ইরানের হামলা ঠেকাতে ব্যয়বহুল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহারে বাধ্য হয়েছে ইসরায়েল
মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) রাতে ইসরায়েলে প্রায় ১৮০টি উচ্চ গতির ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এই হামলা থেকে বোঝা যায়, এপ্রিল মাসের তুলনামূলক কম গুরুতর ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার তুলনায় এবারের হামলায় ইসরায়েলের বড় ক্ষতি করার আগ্রহ ছিল তেহরানের।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের দ্রুত গতির কারণে সেগুলো প্রতিরোধ করা কঠিন। তবে ইসরায়েলে কোনও প্রাণহানি না হওয়া এবং পশ্চিম তীরে কেবল একটি প্রাণহানি হওয়ার প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, কিছু সংখ্যক ক্ষেপণাস্ত্র মাটিতে আঘাত হানলেও, এটি ইরানের জন্য একটি সামরিক ব্যর্থতা ছিল।
ইরানের ব্যবহৃত এমাদ ও গাদর ক্ষেপণাস্ত্রের গতি শব্দের গতির থেকে ছয়গুণ বা তার বেশি এবং ১২ মিনিট সময় লাগে ইরান থেকে উড়ে যেতে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর গতি ঘণ্টায় ৪ হাজার ৬০০ মাইল বা তার বেশি হতে পারে। তবে ইরান দাবি করেছে, মঙ্গলবারের হামলায় আরও দ্রুতগতি, হাইপারসনিক ফাতেহ-২ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, যেটির সর্বোচ্চ গতি ১০ হাজার মাইল প্রতি ঘণ্টা।
ইরানের কাছে প্রায় ৩ হাজার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আড়াই বছর আগে এ হিসাব করায়, বর্তমানে ক্ষেপণাস্ত্র সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। তেহরান হয়ত চেয়েছিল, ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশ মজুদ ধরে রাখতে, যাতে ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত পুরোপুরি যুদ্ধে রূপ নিলে সেগুলো ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
কয়েক মিনিটের মধ্যে এতগুলো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র চালু করা ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করার একটি গুরুতর প্রচেষ্টা। কারণ এগুলো উন্নত প্রযুক্তির, এগুলোতে ব্যবহৃত প্রতিরোধক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ব্যয়বহুল এবং তার চেয়ে বড় কথা– সেগুলোর মজুদ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো মাঝ আকাশেই আটকানোর কাজ প্রধানত দীর্ঘ-পাল্লার মার্কিন-ইসরায়েলি অ্যারো ৩ এবং অ্যারো ২ সিস্টেমের, যা প্রথমবারের মতো ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়েছিল। মধ্য-পাল্লার ডেভিডস স্লিং সিস্টেম এগুলোকে পরিচালিত করতে ব্যবহার করা হয়। আরও পরিচিত আয়রন ডোম সিস্টেমটি স্বল্প পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের জন্য ব্যবহার করা হয়, যা প্রায়ই গাজা থেকে হামাসের ছোড়া রকেট আটকানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
এপ্রিলে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) প্রধানের সাবেক আর্থিক উপদেষ্টা বলেছিলেন, একটি অ্যারো ক্ষেপণাস্ত্রের দাম সাধারণত ৩.৫ মিলিয়ন ডলার এবং ডেভিডস স্লিং ইন্টারসেপ্টরের দাম ১ মিলিয়ন ডলার। ১০০টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করতে গেলে খরচ হয় শত শত মিলিয়ন ডলার, যেখানে প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রের পেছনে ইরানকে খরচ করতে হয় প্রায় ১ লাখ ডলারের মতো।
সে সময় তেহরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান বলেছিলেন, তারা প্রতিবেশী দেশগুলোকে একটি পরিকল্পিত হামলা চালানোর জন্য ৭২ ঘণ্টার নোটিশ দিয়েছেন। দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে ইসরায়েলি বোমা হামলার দুই সপ্তাহ পর এ হামলা চালানো হয়। এবারের হামলা শুক্রবার হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে চালানো হয়েছে।
মঙ্গলবার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উৎক্ষেপণের কয়েক ঘণ্টা আগে মার্কিন সূত্র থেকে হামলার পূর্বাভাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কীভাবে এই তথ্য পাওয়া গেছে তা পরিষ্কার না হলেও, এটি স্যাটেলাইট চিত্র, যোগাযোগের তথ্য বা একটি কূটনৈতিক নোটিফিকেশন থেকে আসতে পারে। হামলার আগে ইরান সম্ভবত রাশিয়াকে বিষয়টি জানিয়েছিল বলে আলাপ থাকলেও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
কতগুলো ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের মাটিতে আঘাত হেনেছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। এপ্রিলে ইরানের চালানো হামলায়, ১২০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে মাত্র ৯টি ইসরায়েলে পৌঁছেছিল, এবং দুটি বিমানঘাঁটিতে সামান্য ক্ষতি করতে পেরেছিল। যার মানে, সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেই হামলাও ব্যর্থ ছিল।
ইরান এপ্রিল মাসে ৩০০-এর বেশি ড্রোন, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছিল। তবে মঙ্গলবার তারা ধীর গতির ড্রোনগুলো বাদ দিয়েছে—যেটি ইঙ্গিত দেয়, প্রতিপক্ষের উন্নত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এগুলো কার্যকর মনে হচ্ছে না। ইরান সম্ভবত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেনি।
শাহেদ ড্রোন, যেটি রাশিয়া ইউক্রেনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে, তুলনামূলকভাবে ধীর গতির এবং ফাইটার জেট দিয়ে সেগুলো সহজেই ধ্বংস করা যেতে পারে। ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো বিমান প্রতিরক্ষা এড়াতে গতিশীলতার ওপর নির্ভর করে, তবে সেগুলোর গতি ব্যালিস্টিক অস্ত্রের তুলনায় ধীর গতির। ইরানের পাভেহ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের গতি প্রায় ৫০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা।
রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ শুরু করার পর থেকেই ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। আগস্টে ইউক্রেনের প্রকাশিত প্রতিরোধের হার থেকে দেখা যায়, ইসরায়েলের তুলনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকানোর সফলতা ইউক্রেনের কম। এর কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চলার জন্য ইউক্রেনের সম্ভবত কিছু স্বল্প-পাল্লার প্রতিরোধক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদ শেষ হয়ে গেছে।
ইউক্রেনের প্রধান কমান্ডার ওলেকসান্দ্র সিরস্কি বলেছেন, ৬৩ শতাংশ ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে এবং ৬৭ শতাংশ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র আটকানো হয়েছে। তবে রাশিয়ার ব্যালিস্টিক মিসাইলের ক্ষেত্রে এই হার ৪.৫ শতাংশে নেমে এসেছে।