দ্রুতগতির করোনা পরীক্ষা আসছে: কী করা যাবে, কী যাবে না
কোভিড-১৯ অতিমারিতে প্রাণহানির সংখ্যার পৃথিবীর অন্য সকল দেশের চাইতে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, এখনও সংক্রমণ শনাক্তকরণে পরীক্ষা পদ্ধতির ক্ষেত্রে ছোট বা বড় অনেক দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে শীর্ষ পরাশক্তিটি। যা একইসঙ্গে বিস্ময়কর এবং হতাশাজনক। তবে খুব দ্রুত সে অবস্থা বদলের ইঙ্গিত মিলছে।
গত আগস্টের শেষেই যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) ক্রেডিট কার্ড আকারের তুলনামূলক ছোট টেস্টিং সরঞ্জাম জরুরীভিত্তিতে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। এর দাম পড়ছে মাত্র ৫ ডলার, আর ফলও পাওয়া যায় ১৫ মিনিটের মধ্যে। নমুনা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করতে কোনো বাড়তি যন্ত্র বা ল্যাবরেটরি দরকার হয় না।
মার্কিন সরকার চিকিৎসা খাতের বেসরকারি গবেষণা কোম্পানি অ্যাবট ল্যাবরেটরিজকে এজন্য ৭৬ কোটি ডলার ব্যয়ে এধরনের ১৫ কোটি কিট প্রস্তুতের ক্রয়াদেশ দিয়েছে। অক্টোবরের মধ্যেই মাসপ্রতি কিট উৎপাদন সক্ষমতা ৫ কোটিতে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে অ্যাবট।
এসব কিট আসলে মানবদেহে নির্দিষ্ট কিছু প্রোটিন বা অ্যান্টিজেন শনাক্ত করে। অ্যান্টিজেন থাকে করোনাভাইরাসের কাঁটাসদৃশ আবরণে। এটিই মানবকোষের সঙ্গে ভাইরাসকে যুক্ত হতে সাহায্য করে। আর তাই শরীরে এর উপস্থিতি শনাক্ত করা গেলে- পরীক্ষাধীন ব্যক্তির সংক্রমণ চিহ্নিত করা যায়।
বিশেষ করে, সদ্য সংক্রমিত কোনো ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানোর প্রথমদিকে অ্যান্টিজেনের তীব্র উপস্থিতি থাকে, ফলে তখন পরীক্ষা করা গেলে সহজেই সংক্রমণ ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বাড়ে। এ পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণঘাতি জীবাণুটির বিস্তারের লাগাম টেনে ধরতে যুগান্তকারী প্রভাব যোগ করতে পারে।
বয়স্ক বা ডায়াবেটিসের মতো দূরারোগ্য আক্রান্ত সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জীবন রক্ষায় এটি সাহায্য করবে। কারণ, এদের মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তার লাভের গতিটাও থাকে বেশি। এক কথায় বলা যায়, সহজে ও ঝামেলামুক্ত পরীক্ষা পদ্ধতিটি মহামারি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হতে পারে।
ইতালি এবং ভারতের মতো অতিমারিতে ব্যাপক প্রভাবিত কয়েকটি দেশে, এমনতর অ্যান্টিজেন শনাক্তের পদ্ধতি তাদের সংক্রমণ শনাক্তের জাতীয় কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে।
কারণ, অ্যান্টিজেন বিশ্লেষণ ব্যয়বহুল প্রথমসারির পরীক্ষা পদ্ধতির তুলনায় অনেক সস্তা। উচ্চমানের পরীক্ষা যেমন ভাইরাসের আরএনএ শনাক্তের পদ্ধতি পলিমেরাস চেইন রি-অ্যাকশন পরীক্ষার চেয়ে -তা অনেক কম সময়েও ফলাফল জানায়। কিন্তু, অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় ভুলের ঝুঁকিও কম নয়। কারণ, পিসিআর পদ্ধতির মতো এটি সংবেদনশীল নয়, যা সার্স কোভ-২ ভাইরাসের অতি-সামান্য পরিমাণ উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে।
এ পার্থক্যই জনস্বাস্থ্য বিশারদ ও বিজ্ঞানী মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তাদের শঙ্কা, অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় কিছুটা ভুলের যে সম্ভাবনা থাকে, তা অনেক সময় প্রকৃত সংক্রমিত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হতেই পারে। এসব টেস্ট চালু থাকা অনেক দেশেই ইতোমধ্যেই তা হয়েছে। যার কারণে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আসা তাদের প্রাথমিক সফলতাও এখন অনেকটাই উবে গেছে। উজ্জ্বল উদাহরণ প্রতিবেশী দেশ; ভারত।
তাছাড়া, অর্থনৈতিক উত্তরণের তাগিদে বিশ্ব যেভাবে উন্মুক্তকরণের পথে হাঁটছে; তাতে অনেক বিমান বন্দরেও চালু হতে পারে দ্রুত পরীক্ষার পদ্ধতি। ফলে যেসব দেশে সংক্রমণ এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেখানে জীবাণুর বিস্তার ঘটতে পারে ভ্রমণকারীদের মাধ্যমে।
কিছু বিশেষজ্ঞ অবশ্য অ্যান্টিজেন পদ্ধতির সংবেদনশীলতার অভাবকে একটি বিশেষ গুণ হিসেবেই বিবেচনা করছেন। তারা বলছেন, পিসিআর পদ্ধতির সংবেদনশীলতার কারণে; যেসব ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার পর অনেকটাই সেরে উঠেছেন এবং যাদের মাধ্যমে জীবাণু বিস্তারের ঝুঁকি নেই বললেই চলে- তারাও পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হচ্ছেন। অ্যান্টিজেন পদ্ধতি এ দ্বিধার অবসান ঘটিয়ে যোগ করতে পারে- শুধুমাত্র বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রোগী চিহ্নিতের সম্ভাবনা।
বর্তমানে শুধু প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমেই অ্যান্টিজেন টেস্টের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন দেশে। যদিও, কিছু কোম্পানি সহজে বাড়িতে বসেই পরীক্ষা করা যায় এমন কিছু কিট তৈরি করছে।
বাংলাদেশে সর্ব-সাধারণের ব্যবহারযোগ্য এমন একটি কিট তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করেছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। কিন্তু, সরকারের ওষুধ প্রশাসন ৯০ ভাগ সফল সংক্রমণ শনাক্তের যে উচ্চস্তর বেঁধে দিয়েছে, তা পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়াতেই কিটটির অনুমোদন দেওয়া হয়নি, বলে জানানো হয়েছে।
করোনা শনাক্তে বাংলাদেশে এপর্যন্ত শুধু আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনাভাইরাস টেস্ট করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৯৪টি ল্যাবে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা টেস্ট করা হচ্ছে। যদিও গত ২৪ আগস্ট সরকার দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তে অ্যান্টিজেন টেস্টের অনুমোদন দিয়েছে। তবে সেটা শুধু সরকারি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
এখন পর্যন্ত দেশে সর্ব-সাধারণের অ্যান্টিজেন টেস্ট শুরু হয়নি। কবে নাগাদ শুরু হবে- সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। যদিও সরকারের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গত ৩ জুন করোনা শনাক্তে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার পাশাপাশি অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করার সুপারিশ করেছিল।
দেশে করোনা সংক্রমণের শুরুতে ১৮ মার্চ র্যাপিড অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন টেস্ট কিট উদ্ভাবনের ঘোষণা দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তবে এখন পর্যন্ত ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন পায়নি গণস্বাস্থ্যের র্যাপিড টেস্ট কিট।
দেশে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু থাকলে সংক্রমণ হার ও প্রাণহানি হয়তো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেতো। তবে এনিয়ে বিশেষজ্ঞরা কিন্তু অনেক সতর্ক।
ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ মার্টিন বার্কে বলেন, ''সহজে, দ্রুততার সাথে এবং কম খরচে পরীক্ষা করাটাই প্রধান লক্ষ্য এখন মার্কিন সরকারের। আর এ লক্ষ্য অর্জনে অ্যান্টিজেন পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই।''
বর্তমানে মার্টিন অ্যান্টিজেন বিশ্লেষণে বেশ কিছু পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টায় জড়িত। তিনি জানান, ''এটা নির্ভুল কোনো সমাধান নয়, তবে খুব দ্রুত সংক্রমণ শনাক্তের জন্যেই এ পদ্ধতিটি আমাদের জন্য দরকারি হয়ে উঠেছে।''
কয়টি পরীক্ষা আছে এবং সেগুলো কীভাবে কাজ করে?
কোভিড-১৯ রোগ শনাক্তের মূল প্রকারভেদ দুইটি; পিসিআর- এর মতো ডায়াগণোস্টিক ধাঁচের পরীক্ষা এবং অ্যান্টিজেন বিশ্লেষণ। দ্বিতীয়টি ভাইরাসের অংশবিশেষ শনাক্ত করতে পারে। এছাড়া, এর আওতায় আছে অ্যান্টিবডি টেস্ট যা মানবদেহে ভাইরাস সংক্রমণ হলে রক্ত রসে প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার চেষ্টা হিসেবে তৈরি হওয়া প্রোটিন শনাক্ত করে।
অ্যান্টিবডি তৈরিতে সংক্রমণের পর বেশকিছু দিন সময় লাগতে পারে। আর কেউ সংক্রমণ মুক্ত হওয়ার পরও তার দেহে কয়েক সপ্তাহজুড়ে এর উপস্থিতি থাকে। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, অ্যান্টিবডির শনাক্তের পদ্ধতিটির মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানার সুযোগ বেশ সীমিত।
সেই তুলনায় অতি-সংবেদনশীল পিসিআর পরীক্ষায় দক্ষ টেকনিশিয়ানদের মাধ্যমে শতভাগ সফলতা পাওয়া যায়; আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্তে। তবে সমস্যা হচ্ছে, এরজন্য যেমন দক্ষ কর্মী দরকার হয়, তেমনি দরকার হয় মানসম্মত এবং দামি রি-এজেন্ট এবং যন্ত্রপাতি। এভাবে ফলাফল পেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে।
দক্ষিণ কোরিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মতো কিছু দেশ- পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষার পরিমাণ বৃদ্ধি করতে উল্লেখযোগ্য সফলতা লাভ করে। কিন্তু, বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ পদ্ধতির আকার বড় পরিসরে করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশেও ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এক পর্যায়ে নমুনা জটের অসংখ্য খবর প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রেও খুব ধীর গতিতে প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে, বলে অভিযোগ রয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ নমুনা সংগ্রহ চক্রের কারণে মার্কিন সরকারের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ কেন্দ্রের করা অল্পকিছু পরীক্ষার ফল ভুল প্রমাণিত হয়। যা প্রতিষ্ঠানটির সুনামহানি করেছে। একইসময়ে যুক্তরাষ্ট্রে অব্যাহত ছিল গণ সংক্রমণ। বুধবার (১৬ সেপ্টেম্বর) নাগাদ এতে মারা গেছেন প্রায় ২ লক্ষাধিক মার্কিন নাগরিক।
সাধারণ একটি অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী তুলো লাগানো কাঠির মাধ্যমে কারো নাক বা গলা থেকে নমুনা সংগ্রহ করেন। কিছু কোম্পানি এখন মুখের লালা থেকেও ভাইরাস শনাক্তের কিট তৈরির চেষ্টা চলছে। সোয়াবের মাধ্যমে এ নমুনা যথেষ্ট পরিমাণে এবং সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব। এরপর এসব নমুনা মিশ্রিত তুলা একটি বিশেষ রাসায়নিক দ্রবণে ডুবানো হয়, যা ভাইরাসকে বিভাজিত করে এবং বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিনকে অণুজীবের দেহ থেকে মুক্ত করে। এরপর দ্রবণটির কয়েক ফোটা একটি কাগজের পাতায় ফেলা হয়। কাগজটিতে থাকে এক ধরনের অ্যান্টিবডি, যা এসব প্রোটিনের উপস্থিতি পেলেই তার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে। পরীক্ষায় কেউ সংক্রমিত কিনা তা বোঝা যায়, কাগজের রঙ উজ্জ্বল নীল আভা বা কালো রঙ ধারণ করলে।
৩০ মিনিটের কম সময়ে ফলাফল দিতে পারে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা। এজন্য দরকার হয় না কোনো গবেষণাগার। আর কিট প্রস্তুত করাও সস্তা। কিন্তু, তাদের সংবেদনশীলতা কম হওয়াটাই প্রধান সমস্যা। যা আরও নির্ভুল করার চেষ্টায় দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন বিজ্ঞানীরা।
- সূত্র: নেচার ডটকম