পায়ুপথে নিশ্বাস নেয় স্তন্যপায়ী, মাতাল হয়ে হাঁটে কেঁচো: ২০২৪ সালের সবচেয়ে উদ্ভট বৈজ্ঞানিক গবেষণা
কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণীরা তাদের পায়ুপথের মাধ্যমে নিশ্বাস নিতে পারে— শুনতে অদ্ভুত লাগলেও গবেষণায় এমনটাই খুঁজে পেয়েছেন জাপানের কিছু বিজ্ঞানীরা। এর জন্য পুরষ্কারও জিতেছেন। ব্যতিক্রমী এই গবেষণাটি ২০২৩ সালের ইগ নোবেল পুরস্কারের অন্যতম বিজয়ী।
ইগ নোবেল পুরস্কার হলো অদ্ভুত ও ব্যতিক্রমী বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি স্যাটায়ারিক পুরস্কার, যা অ্যানালস অব ইমপ্রোবেবল রিসার্চ দ্বারা প্রদত্ত। গত বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় রাতে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এক অনুষ্ঠানে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
অন্য পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে রয়েছে মদ্যপ কেঁচোদের গতি নিয়ে একটি গবেষণা, যা দেখায় মদ্যপ কেঁচোরা অন্যান্য কেঁচোর তুলনায় ধীর গতির। এছাড়াও রয়েছে মৃত ট্রাউট মাছের সাঁতারের ধরণ নিয়ে একটি গবেষণা এবং প্রতি ১০ সেকেন্ডে গরুকে ভয় দেখানোর ফলে তার দুধ উৎপাদনে কী প্রভাব পড়ে তা নিয়ে একটি গবেষণা
পায়ুপথ দিয়ে নিশ্বাস নেওয়া: এক নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি?
টোকিও মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির গবেষক রিও ওকাবের নেতৃত্বে পরিচালিত এই গবেষণাটি দেখায় যে পায়ুপথের মাধ্যমে শ্বাস নেওয়া সম্ভব এবং এটি ভবিষ্যতে মানুষের শ্বাসকষ্টের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতে পারে। গবেষণাটি দেখিয়েছে যে ইঁদুর ও শূকর পায়ুপথ দিয়ে শ্বাস নিতে সক্ষম হয়েছে, যখন তাদের শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এ প্রক্রিয়ায় শরীরে অক্সিজেন প্রবেশ করানো হয় পায়ুপথের মাধ্যমে এবং এটি শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীদের জীবন রক্ষায় কার্যকর হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত মানুষের ওপর এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়নি, তবে গবেষণার ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক।
করোনা মহামারির সময় যখন হাসপাতালগুলোতে রোগীদের জন্য ভেন্টিলেটরের সংকট দেখা দেয়, তখন বিকল্প উপায়ে মানবদেহে অক্সিজেন প্রবেশ করানোর বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন জাপানি গবেষকরা। মূলত তারা শ্বাসযন্ত্রের রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকর হতে পারে কি না, তা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। আর এই গবেষণাই শরীর তত্ত্বে তাদের ইগ নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে।
ধীরগতির মাতাল কেঁচো
আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তেস হিরমান্সের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মদ্যপ কেঁচোরা, সজ্ঞানে থাকা অন্য কেঁচোদের চেয়ে তুলনামূলক ধীরগতি সম্পন্ন হয়।
গবেষণাটি বৈজ্ঞানিকভাবে দেখিয়েছে যে, পাঁচ শতাংশ ইথানল দ্রবণে ভেজানো কেঁচোরা অন্য কেঁচোদের চেয়ে প্রায় ৫০ সেকেন্ড বেশি সময় নিয়ে একটি গোলকধাঁধা অতিক্রম করে। এই গবেষণাটি বিজ্ঞানীদের ইগ নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে।
ব্যথা বেশি মানেই ভালো চিকিৎসা?
সন্তানরা আঘাত পেলে মা বাবারা প্রায়ই বলে থাকেন, 'যা ব্যথা দেয়, তাই ভালো করে'— সেই কথা যেন বাস্তবে প্রমাণিত হলো মধ্য ইউরোপের একটি গবেষণায়। গবেষণায় ৭৭ জন অংশগ্রহণকারীকে এমন একটি নাকের স্প্রে দেওয়া হয়, যার কোনো চিকিৎসাগত কার্যকারিতা ছিল না, কিন্তু তা ব্যবহার করলে ব্যথার সৃষ্টি হয়। অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেককে বলা হয়েছিল এটি একটি কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি।
ফলাফল থেকে দেখা যায়, যারা বেশি ব্যথা অনুভব করেছে, তারা বিশ্বাস করেছে যে এটি বেশি কার্যকর চিকিৎসা। এর চেয়েও আশ্চর্যের বিষয় হলো, গবেষকরা মনে করেন, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মানুষের মনে ইতিবাচক চিকিৎসার প্রত্যাশা তৈরি করতে পারে এবং ফলাফলে উন্নতি আনতে সহায়ক হতে পারে।
গরুর দুধ উৎপাদন: ভয় বনাম বিড়াল
গরুর ওপর এক বিচিত্র পরীক্ষা চালানো হয়েছে যেখানে দেখা গেছে, গরুর পিঠে একটি বিড়াল বসিয়ে দিলে তাদের দুধ উৎপাদনে কোনো পরিবর্তন হয় না। কিন্তু প্রতি ১০ সেকেন্ডে একবার গরুকে ভয় দেখালে তারা ৩০ মিনিটের জন্য দুধ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।
এই গবেষণার জন্য মরণোত্তর পুরস্কার জিতেছেন প্রয়াত ফোর্ডাইস এলি ও উইলিয়াম পিটারসন। ১৯৪০ সালের একটি গবেষণার জন্য তাদের এই সম্মান দেওয়া হয়েছে, যেখানে তারা গাভীর দুধ উৎপাদনের ওপর বিড়াল এবং শব্দের প্রভাব পরীক্ষা করেছিলেন।
একটি গাভীর দুধ দোহনের সময় তারা গাভীটির পিঠে একটি বিড়াল বসিয়ে দিয়েছিলেন এবং পাশ থেকে প্রতি ১০ সেকেন্ড পর পর দুই মিনিট পর্যন্ত কাগজের ব্যাগ ফাটিয়ে শব্দ করছিলেন। তারা মূলত এটি দেখতে চেয়েছিলেন যে বিড়াল ও শব্দের কারণে গাভীর দুধের পরিমাণে কোনো তারতম্য হয় কি না।
গবেষণাটি জার্নাল অব এনিম্যাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে তারা উল্লেখ করেন, শব্দ এবং বিড়ালের কারণে গাভী ভীত হয়ে পড়ে, আর ভীত গাভী সাধারণত কম দুধ উৎপাদন করে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ভয়ে গরুর দুধের গ্রন্থি শক্ত হয়ে যায়, যদিও ৩০ মিনিট পর তা ধীরে ধীরে শিথিল হয়।
মৃত ট্রাউট মাছের সাঁতার
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস সি. লিয়াও তার গবেষণায় মৃত এবং জীবিত ট্রাউট মাছের সাঁতারের ধরণ তুলনা করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, পানির স্রোতের অনুকূলে থাকলে জীবিত মাছ কম পরিশ্রম করে এবং স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়।
গবেষণায় জীবিত মাছের মাথার অবস্থান এবং মৃত ট্রাউটের মাথার অবস্থান তুলনা করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, জীবিত মাছের মাথার কোণ বেশি পরিবর্তনশীল এবং বৈচিত্র্যময়, যেখানে মৃত ট্রাউটের মাথার অবস্থান বেশ স্থির।
ক্ষেপণাস্ত্রের ভেতর কবুতর
ক্ষেপণাস্ত্র কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর উদ্দেশে ক্ষেপণাস্ত্রের ভেতরেই জীবিত কবুতর রাখার সম্ভাব্যতা অনুসন্ধানের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন প্রয়াত মার্কিন মনোবিজ্ঞানীয় বিএফ স্কিনার। এ পদ্ধতিকে তিনি 'ক্র্যাকপট' হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি কবুতর দিয়ে এর সফল পরীক্ষাও চালিয়েছিলেন। তার এই প্রস্তাবটি সে সময় বাতিল হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাখি ব্যবহার করে মিসাইল পরিচালনার পরিকল্পনা করার পর তিনি এটিকে একটি অদ্ভুত ধারণা বলে সতর্ক করেছিলেন। সম্প্রতি, আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন স্কিনারের ১৯৬০ সালের প্রস্তাবনাকে পুনরুজ্জীবিত করে এই পুরস্কার জিতেছে। প্রজেক্ট পিজন নামে এই গবেষণা প্রোগ্রামে পাখি ব্যবহার করে মিসাইল পরিচালনার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু পাখির অস্থিতিশীল আচরণের কারণে পরিকল্পনাটি পরিত্যাগ করা হয়।
চুলের ঘূর্ণন ও ভূগোল
মন্টপেলিয়ার হাসপাতাল এবং চিলির বিজ্ঞানীরা একটি মজার আবিষ্কার করেছেন: উত্তর গোলার্ধের মানুষের চুল দক্ষিণ গোলার্ধের মানুষের চুলের মতোই একই দিকে ঘোরে। গবেষকরা জানিয়েছেন, চুলের ঘূর্ণনের দিক কীভাবে নির্ধারিত হয়, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাই, এই আবিষ্কারের বৈশ্বিক প্রভাব বোঝা কঠিন।
কয়েন উল্টানোর অদ্ভুত গবেষণা
কয়েন উল্টানোর প্রক্রিয়ার জটিলতা বোঝার জন্য ৫০ জন গবেষক একটি বিশাল পরীক্ষা চালিয়েছেন। তারা স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিসংখ্যানের অধ্যাপক পারসি ডায়াকনিসের একটি তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য ৩ লাখ ৫০ হাজার ৭৫৭ বার কয়েন ছুঁড়ে মেরেছিলেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, কয়েন যেই পাশ থেকে ছুঁড়ে মারা হয়, সেটি ৫১ শতাংশ সময় সেদিকেই পড়ে। অর্থাৎ, কয়েনটি অর্ধেক সময় একই পাশেই থাকে। বিশাল সংখ্যক বার পরীক্ষার পরও এই প্রক্রিয়াটি নিয়ে নিশ্চিত কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকরা দেখিয়েছেন, কয়েনের ফলাফল আসলে পুরোপুরি র্যান্ডম নয়; এতে সামান্য ঝোঁক দেখা যায়।
এত বড় পরীক্ষা চালানো সত্ত্বেও ফলাফল তেমন সুনির্দিষ্ট নয়, তবে গবেষকরা দেখিয়েছেন, কয়েনের ফলাফল পুরোপুরি অনিয়মিত নয়; এতে সামান্য পক্ষপাত দেখা যায়, যা কয়েনের উল্টানোর প্রক্রিয়াকে কিছুটা প্রভাবিত করে।
বয়স নিয়ে প্রতারণা
বেশি বয়সে বেঁচে থাকা নিয়ে এক গোপন সত্য ফাঁস করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের গবেষক সল জাস্টিন নিউম্যান। তার গবেষণা অনুযায়ী, অতীতে এত শতবর্ষী মানুষ ছিল না, বরং অনেকে বয়স নিয়ে মিথ্যা বলেছিলেন।
দীর্ঘায়ু হওয়ার জন্য ভালো পুষ্টি, শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন এবং বংশগতির প্রভাব রয়েছে। কিন্তু অতীতে শতবর্ষী মানুষের সংখ্যা যাচাই করা কঠিন ছিল। বর্তমানে নির্ভরযোগ্য জন্মনিবন্ধন নথি পাওয়া যাচ্ছে, যার ফলে স্ব-ঘোষিত শতবর্ষীদের সংখ্যা ৮২ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে।
এছাড়া, শতবর্ষী ব্যক্তিদের জন্মতারিখের বেশিরভাগই এমন দিনে, যা ৫ দ্বারা বিভাজ্য; যা ইঙ্গিত দেয় যে তাদের বয়স নিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে। নিউম্যানের মতে, অনেকে পেনশন আগেভাগে পাওয়ার জন্য বয়স পরিবর্তন করেছিলেন।
গাছেরও দৃষ্টি আছে
জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলুলার ও মলিকুলার বোটানি ইনস্টিটিউটের গবেষক ফেলিপে ইয়ামাশিতা দাবি করেছেন যে গাছপালা 'দেখতে' পারে—এটি একটি সম্ভাব্য ধারণা।
প্লান্ট সিগন্যালিং এন্ড বিহেভিয়ার সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন, বোইকিলা ট্রাইফোলিওলাটা নামের এক ধরনের লতা আশেপাশের গাছের আকার ও আকৃতি শনাক্ত করতে পারে এবং সেগুলো নকল করার ক্ষমতা রাখে, এমনকি যদি সেই গাছগুলো প্লাস্টিকের তৈরি হয় তবুও।
এই লতা আশেপাশের পরিবেশ থেকে সংকেত গ্রহণ করে নিজের আকার পরিবর্তন করতে পারে। ইয়ামাশিতার মতে, এটি উদ্ভিদজগতের একটি অভিনব কৌশল যা তাদের বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতাকে নির্দেশ করে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন