নিজেদের ‘নিয়ন্ত্রণাধীন’ ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ তুলছে কোটি টাকা, নগদ সংকটে গ্রাহক
চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপ 'নিয়ন্ত্রণাধীন' ব্যাংকগুলো থেকে নগদ টাকা উত্তোলন, পে-অর্ডার ক্লিয়ারিং ও অর্থ হস্তান্তরে সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অসংখ্য গ্রাহক।
অনেক গ্রাহক ব্যাংকে গিয়ে যে পরিমাণ টাকা তুলতে চাইছেন, তার অর্ধেকও পাচ্ছেন না বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর কাছে একাধিক অভিযোগ এসেছে।
এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণাধীন ইউনিয়ন ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলনসহ অর্থ হস্তান্তরে সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এসব গ্রাহক।
এসব ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করছেন, এ সমস্যা কেবল চট্টগ্রামের শাখাগুলোতে নয়। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ সহায়তা না পাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক এ সংকট সম্পর্কে অবহিত থাকলেও এখনো কোনো গ্রাহক আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেননি বলে জানিয়েছে।
এদিকে সাধারণ গ্রাহকেরা মাত্র কয়েক হাজার টাকা তুলতে হিমশিম খেলেও এ সংকটময় পরিস্থিতিতেও এসব ব্যাংক থেকে কয়েক কোটি টাকা তুলে নিচ্ছে এস আলম গ্রুপ।
অর্ধেক টাকাও তুলতে পারছেন না গ্রাহক
খাতুনগঞ্জের কমিশন এজেন্ট (ব্রোকার) আবু তাহের দুই হাজার টাকা তুলতে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সকালে ইউনিয়ন ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসেন।
তিনি টিবিএসকে বলেন, শাখা খোলা থাকলেও লেনদেন অনেকটা বন্ধ ছিল। 'ক্যাশ কাউন্টারে কোনো কর্মীও ছিলেন না। ব্যাংকের কর্মকর্তারা নগদ টাকার সংকটের কথা বলে সবাইকে ফেরত পাঠাচ্ছেন।'
ইউনিয়ন ব্যাংকের পটিয়া শাখার গ্রাহক নাসির উদ্দিন ব্যাংকটির তিন লাখ ৪৯ হাজার টাকা করে দুটি পে-অর্ডার জমা দেন ঢাকা ব্যাংক পটিয়া শাখায়। ২০ ও ২১ আগস্ট দুবার জমা দেওয়ার পরও পে-অর্ডার দুটি পাশ করায়নি ইউনিয়ন ব্যাংক।
ঢাকা ব্যাংক পটিয়া শাখার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, 'কয়েকটি ব্যাংকের চেক ও পে-অর্ডার নিয়ে আমাদের ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে। বারবার প্লেস করার পরও চেক কিংবা পে-অর্ডারগুলো পাশ করাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট ব্যাংক।'
শুধু ইউনিয়ন ব্যাংক নয়, এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণাধীন একাধিক ব্যাংক থেকে নগদ টাকা উত্তোলন, পে-অর্ডার ক্লিয়ারিং ও অর্থ হস্তান্তরে সমস্যা হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন অনেক গ্রাহক।
এর মধ্যে বেশি সমস্যা হচ্ছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক পটিয়া শাখার গ্রাহক শ্যামলী আচার্য়ী ও রাখাল আচার্য়ী উভয়ই পাঁচ লাখ টাকা করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের দুটি চেক জমা দেন ঢাকা ব্যাংক পটিয়া শাখায়।
ঢাকা ব্যাংক তাদের চেক দুটি ক্লিয়ারিংয়ে দুবার (২০ ও ২১ আগস্ট) প্লেস করার পরও পাশ করায়নি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক।
বাংলাদেশ অটোমেটেড ক্লিয়ারিং হাউজ-এর নিয়ম অনুযায়ী, একটি চেক তিন বার প্লেস করার পর প্রত্যাখ্যাত হলে তা অকার্য়কর হয়ে যায়।
তাই এ দুই গ্রাহক বৃহস্পতিবার ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে গিয়ে চেক নগদায়ন না করার বিষয়টি জানতে চাইলে তাদের আগামী সপ্তাহে নগদায়ন করা হবে বলে আশ্বাস দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
গত এক সপ্তাহ ধরে পে-অর্ডার পাশ করাতে পারছেন না ফার্স্ট সিকিউরিটি চট্টগ্রামের মহিলা শাখার গ্রাহক শাহজান মজুমদার।
'ব্যবসায়িক প্রয়োজনে ৩৫ লাখ টাকার এফডিআর ভাঙানোর আবেদন করলে তা পে অর্ডার করে দেয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক। কিন্তু অপর একটি ব্যাংক থেকে পে-অর্ডারগুলো বার বার প্লেস করার পরও পাশ করাচ্ছে না ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক,' বলেন তিনি।
'এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন ওই শাখায় গিয়ে ধন্না দিয়েছি। সর্বশেষ আজ বৃহস্পতিবার গেলে রোববার পে-অর্ডারগুলো পাশ করার আশ্বাস দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা,' বলেন এ ভুক্তভোগী গ্রাহক।
নগদ সংকটের দাবি ব্যাংকগুলোর
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফার্স্ট সিকিউরিটি চট্টগ্রামের মহিলা শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা গ্রাহকদের চাহিদামতো টাকা না দিতে পারার বিষয়টি স্বীকার করেন।
'তবে এটা শুধু আমাদের একটি শাখার সমস্যা তা নয়, অন্যান্য শাখাসহ পুরো বাংলাদেশেরই একই অবস্থা,' বলেন তিনি।
'যেহেতু এ সময়ে আমরা বাংলাদেশের ব্যাংকের নগদ অর্থ সহায়তা পাচ্ছি না, তাই এ সমস্যাটা তীব্র হয়েছে,' আরও বলেন তিনি।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক সদরঘাট শাখা থেকে ৫০ হাজার টাকা তুলতে গিয়ে মাত্র ১০ হাজার টাকা নিয়ে ফেরত আসতে হয়েছে ব্যবসায়ী নয়ন কুমার মজুমদাকে।
চট্টগ্রামের সদরঘাট এলাকার এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী টিবিএসকে বলেন, '৫০ হাজার টাকা তুলতে গেলে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট নগদ টাকা সংকটের কথা বলে আমাকে মাত্র ১০ হাজার টাকা দেয়।'
এ বিষয়ে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপক আবু ইউসুফ মো. হেলাল উদ্দিনের ব্যক্তিগত মুঠোফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
গ্রাহক আবু তাহেরের অভিযোগ প্রসঙ্গে ইউনিয়ন ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক জহিরুল আলম টিবিএসকে বলেন, দুই হাজার টাকার চেক পাশ না করার বিষয়টি আমার নজরে আসেনি বা ওই গ্রাহক আমার কাছে আসেননি।
'তবে যেহেতু একটা খারাপ সময় যাচ্ছে — আমরা কাউকে তাদের চাহিদামতো টাকা দিতে পারছি, কাউকে পারছি না; তা ঠিক। এটা সাময়িক সংকট। আশা করছি, দ্রুত তা কাটিয়ে উঠতে পারব,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক (চট্টগ্রাম) আরিফ হোসেন খান টিবিএসকে বলেন, 'একটি গ্রুপ নিয়ন্ত্রণাধীন কয়েকটি ব্যাংকে নগদ টাকার সংকট হচ্ছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জানতে পারছি। তবে কোনো গ্রাহক আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেননি এখনো।'
টাকা তুলতে পারছে এস আলম গ্রুপ
এদিকে সাধারণ গ্রাহকেরা মাত্র কয়েক হাজার টাকা তুলতে হিমশিম খেলেও এ সংকটময় সময়েও কয়েক কোটি টাকা তুলে নিয়ে যাচ্ছে এস আলম গ্রুপ।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) খাতুনগঞ্জ শাখায় এক হাজার ১১৩ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে, এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নামে গত বুধবার ১৬টি পে অর্ডারের মাধ্যমে ১৫ কোটি এক লাখ টাকা বের করে নিয়েছে গ্রুপটি।
এর আগে গত সোমবার এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের জামাতার প্রতিষ্ঠান ইউনিটেক্স এলপি গ্যাসের নামে অগ্রণী ব্যাংকে চেকের মাধ্যমে ৫০ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়।
লেনদেন সমস্যা ইসলামী ব্যাংকেও
তবে ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের মালিকানা থাকলেও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির পরিচালনা ব্যবস্থা অনেকটাই জামায়াত-সমর্থিত কর্মকর্তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন।
এছাড়া ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে নেওয়া ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্য়ন্ত এস আলম গ্রুপ তাদের শেয়ার হস্তান্তর করতে পারবে না বলে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এতে রেমিট্যান্স ও নগদ জমা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকটির লেনদেনে বেশি সমস্যা হচ্ছে না বলে দাবি করেন ইসলামী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
একইভাবে শেয়ার থাকলেও আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ কর্মাস ব্যাংক থেকে খুব বেশি ঋণসুবিধা নিতে পারেনি এস আলম গ্রুপ। যে কারণে ব্যাংক দুটিতেও খুব বেশি তারল্য সংকট নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এমনকি এসব ব্যাংক নিয়ে গ্রাহকের অভিযোগও পাওয়া যায়নি।
প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ
জানা গেছে, নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ দুই লাখ কোটি টাকার মতো ঋণ নিয়ে বড় অংশই পাচার করেছে।
এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে অন্তত ৭৫ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে গ্রুপটি। এসআইবিএল থেকে নেওয়া অর্থের পরিমাণ ১৫ থেকে ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। জনতা ব্যাংকের রয়েছে ১৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঋণের বড় অংশের সুবিধাভোগী এস আলম গ্রুপ। এর বাইরেও বিভিন্ন ব্যাংকে তার বড় অঙ্কের ঋণ রয়েছে।
এসআইবিএলের একজন কর্মকর্তা বলেন, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর শেষসময়ে এভাবে টাকা বের করে নিচ্ছে।
ব্যাংকের এমডি, ডিএমডিসহ ঊর্ধ্বতন সবাই তাদের নিজস্ব লোক হওয়ায় বেশিরভাগ ঘটনা অধস্তনরা জানতেই পারছেন না,' বলেন তিনি।
এ অবস্থার অবসান ঘটাতে দ্রুত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন এ কর্মকর্তা।
সরকার পরিবর্তনের পর এস আলম-ঘনিষ্ঠরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছয় ব্যাংকের ঋণ বিতরণে গত ১৯ আগস্ট বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।