেতনের পাশাপাশি ১০/১৫ হাজার টাকা আয় হয়। এই টাকায় পরিবারের সদস্যদের জন্য ঈদের কেনাকাটা করেন।
কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের কারণে কারখানা বন্ধ থাকায় কষ্টে দিনানিপাত করতে হয়েছে। আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে সংসার চালিয়েছেন শফিকুল।
আরেক শ্রমিক মো. সেলিম জানান, দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকায় পরিবার নিয়ে চলতে কষ্ট হয়েছে। এখন কারখানা খুললেও আগের মতো কাজ নেই। ফলে সংসার চালাতে যে ধারদেনা করেছেন- সেগুলা এখন শোধ করতে পারছেন না।
দুই ঈদে হয়নি ব্যবসা
অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের পরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, সারা বছরের লোকসান আমরা দুই ঈদের পুষিয়ে নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসে কারণে এবার ঈদুল ফিতরে কোনো ব্যবসা করেতে পারিনি। দীর্ঘদিন বন্ধ রাখার পর ঈদুল আজহায় মাত্র ২০ লাখ টাকার জুতা বিক্রি হয়েছে।
''দুই ঈদ মিলিয়ে অন্তত এক কোটি টাকার জুতা বিক্রি করতে পারিনি। কিন্তু খরচ আগের মতোই রয়েছে। কারখানার ভাড়া-বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক-কর্মচারীরে বেতন-ভাতা সবই দিতে হচ্ছে। আর এখন কারখানা খুললেও উৎপাদন কমে গেছে। আগের তুলনায় এখন অর্ধেক উৎপাদন হচ্ছে'', বলেন আক্তার হোসেন।
সেভেন স্টার ফুটওয়্যারের পরিচালক মো. হানিফ বলেন, করোনাভাইরাসের আঘাতে আমাদের ব্যবসা অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এভাবে যদি লোকসান অব্যাহত থাকে তাহলে কারখানা চালানোই দায় হয়ে পড়বে। আর কারখানা না চালাতে পারলে শ্রমিক-কর্মচারীরাও বেকার হয়ে পড়বে।
ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন সরকারি সহায়তা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাদুকা শিল্প মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মহসিন মিয়া বলেন, আমাদের ব্যবসা এমনিতেই মন্দা। সারাবছরের লোকসান আমরা দুই ঈদের পুষিয়ে নেই। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এবার আমরা তা করতে পারিনি। ফলে সব কারখানা মালিকই আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সরকারি সহাতায়সহ সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ প্রয়োজন।
''করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে চার শতাংশ সুদ হারে ঋণ নিতে পারবেন। আমরা ৯ শতাংশ সুদ হারেই ঋণ দেবো। সেক্ষেত্রে সরকার আমাদেরকে বাকি পাঁচ শতাংশ সুদ পরিশোধ করবে'', বললেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্যাংকার্স ফোরামের সভাপতি ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক ইকবাল হোসেন ভূইয়া।