টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পাভেল দুরভের গ্রেফতার যেসব কারণে গুরুত্বপূর্ণ
সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা পাভেল দুরভকে ফ্রান্সে গ্রেফতার করা হয়েছে। সার্বিক দিক দিয়ে এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। সাধারণত ইন্টারনেট কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে ব্যবহারকারী যা প্রচার করবে সেটার জন্য প্ল্যাটফর্ম দায়ী নয়। তবে তার অর্থ এই নয় যে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে যা ইচ্ছা সেটাই বলা কিংবা করা যাবে।
সেক্ষেত্রে প্রতিটি অ্যাপসের মডারেশনের আলাদা ক্রাইটেরিয়া আছে। যেমন, ইনস্টাগ্রাম প্রাপ্তবয়স্ক কন্টেন্ট প্রচার করতে দেয় না। কিন্তু এক্স কিংবা রেডিটে আবার সেই সকল বাধা-নিষেধ নেই। যদিও এসব কন্টেন্ট বেশিরভাগ দেশেই বৈধ।
এক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ, পেডোফিলিয়া, মাদক পাচার কিংবা হেইট স্পিচের মতো অবৈধ বিষয়গুলো নিয়েও রয়েছে ভিন্নতা। প্রতিটি প্ল্যাটফর্ম নিজেদের মতো করে এসব কন্টেন্ট মডারেট করে। একইসাথে সরকারের পক্ষ থেকেও এসব অবৈধ কন্টেন্ট প্রচারকারীদের তথ্য জানতে চাওয়া হয়। বেশিরভাগ কোম্পানিই এক্ষেত্রে এসব অনুরোধ আমলে নিয়ে কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করে। তবে টেলিগ্রামের ক্ষেত্রে অবশ্য ভিন্ন কার্যক্রম দেখা যায়।
সেক্ষেত্রে গ্রেফতারের পর ফ্রান্সের পক্ষ থেকে দুরভের বিপক্ষে মূলত অসহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে। অর্থাৎ, জটিলতা তৈরির মাধ্যমে চাইল্ড পর্নোগ্রাফি, অবৈধ লেনদেন, মাদকের প্রচারণা, জালিয়াতিতে সহযোগিতাসহ ইত্যাদি নানা অপরাধ বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। এই অভিযোগে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।
ইলন মাস্ক অবশ্য মনে করেন, মডারেশন করাটাও এক ধরণের সেন্সরশীপ। বিশ্বজুড়ে বর্তমানে টেলিগ্রামের বিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে। এক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মটির বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষকে খুবই কম সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে। বরং এটি ব্যবহারকারীদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা প্রদান করে।
এমনকি টেলিগ্রামের পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদের মডারেশনের বিষয়টি এখনো উন্নতির পর্যায়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীরা কী করেছে সেটার ওপর ভিত্তি করে প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতাকে গ্রেফতার করাটা অনেকের কাছেই অযৌক্তিক মনে হয়েছে।
সেক্ষেত্রে ঘটনা যেটাই হোক, গত শনিবার দুরভকে ফ্রান্সে গ্রেফতার করা হয়। তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগও আনা হয়েছে। ঘটনাটি বুঝতে হলে বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে।
১। সোশ্যাল নেটওয়ার্ক হিসেবে মনে করা
টেলিগ্রামের কার্যক্রম সহজভাবে বুঝতে হলে এটিকে একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে যেখানে প্রাইভেট মেসেজ করা যায়। তবে প্ল্যাটফর্মটির সাফল্যের মূল কারণ হচ্ছে বৃহৎ গ্রুপ খুলে সেখানে মেসেজ ও কমেন্ট করা যায়। বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা ইত্যাদি সকল ঘরানার লোক গ্রুপচ্যাটের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হতে পারে।
এক্ষেত্রে বহু দেশে অবৈধ এমন মতাদর্শের বহু গ্রুপ কিংবা কন্টেন্ট টেলিগ্রামে পাওয়া যায়। যেমন, সম্প্রতি স্পেনের হাইকোর্ট টেলিগ্রাম নিষিদ্ধ করেছে। কেননা ব্রডকাস্টারদের অভিযোগ, এটি কপিরাইট টেলিগ্রাম কন্টেন্ট প্রচার করে থাকে। এমনকি বেশকিছু টেলিগ্রাম চ্যানেল রয়েছে যেগুলো খেলাধুলা সম্প্রচার কিংবা সিরিজ, সিনেমা ও বই ডাউনলোড করতে দেখা যায়।
২। নগণ্য মডারেশন
টেলিগ্রাম দাবি করে থাকে যে, এটি স্প্যাম, সহিংসতা, মাদক, অস্ত্র, মিথ্যাচার কিংবা প্রাইভেট ডকুমেন্ট প্রকাশে বাধা দিয়ে থাকে। তবে সমস্যা হচ্ছে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের শেয়ার করা কন্টেন্টের মধ্য থেকে এসব কন্টেন্ট খুঁজে বের করা ও মুছে ফেলার প্রক্রিয়া বেশ কঠিন।
টেলিগ্রামের দাবি, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ম্যানুয়াল মডারেশন ও ব্যবহারকারীদের রিপোর্ট অনুযায়ী কাজ করে থাকে। প্ল্যাটফর্মটির পক্ষ থেকে বলা হয়, "আমরা সর্বদা একটি নিরাপদ ডিজিটাল পরিবেশ বজায় রাখতে এবং নেতিবাচক বিষয়বস্তুকে নিষ্পত্তিমূলকভাবে মোকাবেলা করতে সম্ভাব্য সর্বনিম্ন বাধা প্রদানের পক্ষে থাকবো।" আর এমন নীতিই প্ল্যাটফর্মটিকে অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীন করেছে। প্রতিষ্ঠাতা পাভেল দুরভের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য হলেও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছে সেটা অগ্রহণযোগ্য।
৩। প্লাটফর্মটি খুব বেশি নিরাপদ নয়
টেলিগ্রামের প্রতি অভিযোগের একটি বড় অংশ সেটির নিরাপত্তা ইস্যু। দুবাইভিত্তিক এই কোম্পানিটি মূলত যোগাযোগ টুল হিসেবে নিজেদের প্রচার করে থাকে। তবে সমস্যা হচ্ছে, টেলিগ্রাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে এনক্রিপটেড নয়।
অর্থাৎ, কোম্পানি কিংবা অ্যাকাউন্টে এক্সেস করা ব্যক্তি সহজেই প্রতিটি ইউজার চ্যানেলে কী লিখেছেন বা শেয়ার করেছেন সেটা দেখতে পারবেন। শুধু সিক্রেট কনভারসেশনের ক্ষেত্রে এনক্রিপশন চালু করা হয়; যা উভয় পক্ষের ইউজারকে নিজ থেকে করতে হয়। ফলে সর্বোপরি সেটা তেমন একটা কাজে আসে না।
এখানেই হোয়াটসঅ্যাপের সাথে টেলিগ্রামের ভিন্নতা রয়েছে। মার্ক জাকারবার্গ যদি ফ্রান্সে গ্রেফতার হতো তবে তিনি চাইলেই হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ কিংবা ছবির প্রবেশাধিকার অন্য কাউকে দিতে পারতেন না। কেননা সেগুলো এনক্রিপটেড। একই ঘটনা সিগনাল, থ্রিমার মতো প্লাটফর্মের ক্ষেত্রেও।
৪। রাশিয়াকে নিয়ে কৌতূহল
টেলিগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা দুরভ একজন রুশ নাগরিক। তবে তার ফ্রেঞ্চ পাসপোর্ট রয়েছে। ভিকন্টাক্টে নামের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। যেটিকে 'রাশিয়ান ফেসবুক' হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে ক্রেমলিনের চাপে সেই অ্যাপ থেকে তিনি সরে আসেন। এমনকি দেশটিতে মেটা অ্যাপস ও ইউটিউবও বন্ধ। আবার ২০১৫ সাল থেকে চীনে বন্ধ টেলিগ্রাম।
মূলত সন্দেহের শুরু এখান থেকেই। রাশিয়ায় যেখানে অন্য অ্যাপগুলো নিষিদ্ধ সেখানে টেলিগ্রামকে কেন চালু রাখা হয়েছে সেই প্রশ্নও রয়েছে। যদিও প্লাটফর্মটির পক্ষ থেকে দেশটির সাথে এমন কোনো সংশ্লিষ্টতা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।
৫। এক্টিভিজমের জন্য প্লাটফর্মটি উপযোগী?
টেলিগ্রাম যদি গ্রুপগুলোকে এনক্রিপশন করে, তবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে বহু বেশি সদস্য গ্রুপগুলোতে যুক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মটির এনক্রিপশন না করার সিদ্ধান্ত প্রতিদ্বন্দিদের সুবিধা দিচ্ছে৷ তবে এর ব্যবহারকারীরা, বিশেষ করে যারা কর্তৃত্ববাদী সরকার কিংবা সহিংস জায়গায় থাকেন এটি বেশ ব্যবহার করে থাকেন। তবে তারা হয়তো এটা জানেন না যে, টেলিগ্রাম হয়তো তাদের ডেটায় এক্সেস নেবে না। কিন্তু সরকারি সাইবার এজেন্সি ব্যবহারকারীদের ইনবক্সে ঢুকে পরতে পারে। এছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে মিথ্যা ক্যাম্পেইন ছড়ানোর টুল হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হতে পারে।
এতসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও টেলিগ্রাম নাগরিকদের মাঝে তথ্য প্রবাহের একটা জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে দুরভের গ্রেফতার প্ল্যাটফর্মটির ভবিষ্যৎ শঙ্কার মাঝে ফেলেছে। সেক্ষেত্রে এটি বন্ধ হওয়া কিংবা ব্যবহার কমে যাওয়ার প্রভাব বিবেচনা করা বেশ কষ্টকর।
৬. বাকস্বাধীনতা ও ইউরোপ
ধনকুবের ইলন মাস্ক দুরভকে গ্রেফতার নিয়ে ফ্রেঞ্চ সরকারের প্রতি বিদ্রুপ করেছেন। একইসাথে এমন পদক্ষেপ অন্যসব আইডিয়াকে সেন্সর করার উপায় বলে মনে করেন তিনি৷
তবে টেলিগ্রাম নিয়ে ইউরোপের সাবিক দৃশ্যপট ভিন্ন। বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গুই ভেরহফস্টাডট বলেন, "বৈশ্বিক সাইবার অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে টেলিগ্রাম। বাক স্বাধীনতার সাথে দায়িত্বশীলতাও জড়িত।"
কিছুদিন আগে অবশ্য স্পেনিশ হাইকোর্ট টেলিগ্রাম বন্ধ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিল। কেননা দেশটির মতে, দেশভিত্তিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিষয়টি নিয়ে ইউরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
টেলিগ্রামের দাবি অনুযায়ী, ইউরোপে প্ল্যাটফর্মটির ৪১ মিলিয়ন ব্যবহারকারী রয়েছে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৪৫ মিলিয়ন ব্যবহারকারী থাকা অ্যাপগুলোকে ডিজিটাল সার্ভিসেস এক্ট রেগুলেশন অনুযায়ী 'বড় অনলাইন প্লাটফর্ম' হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। এক্ষেত্রে টেলিগ্রাম বেশ কৌশলে আইনি ও তথ্যগত জটিলতা এড়িয়ে যেতে পারছে।
অনুবাদ: মোঃ রাফিজ খান