পাহাড়ে চলমান সহিংসতা ও আগ্রাসন রুখে দেওয়ার আহ্বানে নাগরিক বিবৃতি
তিন পার্বত্য জেলায় সাম্প্রতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে গভীর উদ্বেগ, তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের ৬২৪ নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন।
রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) এক লিখিত বিবৃতিতে তারা এ নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, 'এই সহিংসতায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় সেনাবাহিনীর গুলিতে জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০) এবং ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটিতে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক আদিবাসী যুবক মর্মান্তিকভাবে হত্যার শিকার হন। ভাংচুর ও লুটপাট করা হয় রাঙামাটির বনরূপা মৈত্রী বিহারে। পুড়িয়ে দেয়া হয় আদিবাসীদের দোকানপাট ও ঘরবাড়ি; সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে পথে নামেন অনেক আদিবাসী।'
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের ৭ এপ্রিল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলমান সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে ১০০-এর বেশি আদিবাসীকে সন্ত্রাসী সন্দেহে নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় তিন যুগ পরেও এবং গত ৫ অগাস্ট ২০২৪-এ বাংলাদেশে গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মাধ্যমে পাহাড়ে এখনও আদিবাসী নির্যাতন বন্ধ হয়নি।'
'বাংলাদেশের আদিবাসীরা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সমান অধিকার এবং সামাজিক অর্থনৈতিক সকল পর্যায়ে সমান অংশগ্রহণের জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ এবং ৩২ নাম্বার অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার এবং বৈষম্যহীন যাপনের রাষ্ট্রীয় অধিকার কাগজে-কলমে থাকলেও আজ পর্যন্ত আদিবাসীরা তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা এবং জাতিসত্ত্বার পরিচিতির স্বীকৃতি এবং মর্যাদা পাননি। মাত্র ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার পাহাড়ে রয়েছে ছয়-ছয়টি সেনানিবাস এবং অসংখ্য সেনা ছাউনি। পাহাড়ে একদিকে জারি রয়েছে স্বৈরাচারী সেনাশাসন, অন্যদিকে অবৈধ "সেটেলার"দের আরোপ করা জাতিগত বৈষম্য, নিপীড়ন ও অধিকার-হরণ। এই দুইয়ের সম্মিলিত আগ্রাসনে আদিবাসীদের অস্তিত্বই আজ সংকটের মুখে।'
সাম্প্রতিক সহিংসতা বিভিন্ন অপপ্রচারের মোড়কে চলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাতেরই ধারাবাহিকতা বলে উল্লেখ করে, বিবৃতিতে বাঙালি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে অবিলম্বে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—
১। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধ এবং বন্ধ করতে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২। সহিংসতার উৎস সন্ধানে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত এবং দোষীদের যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩। ক্ষতিগ্রস্ত ও হুমকির মুখে থাকা আদিবাসী সম্প্রদায়গুলিকে পরিপূর্ণ সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদান করতে হবে এবং আহতদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
৪। আদিবাসীদের জাতিসত্ত্বার সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং সেইসাথে তাদের ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিরও যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে।
৫। পাহাড়ে দখলদার অভিবাসীর বিস্তৃতি রোধ করতে হবে এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৬। পাহাড়ে অলিখিত সেনাশাসন বন্ধ করতে হবে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, 'জাতি ও ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশের সমস্ত সম্প্রদায় যেন নিরাপদ বোধ করে এবং আত্মসম্মানের সাথে জীবন যাপন করতে পারে তা নিশ্চিত করা আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসীন ব্যক্তিবর্গের আন্তরিক মনোযোগ এবং তাৎক্ষণিক ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। একই সাথে একটি ঐক্যবদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ নাগরিক ও সামাজিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার লক্ষে বাঙালি এবং বাংলাদেশের ভিন্ন জাতিসত্তার গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংলাপ এবং বোঝাপড়াকে উৎসাহিত করে এমন উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানাচ্ছি।'