সিঙ্গাপুরে এস আলমের সাম্রাজ্যে…
আগস্টের এক রোদেলা সকাল। আমি সিঙ্গাপুরের জালান মেরলিমাউ ও থমসন রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে। ইতিউতি করে খুঁজছি ১২ হাজার বর্গফুট এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা বিশাল তিনতলা একটি পেন্টহাউজের নম্বরপ্লেট।
আশ্চর্যের বিষয়, অনেকক্ষণ খোঁজার পরও কোনো নম্বরপ্লেট চোখে পড়ল না।
কিন্তু এ বাড়িটা ৩ নং জালান মেরলিমাউ হতেই হবে। এর ঠিক পাশের বিল্ডিংটার নম্বর ৫। রাস্তা পেরিয়ে ২ নং বাড়িটার দিকে গেলাম। বিপরীত দিকের ম্যানশনটি যে ৩ নং জালান মেরলিমাউ, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এ প্রাসাদোপম বাড়ির মালিক বাংলাদেশি অলিগার্ক সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম। তিনি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান।
বাড়িটার ভেতরে উঁকি দিলাম। সারিসারি দামী বিলাসবহুল গাড়ি পার্ক করে রাখা। তার মধ্যে পোর্শা আর জাগুয়ারও দেখা মিলল।
গুগলে ঠিকানাটা মিলিয়ে নিলাম। আমি যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, সেটিকে স্ক্রিনে ৩ নং জালান মেরলিমাউ হিসেবেই দেখাচ্ছে। জালান মেরলিমাউ সড়কে থাকা সব বাড়ির গেটের সামনে নম্বরপ্লেট রয়েছে, কেবল ৩ নম্বরটি ছাড়া।
বেল বাজাতে ইতস্ততবোধ হচ্ছিল। ঠিক তখনই গেট খুলে গেল। ভেতর থেকে ফিলিপিনো দেখতে একজন তরুণী ও একজন বাংলাদেশি নারী ট্র্যাশব্যাগ হাতে বের হলেন। গেটের ঠিক পাশেই একটা সবুজ-নীল রংয়ের বিন।
তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম এটা ৩ নম্বর বাড়ি কি না। তারা দায়সারাভাবে 'হ্যাঁ' বলে ভেতরে চলে গেলেন।
থমসন রোডের একটি নির্মাণ সাইটে কাজ করা একদল বাংলাদেশি শ্রমিকও উদয় হলেন সে সময়। তাদের জিজ্ঞাসা করলাম তারা জানেন কি না এ বাড়িতে কারা থাকে।
'চট্টগ্রামের এস আলম,' তাদের একজন উত্তর দিলেন। 'তার পুরো পরিবার এখানে আছে। কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই দেখবেন তারা দামি-দামি গাড়িতে চড়ে ঢুকছেন, বের হচ্ছেন।'
দিন কয়েক আগে আমার হোটেল রুমে আমি সিঙ্গাপুর ল্যান্ড অথরিটি (এসএলএ) এবং অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড কর্পোরেট রেগুলেটরি অথরিটি (এসিআরএ)-এর ওয়েবসাইটে চোখ বোলাচ্ছিলাম।
এছাড়া, এস আলমের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী আমাকে ৩ জালান মেরলিমাউ ম্যানশনের মালিককে শনাক্ত করার জন্য নথিপত্র ঘাঁটতে সাহায্য করছিলেন।
এস আলম ২০১৯ সালে ১২ হাজার ২৬০ বর্গফুট জমিতে প্রাসাদতুল্য বাড়িটি নির্মাণ করেন, যার দাম বর্তমান বাজারমূল্যে কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার বা প্রায় ৩০০ কোটি টাকারও বেশি।
এখান থেকেই সিঙ্গাপুরে এস আলম সাম্রাজ্য নিয়ে আমাদের তদন্ত শুরু হয়।
পরের কয়েকদিন আমি আশ্চর্যজনক পরিমাণে নথি পেয়েছি যা রিয়েল এস্টেট এবং বিভিন্ন হোটেলে এস আলমের বিনিয়োগের প্রমাণ করেছে। সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরেও তার বিনিয়োগের কথা উঠে এসেছিল।
সিঙ্গাপুরে এস আলমের ৭০০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার বিনিয়োগ
এসিআরএ-এর তথ্য অনুযায়ী, বিলিয়ন ডলার পাচারের দায়ে অভিযুক্ত এস আলম ২০০৯ সাল থেকে গত এক দশকে নিজের এবং তার স্ত্রীর নামে বিভিন্ন কোম্পানি স্থাপন করে সিঙ্গাপুরে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে শুরু করেন।
সিঙ্গাপুরে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পরিচালিত সরেজমিন তদন্তে দেখা গেছে, এস আলম একটি শপিং মলে ৩টি হোটেল ও রিটেইল স্পেস কেনার জন্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার (বর্তমান ডলারমূল্যে ছয় হাজার ৩০০ কোটি টাকার সমান) বিনিয়োগ করেছেন।
অর্জিত সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে তিনটি হোটেল: লিটল ইন্ডিয়ায় অবস্থিত প্রায় ২৪৮ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার ব্য়য়ে হিল্টন গার্ডেন ইন হিসাবে নতুন নাম দেওয়া গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল হোটেল সিঙ্গাপুর; সেরাঙ্গুনের ৯০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার দামি হলিডে ইন এক্সপ্রেস; এবং নোভেনা এলাকার ১৭০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলারের ইবিস নোভেনা হোটেল।
এছাড়া দেশটিতে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে এস আলম ২৭ হাজার ১৭৯ বর্গফুটের রিটেইল স্পেসও কেনেন। এগুলোর সবগুলোই মুস্তাফা সেন্টারের কাছে লিটল ইন্ডিয়ায় অবস্থিত সেন্ট্রিয়াম স্কয়ারের প্রথম দুটি লেভেলে অবস্থিত।
কানালি লজিস্টিকস (পরে উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল), ক্যানোপাস টু, টলেডো ইন্টারন্যাশনাল এবং গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল হোটেল নামক চারটি কোম্পানির মাধ্যমে এ সমস্ত কেনাকাটা করা হয়েছে।
টিবিএস-এর তদন্তে এস আলমকে এ চারটি কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত পাওয়া গেছে।
এসিআরএ নথি অনুসারে, সমস্ত আর্থিক লেনদেন সিঙ্গাপুরের ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংক লিমিটেড (ইউওবি)-এর মাধ্যমে করা হয়েছিল।
সিঙ্গাপুর সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা সংবিধিবদ্ধ বোর্ড এসিআরএ-এর তথ্য অনুযায়ী, এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তার অফিসের কর্মীরা সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত চারটি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার।
এ প্রতিবেদক সবগুলো অফিস পরিদর্শন করে এস আলমের বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই করা এসব বিনিয়োগের প্রমাণ পেয়েছেন। তিনি হুন্ডি এবং এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার করেছেন, যার বেশিরভাগই চিনি আমদানির সঙ্গে যুক্ত। এসব তথ্য তার অফিসের কর্মীরা জানিয়েছেন।
দেশের অভ্যন্তরীণ চিনির বাজারের সবচেয়ে বড় সরবরাহকারী এস আলম গ্রুপ মূলত সিঙ্গাপুরের একটি বৈশ্বিক বাণিজ্য সংস্থা থেকে চিনি আমদানি করে।
এস আলমের দুটি ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের দুই শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা হুন্ডি ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে তাকে অর্থ পাচারে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তাদের সম্পৃক্ততা স্বাধীনভাবে যাচাই করতে না পারায় টিবিএস তাদের নাম প্রকাশ করছে না।
সিঙ্গাপুরের চারটি কোম্পানির নিবন্ধন নথিতে এস আলম ও তার স্ত্রী পারভীন নিজেদের সাইপ্রাসের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।
এস আলম তার কোম্পানির নিবন্ধন নথিতে দুটি বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ ঠিকানাটি হলো ৩ জালান মেরলিমাউ, যা একটি তিনতলা ব্যক্তিগত বাড়ি। বাড়িটি ২০১৯ সালে নির্মিত হয়েছে। এসিআরএ নথিতে দেখা যায়, এস আলম এ সম্পত্তিটি জিকো ট্রাস্টের নামে স্থানান্তর করেছেন, যার নিবন্ধন ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে হয়েছিল।
এ বাড়িটি থমসন রোডের সংলগ্ন একটি এলাকায় অবস্থিত, যেখানে নির্মাণকাজ চলছে। অনেক বাংলাদেশি শ্রমিক এখানে কাজ করেন।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে গাজীপুর থেকে আসা এক শ্রমিক জানান, তিনি পাঁচ বছর ধরে এ নির্মাণস্থলে কাজ করছেন। তিনি এস আলমের ৩ জালান মেরলিমাউ বাড়ির নির্মাণ কাজ দেখেছেন এবং ওই বাড়িতে অবস্থানকারী এস আলমের বাংলাদেশি কর্মীদেরও চেনেন। এস আলমের তিন ছেলে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বাড়িটিতে থাকতে দেখা গেছে।
বাড়িটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দ্বারা ঘেরা, নম্বরটি মুছে ফেলা হয়েছে। এ প্রতিবেদক ২ জালান মেরলিমাউতে থাকা একটি কনডোমিনিয়ামে বসবাসকারী এক ফিলিপিনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন।
একটি সাধারণ আলাপচারিতায় ওই ব্যক্তি জানান, তিনি ওই বাড়ির বাসিন্দাদের জাগুয়ার ও পোর্শার মতো বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করতে দেখেছেন। বাংলাদেশিরা এত ধনী দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন বলেও জানান।
এর আগে এস আলম আরেকটি বাড়ির ঠিকানা রেজিস্ট্রেশন নথিতে ব্যবহার করেছিলেন। এটি ছিল ২এ লিঙ্কন রোড, #২৯-১০ পার্ক ইনফিনিয়া অ্যাট উই ন্যাম, সিঙ্গাপুরে অবস্থিত একটি কনডো।
এই কনডোগুলোর গড় আকার প্রায় ১,৫০০ বর্গফুট। টিবিএস-এর অনুসন্ধান অনুযায়ী, এগুলোর বাজারমূল্য প্রায় চার মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার, যা প্রায় ৩০ কোটি টাকার সমান।
সিঙ্গাপুরে আশ্রয় নেওয়া মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে অভিযুক্ত বাংলাদেশিদের বিষয়ে সিঙ্গাপুর সরকারের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে দেশটির ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন মন্ত্রী জোসেফিন টিও জানান, ইন্টারপোলে রিপোর্ট না করা পর্যন্ত তারা কোনো পদক্ষেপ নেবেন না।
সিঙ্গাপুরের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেকেন্ড মিনিস্টার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করা টিও আরও বলেন, কেবল যদি দুই দেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকে তাহলে অভিযুক্ত অর্থপাচারকারীদের ফেরত পাঠাতে তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারেন।
টিবিএস এস আলমকে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর বিষয়ে একাধিকবার ফোন এবং ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।
কানালি লজিস্টিক
২০০৯ সালে এস আলম পরিশোধিত মূলধন হিসেবে তিন কোটি সাধারণ শেয়ার ইস্যু করে কানালি লজিস্টিকস (উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল নামেও পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেন। এ পরিমাণ শেয়ারের মূল্য ছিল ৩০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার, বা বর্তমান বাজারমূল্যে ২৭০ কোটি টাকার সমতুল্য।
এসিআরএ নথি অনুসারে, এস আলম ২.১০ কোটি শেয়ার বং তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন নয় লাখ শেয়ারের মালিক। পরিশোধিত মূলধন সিঙ্গাপুরের ইউওবি ব্যাংকে জমা করা হয়েছিল।
কোম্পানির প্রধান কার্যক্রম হিসেবে শিপিং এজেন্সি (মালবাহী), শিপিং ও লজিস্টিকস এবং হোটেল বিনিয়োগ দেখানো হয়েছে।
এস আলম ও ফারজানা সাইপ্রাসের নাগরিক হিসেবে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত। এছাড়া ভারতীয় নাগরিক থাজুদিন নাসিরুদিনকে সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে।
এস আলম এবং ফারজানা উভয়েই তাদের ঠিকানা হিসেবে দেখিয়েছেন ২এ লিঙ্কন রোড, #২৯-১০ পার্ক ইনফিনিয়া অ্যাট উই ন্যাম, সিঙ্গাপুর। কানালি লজিস্টিকসের অফিসের ঠিকানা হলো ১০ কলিয়ার কোয়াই, #১০-০১, ওশান ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার, সিঙ্গাপুর।
তবে এ প্রতিবেদক সরেজমিনে গিয়ে ওশান ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টারে এ নামে কোনো কার্যালয় খুঁজে পাননি।
কানালি লজিস্টিকসের পাশাপাশি এস আলম ২০১৪ সালে ২৭ হাজার ১৭৯ বর্গফুটের রিটেইল স্পেস কেনেন, যার পুরোটাই জনপ্রিয় শপিং মার্কেট মুস্তাফা সেন্টারের কাছে লিটল ইন্ডিয়ার সেন্ট্রিয়াম স্কয়ারের প্রথম দুটি লেভেলে অবস্থিত।
১৯-তলা ভবনটির নির্মাণ কাজ ২০২০ সালে শেষ হয়। প্রতিবেদক সরেজিমেন পরিদর্শন শেষে নিশ্চিত হয়েছেন যে, ওশান ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টারের প্রথম দুটি লেভেলে ৪৯টি ইউনিট রয়েছে।
গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল হোটেল
২০১৫ সালে এস আলম গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল হোটেল কোম্পানির মাধ্যমে লিটল ইন্ডিয়ার বেলিলিওস রোডে অবস্থিত হোটেল গ্র্যান্ড চ্যান্সেলর অধিগ্রহণ করেন। পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় হিল্টন গার্ডেন ইন।
এসিআরএ নথি অনুযায়ী, এস আলম ও তার স্ত্রী এটির পরিচালক এবং থাজুদিন নাসিরুদিন সেক্রেটারি।
কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার উইলকিনসন ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানির। মোট শেয়ারের পরিমাণ তিন কোটি ৮০ লাখ, যার মূল্য ৩৮ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার, বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় ৩৪০ কোটি টাকার সমান।
গ্র্যান্ড ইম্পেরিয়াল হোটেল কোম্পানির ঠিকানাও কানালি লজিস্টিকসের অফিসের ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে।
২০১৯ সালে এস আলম ও তার স্ত্রী কোম্পানির নথিতে ৩ জালান মেরলিমাউ, সিঙ্গাপুরকে তাদের বাড়ির ঠিকানা হিসেবে হালনাগাদ করেন।
টলেডো ইন্টারন্যাশনাল
এস আলম জালান বেসারে অবস্থিত হলিডে ইন এক্সপ্রেস সিঙ্গাপুর সেরাঙ্গুনের মালিক। এটি তিনি টলেডো ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে কিনেছিলেন।
১০ মিলিয়ন সিঙ্গাপুরি ডলার বা প্রায় ৯০ কোটি টাকা সমমূল্যের এক কোটি শেয়ার ইস্যু করে এ কোম্পানিটি ২০১৬ সালে সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত হয়। সিঙ্গাপুরের ইউওবি ব্যাংকের সঙ্গে কোম্পানির আর্থিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
থাজুদিন নাসিরুদিনই এ কোম্পানির সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। টলেডো ভেঞ্চারস লিমিটেড কোম্পানির সমস্ত শেয়ারের মালিকও তিনি। টলেডো ভেঞ্চারসের ঠিকানা ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে নিবন্ধিত।
টিবিএস টলেডো ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে এস আলমের সম্পৃক্ততার অনুসন্ধান করেছে। এস আলম সিঙ্গাপুরের ১০৫ সেসিল স্ট্রিট, #০৬-০১, দ্য অক্টাগনে তার ব্যক্তিগত অফিস হিসাবে টলেডোর অফিস ব্যবহার করতেন।
অফিসটিতে গেলে দ্য অক্টাগনের রিসেপশনিস্ট জানান, টলেডোর অফিসটি ষষ্ঠ তলায় অবস্থিত এবং এস আলম নিয়মিত এ অফিসে যাতায়াত করতেন। অনেক বাংলাদেশিও তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তবে, গত ৩-৪ মাস ধরে তিনি এ অফিসে নেই, কারণ তার আরেকটি অফিস রয়েছে।
এ প্রতিবেদক গিয়ে অফিসটি ফাঁকা দেখতে পান। দুই ইউনিটের বিল্ডিংয়ের একটি ইউনিটে টলেডোর অফিস। অফিসের কলিংবেল বাজালে একজন মহিলা অন্য অফিস থেকে বেরিয়ে এসে জানান, এস আলম বিদেশে থাকায় কয়েক মাস ধরে অফিসে আসছেন না।
এই প্রতিবেদক তাকে সাইফুল আলম মাসুদের ছবি দেখালে তিনি নিশ্চিত করেন যে, ছবির লোকটিই এস আলম।
ক্যানোপাস ২
২০১৯ সালে ক্যানোপাস ২ নামক একটি হোটেল কোম্পানির মাধ্যমে এস আলম সিঙ্গাপুরের নোভেনা এলাকায় ইবিস নোভেনা হোটেল কেনেন। এ কোম্পানির অফিস কানালি লজিস্টিকসের ঠিকানায় অবস্থিত।
আলফা ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারস একটি অফ-মার্কেট লেনদেনের মাধ্যমে ২৪১ কক্ষবিশিষ্ট হোটেলটি বিক্রি করেছিল।
সিঙ্গাপুরের বিজনেস টাইমস এক প্রতিবেদনে প্রথম জানায়, এস আলম যা সিঙ্গাপুরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ফ্রিহোল্ড সম্পত্তি ২৪১ কক্ষবিশিষ্ট হোটেলটি প্রতি কক্ষ কেবল সাত লাখ ৫ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলারের কিছু বেশি দামে কিনেছিলেন।
এই প্রতিবেদক বিজনেস টাইমস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এস আলমের হোটেলটি কেনার ব্যাপারে পুনরায় নিশ্চিত হন।
যেভাবে গণমাধ্যমে বিদেশি সম্পদের তদন্ত বন্ধ করেন এস আলম
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এস আলম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক লাখ ১৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা (প্রায় ১০.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) পাচারের অভিযোগে তদন্ত শুরু করেছে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দীর্ঘ প্রশাসনের ক্ষমতাচ্যুতির পর সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর অধীনে ১ সেপ্টেম্বর থেকে তদন্ত শুরু করে।
এর আগে হাসিনার শাসনামলে এস আলম তার বিদেশি সম্পদের তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন এবং বিচার ব্যবস্থায় তার প্রভাব খাটিয়ে মিডিয়াকে স্তব্ধ করার জন্য আদালতের আদেশের ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে তার গ্রুপের অর্থ পাচারের প্রতিবেদন প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়।
যেমন, একটি সুয়ো মোটো রুলিংয়ে হাইকোর্ট ২০২৩ সালের ৬ আগস্ট এস আলম এবং তার স্ত্রী ফারজানার বিরুদ্ধে অননুমোদিত বিদেশি বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দেন।
এস আলমের প্রায় এক বিলিয়ন ডলার পাচারের বিষয়ে একটি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর এ আদেশ জারি করা হয়।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) ৬ আগস্ট ২০২৩ থেকে দুই মাসের মধ্যে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে একটি বিশদ প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন।
আদেশের এক সপ্তাহ পর ১২ আগস্ট এ এস আলম ও তার গ্রুপ এবং ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত ঋণের বিষয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য সরকার, ৪টি জাতীয় পত্রিকার সম্পাদক এবং এসব দৈনিকের আট সাংবাদিককে একটি আইনি নোটিশ পাঠানো হয়।
২৭ নভেম্বর ২০২২-এ প্রকাশিত "হাউ আ ২৪-ইয়ার-ওল্ড গ্রিনহর্ন ইজ 'ব্লেজড' উইদ আ টাকা৯০০ক্রোর লোন" শীর্ষক প্রতিবেদনের জন্য নোটিশটি টিবিএস সম্পাদক ইনাম আহমেদ এবং সাংবাদিক জেবুন নেসা আলো ও সাখাওয়াত প্রিন্সকে পাঠানো হয়।
দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম, নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক এবং সাংবাদিক পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য ও জাইমা ইসলামকেও একই ধরনের নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর প্রকাশিত 'টাকা৭,২৪৬ ক্রোর লোনস টু ৯ ফার্মস: বিবি প্রোবিং ব্রিচ অব রুলস অ্যাট ইসলামী ব্যাংক' এবং ৪ আগস্ট ২০২৩-এ প্রকাশিত 'এস আলমস আলাদিনস ল্যাম্প' প্রতিবেদনের জন্য তাদেরকে এ নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান এবং সাংবাদিক সানাউল্লাহ সাকিবও "ইসলামী ব্যাংকে 'ভয়ংকর নভেম্বর'" (২৪ নভেম্বর ২০২২) প্রতিবেদনের জন্য নোটিশ পেয়েছিলেন।
২০২২ সালের ৩০ নভেম্বর নিউ এজ-এ প্রকাশিত 'এস আলম গ্রুপ লিফটস টাকা৩০,০০০ক্রোর লোনস ফ্রম আইবিবিএল অ্যালোন' শিরোনামের প্রতিবেদনের জন্য নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির এবং রিপোর্টার মোস্তাফিজুর রহমানকেও আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছিল।
প্রয়োজনীয় প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলে এসব নোটিশে সতর্ক করা হয়।
ব্যাংকবধ
এস আলমের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি রপ্তানি-আমদানি ব্যবসা ও বিনিয়োগের মিথ্যা দাবি করে দেশের আটটি ব্যাংক থেকে বিভিন্ন নামে ঋণ নিয়ে প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন।
শেখ হাসিনার পতনের আগ পর্যন্ত দেশের আটটি ব্যাংক ও দুটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
আগস্টে ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠনের পর নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ জানান, এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির বিতরণ করা মোট ঋণের অর্ধেকেরও বেশি পেয়েছে।
চেয়ারম্যানের বিবৃতি অনুসারে, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক মোট এক লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ৯০ হাজার কোটি টাকা এস আলম গ্রুপ নিয়েছে।
সবচেয়ে বড় বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে দখল করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কেবল ইসলামী ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণই এস আলম গ্রুপের ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের অসাধু উপায় এবং দুর্নীতির গভীরতা প্রকাশ করে। একসময় সুস্থ থাকা ইসলামী ব্যাংক এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে আসার পর উল্লেখযোগ্য ঋণ দুর্নীতির কারণে তীব্র তারল্য সংকটে পড়েছিল।