সাইপ্রাস- অপরাধী ও পলাতক দুর্নীতিবাজদের কাছে পাসপোর্ট বিক্রি করছে
৭০টির বেশি দেশের জালিয়াতিতে অভিযুক্ত তহবিল সংগ্রহকারী, মুদ্রা পাচারকারী, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক নেতা- সবাই কিনেছে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব। বিনিময়ে পেয়েছে "সোনার হরিণ" সম জাতীয়তার পরিচয়পত্র যা তাদের ইউরোপের অন্যান্য দেশে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য হওয়ার কারণেই, অপরাধী চক্রের হোতাদের ধন-সম্পদ পাচারের সুযোগ করে দিয়ে, বিনিয়োগের বিনিময়ে সাইপ্রিয়ট নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবসাও- বেশ ভালোই জমে উঠেছে।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার নিজস্ব অনুসন্ধানী দলের এক তদন্ত সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এসব অভিযোগের স্বপক্ষে বিপুল প্রমাণও পেয়েছে আল-জাজিরা। দেশটির সরকারি নথিপত্রের একটি বড় অংশ তাদের অনুসন্ধানী দলের হাতে এসেছে।
সাইপ্রাস পেপারস' শীর্ষক এসব নথির মধ্যে আছে প্রায় ১৪শ' ব্যক্তির পাসপোর্ট পেতে জমা দেওয়া আবেদন। এর সবগুলোই ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল নাগাদ অনুমোদন করে দ্বীপ রাষ্ট্রটির সরকার। বিনিয়োগের পরিবর্তে নাগরিকত্ব কার্যক্রম নিয়ে অন্ধকার দিক উঠে আসার পর- তা দেশটির এ উদ্যোগকে কঠিনভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
বিশেষ করে, যেসব দেশের নাগরিকদের উপর ইইউ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে-তাদের অনেকেই নিয়েছে সাইপ্রিয়ট পরিচয়পত্র। আর ইইউ সদস্য হওয়ায় তারা সহজেই সাইপ্রাস থেকে ইউরোপের ২৭টি দেশে অবাধে যাতায়াত বা ব্যাংকে আর্থিক লেনদেন পরিচালনার সুযোগ পাচ্ছে।
তদন্তের চলমান প্রক্রিয়ায় আল জাজিরা এমন অনেক ব্যক্তির পরিচয় জানতে পারে যারা সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব নিলেও- তা আসলে দেশটির আইন পরিপন্থী। এদের অনেকেই এমন অপরাধে জড়িত- যা ইইউ দেশগুলোর ঘোষিত নীতিমালারও বিরোধী।
নিরাপত্তা ঝুঁকি:
নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্তানুসারে আবেদনকারীর গুরুতর পূর্ব অপরাধের রেকর্ড থাকা যাবে না। সে পরীক্ষায় উৎরে গেলেই সাইপ্রাসর অভিজাত আবাসন প্রকল্পে সাড়ে ২১ লাখ ইউরো বিনিয়োগ করলেই মিলবে সাইপ্রিয়ট জাতীয়তার পাসপোর্ট।
কিন্তু, এ অপরাধ রেকর্ড যাচাইয়ের আইনেই আছে ফাঁকফোঁকর। আবেদনকারী নিজেই দেয় নিজের নিরাপরাধ চরিত্রের সনদ। সাইপ্রাসের দাবি, তারা এসব পরীক্ষা করে দেখে। কিন্তু, আল-জাজিরার হাতে আসা নথিগুলো প্রমাণ করছে, প্রায়শই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়। দেশটির প্রশাসনের কাছে অর্থই হয়ে ওঠে তখন- নাগরিকত্ব পাওয়ার মাপকাঠি।
২০১৩ সাল থেকে আবাসন খাতে বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্বের এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সাইপ্রাস। বিষয়টি নিয়ে এর আগেও সাইপ্রাসের সমালোচনা করেছে ইইউ। এমনকি তা বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে।
সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব উদ্যোগ নিয়ে শুরু থেকেই যারা সমালোচনা করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ইউরোপীয় পার্লামেন্টের জার্মান সদস্য স্ভেন গিগোল্ড। তিনি জানান, ''যেসব দেশে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের লেনদেন হয়, সে দেশগুলির প্রভাবশালীদের জন্য সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব- এক সুবর্ণ সুযোগ।''
''আপনি চাইলে (সাইপ্রাসের) ব্যাংকে হিসাব খুলতে পারবেন। শুরু করতে পারবেন ব্যবসায়িক সম্পর্ক। আর এনিয়ে খুব বেশি প্রশ্নের মুখেও পড়তে হবে না। ইউ সদস্য হওয়ায় ভিসার ঝক্কি নেই। রাশিয়া, চীন বা আরো সন্দেহজনক কোনো দেশের নাগরিক হলেও সমস্যা নেই। পুরো ইইউ স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারবেন আপনি।"
২০১৩ সাল থেকে বিনিয়োগের পরিবর্তে নাগরিকত্ব চালুর পর থেকে, এভাবে ৭শ' কোটি ইউরো কামিয়েছে সাইপ্রাস সরকার। আর দেশটির প্রায় ভঙ্গুর অর্থনীতিকে এ আয়ই এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল একটা অবস্থানে ধরে রেখেছে।
নাগরিকত্ব নিয়েছেন দুর্নীতিবাজেরা:
২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়ে রাশিয়া, চীন এবং ইউক্রেনের নাগরিকদের তরফ থেকে।
এদের মধ্যে, যাদের অনুমোদন দেওয়া হয়, এমন একজন হলেন ইউক্রেনীয় ধনকুবের এবং দেশটির বৃহৎ জ্বালানি উৎপাদক কোম্পানি বারিসমা'র মালিক মিকোলা জলোচেভস্কি।
২০১৭ সালে সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব কেনার কালে তার নামে নিজ দেশ ইউক্রেনে একটি দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছিল। চলতি বছরের জুন মাসে ইউক্রেনীয় তদন্তকারীরা জানান, অনুসন্ধান বন্ধে জলোচেভস্কি তাদের ৬০ লাখ ডলার ঘুষ দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছেন।
এসব কিছুই তিনি করতে পেরেছেন সাইপ্রাসে সুরক্ষিত থেকে। অবশ্য, জলোচেভস্কি এবং তার কোম্পানি বারিসমা উভয়েই ঘুষ প্রদানের অভিযোগের ব্যাপারে কিছুই জানতো না, বলে দাবি করে।
জলোচেভস্কি একা নন, নিজ দেশে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এমন অসংখ্য ধনী অপরাধী নিরাপদে আছে সাইপ্রিয়ট পাসপোর্টের কল্যাণে। ইউক্রেনের আইন তাকে এখানে স্পর্শও করতে পারবে না।
এমনই আরেক দুর্নীতিবাজ আবেদন করেন রাশিয়া থেকে। নাম তার নিকোলাই গরনোভস্কি। তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি কোম্পানি গ্যাজপ্রমের সাবেক প্রধান।
২০১৯ সালে সাইপ্রাস যখন তার পাসপোর্ট অনুমোদন দেয়, তখন নিজ ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে অভিযুক্ত গরনোভস্কি রাশিয়ার শীর্ষ পলাতক অপরাধীদের একজন। ইতোমধ্যেই, নানা প্রকার কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়েও তাকে সাইপ্রাস থেকে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে প্রভাবশালী দেশটি।
নাগরিকত্ব পায় সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীরাও:
আরও কিছু আবেদনপত্রের নথিতে দেখা যাচ্ছে, আবেদনকারীর নিজ দেশে অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার বা দোষী প্রমাণিত হয়ে কারাবাসের পরও, তার আবেদন মঞ্জুর করেছে সাইপ্রাস সরকার।
এদের মধ্যে সাঙ্ঘাতিক খুনী, সন্ত্রাসী, মাফিয়া অনেকেই আছে। আলি বেগলভ তাদেরই একজন। চাঁদাবাজির দায়ে জেলখাটার পরও সে পরবর্তীকালে পেয়েছে সাইপ্রাসের নাগরিক হওয়ার সবুজ সংকেত। অথচ, একজন প্রমাণিত অপরাধীকে এভাবে নিরুদ্রুপে বসবাসের সুযোগ দেওয়া, সাইপ্রাসের নিজ আইনেই সম্পূর্ণ অবৈধ।
সাজা পেয়েও সাইপ্রাসে থাকার সুযোগ পাচ্ছে, এমন আরেক চীনা অপরাধী ঝ্যাং কেকিয়াং। নিজ দেশেই এর আগে শেয়ার জালিয়াতির মামলায় জেল খেটেছিলেন তিনি।
ভিয়েতনামের আরেক ধনী ব্যবসায়ী ফাম নাহট ভু'র পাসপোর্টের আবেদন মঞ্জুর করা হয়, তিনি এক টেলিকম চুক্তি পেতে কয়েক মিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছেন- তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ ওঠার একমাস পরই। তবে অন্যদের মতো তার ভাগ্যদেবী সহায় হয়নি। সাইপ্রাসে পালাবার আগেই তাকে জেলে পুরেছে ভিয়েতনাম সরকার। তিনি এখন ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপে প্রাসাদের বাসিন্দা নন, বরং তিন বছরের সাজা খাটছেন জেলখানায়।
সাইপ্রাসের দুর্নীতি সহযোগী অবস্থান:
ভিয়েতনামের মতো সকল দেশের সরকার তো আর অপরাধীদের ধরার সুযোগ পায়নি। তার আগেই অধিকাংশরা পালিয়ে যায় সাইপ্রাসে, বা সেখান থেকে ইউরোপের অন্য দেশে।
দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক এনজিও- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের শীর্ষ নীতি বিষয়ক কর্মকর্তা লরে ব্রিল্লাউড বলেন, এ ধরনের ফলাফল উদ্বেগজনক হলেও তা মোটেও আশ্চর্যজনক নয়।
তিনি আল-জাজিরাকে জানান, ''অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দেওয়ার এ ধরনের উদ্যোগ সব সময় মুদ্রা পাচার, দুর্নীতি এবং কর ফাঁকির সহযোগী। সহজে ও দ্রুত যারা ইইউ'তে প্রবেশের পাঁয়তারা কষছে, এমন ব্যক্তিদের আকর্ষণ করতেই এ ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হয়। বৈধ সম্পদের অধিকারীরা নাগরিকত্ব নিয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু, ধনী অপরাধীদের গন্তব্য হয় সাইপ্রাসের মতো সুযোগ সন্ধানী দেশে।''