‘বহিরাগতদের প্ররোচনায়’ শ্রমিক বিক্ষোভের কবলে ওষুধ শিল্প
গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে সব শ্রমিককে স্থায়ীকরণ, বেতনভাতা ও ছুটি বৃদ্ধিসহ নানান দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভে বিপর্যয়ে পড়েছে দেশের ফার্মাসিউটিক্যাল বা ওষুধ শিল্প।
এই বিক্ষোভের ফলে ২৭টি বড় ওষুধ কোম্পানিকে বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে।
বিভিন্ন দাবি-দাওয়া জানানোর পাশাপাশি তারা কারখানার অভ্যন্তরে ভাঙচুর করেছে, কর্মকর্তাদের জিম্মি করে দাবির পক্ষে কাগজে সই করতেও বাধ্য করেছে। মালিকদের অভিযোগ, তাদের কারখানাগুলোতে গোলযোগ ছড়াচ্ছে বহিরাগতরা।
শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনে কয়েকটি কারখানা উৎপাদনে ফিরলেও— নতুন নতুন দাবি নিয়ে আবারো বিক্ষোভ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন কারখানার কর্মকর্তা ও মালিকরা।
বহিরাগতদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ
তারা বলছেন, কিছু অস্থায়ী শ্রমিক বহিরাগতদের সহায়তায় বেশকিছু কারখানায় বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছে।
গত এক সপ্তাহ ধরে সাভার, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। এই বিক্ষোভের ফলে স্কয়ার, একমি, ওরিয়ন, বেক্সিমকো, ইনসেপ্টাসহ অন্তত ২৭টি কোম্পানির কারখানা বন্ধ ছিল বলে জানিয়েছে ওষুধ শিল্প সমিতি।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আব্দুল মুক্তাদির টিবিএসকে বলেন, "আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে বসে তাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিতে চাই। তবে কর্মকর্তাদের জিম্মি করে অযৌক্তিক যেসব দাবি করা হচ্ছে– তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের হস্তক্ষেপে খুব দ্রুতই এ বিক্ষোভ বন্ধ করতে হবে। এটি নাহলে দেশের ফার্মা সেক্টর সংকটে পড়বে।"
তিনি আরও বলেন, "জিম্মি করে, ভাঙচুর করে দাবি আদায় করা ন্যায়সঙ্গত নয়। একটি দাবি মেনে নেয়ার পরবর্তী দিনে আরো নতুন নতুন দাবি নিয়ে আসছে শ্রমিকরা। মনে হচ্ছে, এটি ওষুধ শিল্প ধ্বংস করার একটা চক্রান্তের অংশ। এভাবে বিক্ষোভ চলতে থাকলে কোম্পানিগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে।"
ওষুধ সরবরাহে সংকটের আশঙ্কা
ওষুধশিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমানে মজুত থাকা ওষুধ দিয়ে সরবরাহকাজ চলছে। এ অচলাবস্থা বেশি সময় থাকলে– দেশে ওষুধ সরবরাহে বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। তাতে বিপুলসংখ্যক মানুষের চিকিৎসাসেবা এবং রপ্তানি ব্যাহত হবে। এ কারণে অবিলম্বে সব কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম পুরোদমে চালু করতে সরকারকে সহায়তা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
বুধবার গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুরে ইউনি হেলথ ফার্মাসিউটিক্যালসের কারখানায় কর্মীরা কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে নামেন। তারা বেতনবৈষম্য দূর করাসহ ২০ দফা দাবি করেন।
প্রধান দাবিগুলো
শ্রমিকদের মূল দাবিদাওয়ার মধ্যে আছে – ভোটের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন; ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের দৈনিক বেতন মিনিমাম ৭৫০ টাকা করা; যেকোনো কর্মীকে যোগ দেয়ার ৬ মাসের মধ্যে স্থায়ীকরণ; নূন্যতম বেতন ৮,৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০,৫০০ টাকা করা; নৈশভাতা ন্যূনতম ৫০০ টাকা করা; প্রতিবছর শ্রমিকদের বেতন নূন্যতম ২০ শতাংশ বাড়ানো; সপ্তাহে দুইদিন ছুটি দেয়া; হাজিরা বোনাস; ইয়ার- এন্ড প্রোডাক্টশন বোনাস এবং তিন বছর পর অটোন-প্রমোশন অন্যতম।
সকাল থেকেই এসব দাবিতে– কর্মবিরতির পাশাপাশি শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে কারখানার শ্রমিকরা।
কারখানার একজন ফোরম্যান মোহাম্মদ হান্নান টিবিএসকে বলেন, "আমরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছি। সবার জন্য সমান সুযোগ চাই আমরা।"
নিত্যনতুন দাবি যোগ হচ্ছে
ইউনি হেলথের একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, কারখানায় মূল কাজ করেন কেমিস্ট ও স্থায়ী শ্রমিকরা। কিছু অস্থায়ী শ্রমিক ও হেলপার বহিরাগতদের সহায়তায় কয়েকদিন ধরে কারখানায় বিক্ষোভ করছে। মালিকপক্ষ এক দফায় তাদের দাবি মেনে নিলেও নতুন করে আরো দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে।
"আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলার সময় আমরা কয়েকজন বহিরাগতকে দেখেছি, তবে কেউ তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে চান না। ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা থাকলেও– আন্দোলনকারীরা পুলিশের কথা শুনছেন না"- বলে জানান তিনি।
তিন দিন বন্ধ থাকার পর সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও কারখানা শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বুধবার চালু হয়েছে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ওষুধ উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠান একমি ল্যাবের কারখানা।
প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা বলেন, "বিভিন্ন বিভাগের ফোরম্যান, মেকানিক, গার্ড, ক্যান্টিন বয়সহ অস্থায়ী শ্রমিকরা প্রথমে সর্বনিন্ম বেতন দ্বিগুণ করার দাবিতে আন্দোলন করে। মালিকপক্ষ বুঝিয়ে তা ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করার সম্মতি দেন। তবে একদিন পর বহিরাগতদের প্ররোচনায়, তা প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে ২০,৫০০ টাকা করার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে তারা। এর সঙ্গে নতুন নতুন দাবি যোগ হয় যা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।"
শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে কয়েকদিন ধরে অচলাবস্থা দেশের শীর্ষ ফার্মা প্রতিষ্ঠান স্কয়ার ও ইনসেপ্টার কারখানাগুলোতেও।
আব্দুল মুক্তাদির যিনি ইনসেপ্টা ফার্মার-ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ওষুধ শিল্প সমিতি বিগত ৫০ বছর ধরে শ্রমিকদের নিয়ে এই ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু, বর্তমানে শ্রমিকরা ঠিক কী কারণে এবং কেন নিত্যনতুন দাবি এনে বিক্ষোভ করছেন– তা বোধগম্য নয়।
মঙ্গলবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে আব্দুল মুক্তাদির বলেন, "সায়েন্টিস্ট ও ম্যানেজারদের বন্দি করে রেখে বলছে, কাগজে সই করেন না হলে আপনাদের ছাড়ব না। ইনসেপ্টা ফার্মসিতে প্রায় ৪০০ স্টাফকে সকাল ৭টা থেকে রাত ৩টা পর্যন্ত বন্ধ করে রেখেছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে এমন অনেক রয়েছেন– যাদেরকে আমরা কখনো দেখিনি। তারা এমন সব দাবি করছেন, যা মানা প্রায় অসম্ভব।"
গাজীপুরের একটি কারখানার শ্রমিকরা সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সব কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে দাবি আদায়ে। শ্রমিকদের আন্দোলনে দুই দিন ধরে আটকা পড়েন কারখানাটির ২০০ জনের বেশি কর্মকর্তা। এরমধ্যে অন্তত ৪০ জন নারী ও কয়েকজন গর্ভবতী ছিলেন বলে ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান ওই ফ্যাক্টরির একজন কর্মকর্তা।
কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিবিএসকে জানান, "ক্যান্টিনের খাবার ফুরিয়ে গিয়েছিল। এই বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাদের রাত্রীযাপনের জন্য কারখানায় একোমোডেশন ছিল না। ফলে সবাই এক ভয়ার্ত রাত কাটিয়েছে। পরদিন সেনাবাহিনীকে এসে বহু দেন-দরবার করে শ্রমিকদের শান্ত করতে হয়েছে।"
আকস্মিক দাবিগুলো মেটানো কঠিন
নানা দাবিতে বিক্ষোভের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যালসের-ও।
ওরিয়ন ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জেরীন করিম বলেন, "ম্যানেজারদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে– এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমরা আগে পড়িনি। আমরা শ্রমিকদের কথা শুনতে চাই। শ্রমিকরা নূন্যতম বেতন বাড়ানোর যে দাবি করেছে আমরা তার যৌক্তিক সমাধান চাই।" এটি দ্রুত সমাধান নাহলে– রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করেন তিনি।
জেরীন করিম বলেন, "বর্তমানে মিনিমাম ওয়েজ ৮,৫০০ টাকা। আমরা চাই এটি যৌক্তিক হারে বাড়ুক। এজন্য সরকার মালিক ও শ্রমিক পক্ষের সঙ্গে বসুক। শ্রমিকদের স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রেও আমাদের সিস্টেমটা সরকার ও শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনা হোক। হুট করে সব পরিবর্তন করে কারখানা চালানো যাবে না।"
শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক
তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পখাতের কারখাসহিল শ্রমিক অসন্তোস ও বিক্ষোভ নিয়ে বুধবার বৈঠক করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। বৈঠকে বহিরাগতদের শক্ত হাতে দমন ও শ্রমিকদের কাজে ফেরাতে যৌথ অভিযানের নির্দেশনা আসে। তবে ফার্মা সেক্টরের বেতন কিংবা মালিকপক্ষের সঙ্গে বসার উদ্যোগ এখনো আসেনি।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (রুটিন দায়িত্ব) বলেন, ওষুধ শিল্প শ্রমিকদের সর্বনিম্ন বেতন পর্যালোচনা ও বাড়াতে একটি ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হয়েছে। "প্রথম মিটিংয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে গত জুলাইয়ে দ্বিতীয় মিটিং হওয়ার ছিল। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে যা সম্ভব হয়নি। এখন আমরা খুব শিগগিরই ওষুধ শিল্প মালিকদের সঙ্গে বসব।"
শ্রমিকদের নতুন ওয়েজ বোর্ড খুব শিগগিরই ঘোষণা হবে জানিয়ে সবাইকে কাজে ফেরার অনুরোধ জানান জাহাঙ্গীর হোসেন।
বাংলাদেশ আজ ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ বর্তমানে দেশেই তৈরি হচ্ছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ২৯৫টি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আছে– যারা বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ওষুধ বিপণন করে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে রপ্তানি করা হয়। ওষুধের রপ্তানি বাজার প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার ।