চীনের ভ্যাকসিন গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সামরিক বাহিনী
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক বাহিনী রয়েছে চীনের। বিমান, নৌ ও সেনাবাহিনীর সম্মিলিত এ প্রতিরক্ষা বলয়- আনুষ্ঠানিকভাবে গণমুক্তি ফৌজ (পিএলএ) নামেই পরিচিত।
তবে সংখ্যায় সবচেয়ে বড় হলেও- চিকিৎসা বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক উদ্ভাবন বা গবেষণার জন্য পিএলএ ইতোপূর্বে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। সে অবস্থা এখন পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
মূলত, ২০১৫ সালেই সামরিক বাহিনী আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে বিভিন্ন খাতে এর গবেষণা সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছিল চীন সরকার। ওই সময়েই নিজ দেশের শীর্ষ স্থানীয় বেসামরিক বিজ্ঞানীদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া শুরু করা হয়। করোনার মহামারিতে যার সুফল পেয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতিটি।
নিজেদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রয়োগের জন্য বিশ্বের প্রথম অনুমোদিত কোভিড টিকা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন চীনা সামরিক গবেষকরা। যদিও এটি শুধুমাত্র পিএলএ সদস্য ও কর্মকর্তাদের দেহে প্রয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা অবশ্য এনিয়ে তীর্যক মন্তব্য করছেন।
চীনের জৈব-প্রযুক্তি শিল্প নিয়ে গবেষণাকারী মার্কিন বিশেষজ্ঞ অ্যাবিগেইল কাপলান তাদেরই একজন। নিউইয়র্কের ভেসার কলেজের এ বিশেষজ্ঞ বলেন, 'মনে হচ্ছে, চীনের সামরিক বাহিনী এ সঙ্কটকে ইতিবাচক জনসংযোগের কাজে লাগাচ্ছে।'
তবে সমালোচনার আগে পিএলএ বিজ্ঞানীদের অবদানের দিকেও নজর দেওয়া দরকার।
টিকা তৈরির গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, বেইজিং ইনস্টিটিউড অব বায়োটেকনোলজির চিকিৎসা বিজ্ঞানী মেজর জেনারেল চেন ওয়েই। তার নেতৃত্বে গবেষণা দলটিতে; নানা সরকারি গবেষণা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিয়ানজিন ভিত্তিক ওষুধ প্রস্তুতকারক - ক্যানসাইনো বায়োলজিক্স-এর গবেষকরা অংশ নেন।
খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশের জন্য বিখ্যাত একটি জার্নালে- গবেষক দলটি টিকা পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করে। যা ছিল বিশ্বের প্রথম দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফলাফল প্রকাশ।
নিবন্ধে গবেষকরা জানান, তাদের তৈরি প্রার্থী ভ্যাকসিনটি নিরাপদ এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও করোনার জীবাণুর বিরুদ্ধে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছে। ওই ফল প্রকাশের আগেই অবশ্য চীন সরকার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ভ্যাকসিনটি প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছিল। চূড়ান্ত ধাপ বা তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা সম্পন্ন না করেই- এ অনুমোদন দেওয়ায়, তা নিয়েই সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অনেক পর্যবক্ষক।
তবে ফলাফলে ব্যাপক সফলতা না আসলে চীন এটি সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেওয়ার অনুমতি দিত না; সাধারণ জ্ঞান অন্তত সেদিকেই ইঙ্গিত দেয়। তারপরও, কতজন সদস্য এ টিকা পাবেন বা এটি নেওয়া বাধ্যতামূলক কিনা- সেসব বিষয় গোপন রাখে চীন। ফলে অনেকেই একে একটি প্রচারণার উপকরণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
গবেষণার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চেন ওয়েই এবং বেইজিং ইনস্টিটিউড অব বায়োটেকনোলজির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিখ্যাত সাময়িকী- নেচার ম্যাগাজিন। কিন্তু, চেন বা তার সংস্থা টিকা গবেষণার বিস্তারিত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
''যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সমর্থিত ভ্যাকসিন গবেষণার আগে যদি চীনের তৈরি টিকাটি গণপ্রয়োগের অনুমোদন লাভ করে- তাহলে বেইজিং প্রোপাগান্ডা যুদ্ধে বিজয়ী হবে। এ বিজয় তার ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত ও ছোট করেও দেখাবে'' বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ান জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চীন বিশ্লেষক অ্যাডাম-নি।
এধরনের সমালোচনার পরও একটা বিষয় স্পষ্ট। পিএলএ শুধু টিকা তৈরির গবেষণায় ভূমিকা রাখনি, বরং দেশটিতে মহামারি নিয়ন্ত্রণে আনার পেছনেও তাদের অবদান ছিল অতি-গুরুত্বপূর্ণ। এনিয়ে অবশ্য ঘর সমালোচকেরাও তাদের নিষ্ঠার প্রশংসা করেছেন।
শুধু চীনে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মহামারি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পাঠানো হয়েছে সামরিক চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত সেনা সদস্যদের। তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের মাধ্যমে নানা দেশের সরকার ও জনগণের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে উঠছে চীনের।
অবশ্য শুধু চীন নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সামরিক বাহিনীও ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণায় কাজ করছে, সহায়তা দিচ্ছে বেসামরিক সংস্থার প্রার্থী ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ কার্যক্রমে।
তবে পিএলএ'র বিশাল আয়তন এবং যে গতিতে তারা সংস্কার ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতিতে তাদের অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে; তা বিস্ময়কর। যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু দেশের জন্যে যা মাথাব্যথার কারণও বটে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উত্তেজনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যা আরও বাড়ছে।
গত কয়েক মাস ধরে, মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন, চীন নাকি যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি এবং বিশ্ববিদ্যালয় গ্রুপগুলোর চলমান টিকা গবেষণা তথ্যচুরির উদ্দেশ্যে গুপ্তচরবৃত্তি চালাচ্ছে। আবার মার্কিন বিজ্ঞানীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সামরিক বাহিনীর মধ্যে দেওয়া এ ভ্যাকসিন সব বয়স ও শারীরিক অবস্থার মানুষকে দেওয়ার ফলাফল বিপজ্জনক হতে পারে।
এসব কিছুর প্রেক্ষিতে চীনের টিকা উদ্ভাবন ও সামরিক বাহিনীর চিকিৎসা গবেষণার ইতিহাসের দিকে এক নজরে তাকানোটাও দরকার।
প্রাধান্য পেয়েছে বিজ্ঞান:
''২০১৫ সালে সামরিক বাহিনীর উদ্ভাবনী সক্ষমতা বাড়াতে সংস্কারের ঘোষণা দেন, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যার ভিত্তিতেই নানা ক্ষেত্রের গবেষণায় নতুন দিগন্ত সূচিত হয়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নকে মূল লক্ষ্যের কেন্দ্রে রাখা হয়,'' জানিয়েছেন এলসা কানিয়া। তিনি ওয়াশিংটন ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিক্যুরিটির চীনা সামরিক কৌশল বিশেষজ্ঞ।
তিনি জানান, আধুনিকায়নের সুবাদে সাইবার এবং মহাকাশ যুদ্ধ পরিচালনা শাখা যুক্ত হয়েছে পিএলএ'তে। পাশপাশি, বেড়েছে বিমান, নৌ ও সেনা বাহিনীর ব্যবহৃত আধুনিক সমরাস্ত্রের পরিমাণ ও গুণগত মান। নানা খাতে নিজস্ব উদ্ভাবনী সক্ষমতা বাড়াতে এধরনের ১৫টি নতুন শাখা যোগ হয়।
অস্ট্রেলীয় বিশেষজ্ঞ অ্যাডাম-নি বলেন, '৭০-৮০ এর দশকের পিছিয়ে থাকা সামরিক বাহিনী থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে সাম্প্রতিক দশকে। আগের বিশাল কিন্তু প্রযুক্তিগত অনগ্রসর বাহিনীটি এখন পরিণত হয়েছে ভয়ঙ্কর এক শক্তিতে।'
আধুনিকায়নের প্রভাব পড়েছিল চীনের অ্যাকাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সেস পুনর্গঠনে। তার কারণেই আজ তারা Ad5-nCoV ভ্যাকসিনটি উৎপাদনে সফল অবদান রাখতে পেরেছে।
বেসামরিক নিয়োগ:
সংস্কারের আগে চীনা সামরিক বাহিনী তাদের পরিচালিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বা নিজ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে থেকে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিত। বেসামরিক বিশেষজ্ঞরা সে সুযোগ পেতেন না। তাছাড়া, সামরিক বাহিনীর কম বেতন ও সুবিধার চাকরিও বেসরকারি খাতের দক্ষ কর্মীদের জন্য আকর্ষণীয় ছিল না।
অ্যাডাম নি জানান, ২০১৮ সালের পর থেকে এই অবস্থার উলেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। বেশি বেশি করে বেসরকারি খাতের প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করে চীনা গণমুক্তি ফৌজ। বিশেষ করে, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
২০১৮ সাল থেকে এপর্যন্ত দেশটির অ্যাকাডেমি অব মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সেস- ২১৩জন বেসরকারি খাতের বিজ্ঞানীকে নিয়োগ দিয়েছে। সামরিক বাহিনীর সকল গবেষণা শাখার মধ্যে এ নিয়োগ ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। লন্ডন ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউড ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের বিশেষজ্ঞ- কাই লিন তে' একথা জানিয়েছেন।
শুধু নিজস্ব গবেষণার পরিধি নয়, অসামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গেও সম্পৃক্ততা বেড়েছে গণমুক্তি ফৌজের। একে সামরিক ও অসামরিক খাতের এক সম্মীলন বলা হচ্ছে। তাছাড়া, একইসঙ্গে চীনা সামরিক বাহিনীতে স্নাতক সদস্যের সংখ্যাও বেড়েছে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর অবদান বলিষ্ঠ করার এসব পদক্ষেপ; চীনের জন্য ইতিবাচক হয়েছে নিঃসন্দেহে। আর এটাই পশ্চিমের উদ্বেগের মূল কারণ।