‘সাদাসিধে’, ‘নিরহংকার’ রতন টাটা যেভাবে বিজনেস টাইকুন হয়ে উঠলেন
৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত রতন টাটা ছিলেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যবসায়ী নেতাদের অন্যতম। খবর বিবিসির।
তিনি দুই দশকেরও বেশি সময় টাটা গ্রুপের নেতৃত্ব দিয়েছেন। 'সল্ট-টু-সফটওয়্যার' নামে পরিচিত এ শিল্পগোষ্ঠীর কোম্পানিসংখ্যা ১০০টিরও বেশি। এ গ্রুপে প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষ কর্মরত। গ্রুপটির বার্ষিক আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
টাটা গ্রুপের গোড়াপত্তন ভারতীয় ব্যবসার অগ্রদূত জামসেদজি টাটার হাতে। ১৫৫ বছরের প্রাচীন টাটা গ্রুপের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার ও টাটা স্টিল থেকে শুরু করে বিমান ও লবণের ব্যবসাও পর্যন্ত বিস্তৃত।
টাটা গ্রুপের ওপর লেখা অনুমোদিত বই 'দ্য স্টোরি অভ টাটা'র লেখক পিটার কেসির মতে, কোম্পানিটির নীতি হচ্ছে, 'পুঁজিবাদকে মানবসেবার সঙ্গে যুক্ত করা, এমনভাবে ব্যবসা করা যা অন্যদের জীবনকে আরও ভালো করে'।
পিটার কেসি জানান, এ গ্রুপের হোল্ডিং কোম্পানি টাটা সান্স-এ অনেকগুলো কোম্পানি রয়েছে, যা মূলত জনহিতকর ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়।
রতন টাটার জন্ম ১৯৩৭ সালে, একটি ঐতিহ্যবাহী উচ্চ শিক্ষিত ও সম্পদশালী পার্সি পরিবারে। তার পরিবার ভারতে জরথুস্ট্রিয়ান উদ্বাস্তুদের বংশধর। ১৯৪০-এর দশকে তার বাবা-মা আলাদা হয়ে যান।
রতন টাটা যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যে ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে কাটানো সাত বছরে তিনি গাড়ি ও বিমান চালনা শেখেন। বিমান চালানো নিয়ে তার কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়। একবার তিনি কলেজে হেলিকপ্টার ওড়ানোর সময় ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়, বিমান ওড়ানোর সময়ও দুবার সিঙ্গেল ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। তাকে তখন গ্লাইড করতে হয়। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রায়ই নিজের কোম্পানির ব্যবসায়িক জেট বিমান ওড়াতেন।
১৯৬২ সালে দাদি লেডি নবাজবাই অসুস্থ হয়ে পড়লে রতন টাটা ভারতে ফিরে আসেন। তখন টাটা পরিবারের আরেকটি শাখার আত্মীয় জেআরডি টাটা তাকে টাটা গ্রুপে যোগ দিতে বলেন। তার সম্পর্কে রতন টাটা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'তিনি [জেআরডি টাটা] ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় মেন্টর…আমার কাছে তিনি একজন পিতা এবং ভাইয়ের মতো ছিলেন।'
রতন টাটাকে পূর্ব ভারতের জামশেদপুরে একটি কোম্পানির ইস্পাত কারখানায় পাঠানো হয়। সেখানে তিনি কয়েক বছর ফ্যাক্টরি ফ্লোরে কাটান, পরে ব্যবস্থাপকের কারিগরি সহকারী হন।
১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে তিনি গ্রুপের দুটি রুগ্ণ কোম্পানির দায়িত্ব নেন—একটি রেডিও ও টিভি, অন্যটি টেক্সটাইল। তিনি প্রথম কোম্পানির অবস্থার উন্নতি করতে পারেন, তবে টেক্সটাইল কোম্পানিতে মিশ্র ফলাফল পান।
১৯৯১ সালে ৫৩ বছরের বেশি সময় ধরে গ্রুপের নেতৃত্ব দেওয়া জেআরডি টাটা অন্যান্য সিনিয়র প্রতিযোগীদের পেছনে ঠেলে রতন টাটাকে তার উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দেন। রতন টাটা পরে বলেছিলেন, 'ওই সময়ের পত্রপত্রিকা ঘাঁটলে দেখবেন, সমালোচনা ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। জেআরডির বিরুদ্ধে স্বজনতোষণের অভিযোগ আনা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, আমাকে নিয়োগ দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত।'
পিটার কেসি লিখেছেন, রতন টাটার নেতৃত্বে একটি 'বিশাল কিন্তু কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ ভারতীয় প্রস্তুতকারক ভোগ্যপণ্যের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে আবির্ভূত হতে শুরু করে।
কিন্তু এ যাত্রা ছিল মিশ্র।
রতন টাটার মেয়াদকালে গ্রুপটি অনেক সাহসী অধিগ্রহণ করেছে। এর মধ্যে আছে অ্যাংলো-ডাচ ইস্পাত প্রস্তুতকারক কোরাস ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক গাড়ি ব্র্যান্ড জাগুয়ার অ্যান্ড ল্যান্ড রোভারের অধিগ্রহণ। এর মধ্যে কিছু অধিগ্রহণ সিদ্ধান্ত দারুণ ফল দিয়েছে। আবার কিছু সিদ্ধান্তে কোম্পানির লোকসান হয়েছে—এর মধ্যে একটি ব্যর্থ টেলিযোগাযোগ উদ্যোগ আছে।
২০০০ সালে টাটা গ্রুপ টেটলি-কে কিনে নিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা কোম্পানিতে পরিণত হয়। এ চুক্তি ছিল একটি ভারতীয় কোম্পানির দ্বারা কোনো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সবচেয়ে বড় অধিগ্রহণের ঘটনা।
রতন টাটা নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ি উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যদিও সেই প্রচেষ্টা বিফলে যায়। ২০০৯ সালে টাটা ন্যানো নামক এ গাড়ি বাজারে আসে। গাড়িটির বেজ মডেলের দাম ছিল মাত্র ১ লাখ রুপি। ক্রেতাদের মধ্যে দারুণ আগ্রহ ছিল এ গাড়ি নিয়ে। তবে প্রাথমিক সাফল্য ও উত্তেজনার পর উৎপাদন ও বিপণন সমস্যার কারণে ব্র্যান্ডটি হারিয়ে যেতে শুরু করে।
রতন টাটা পরে বলেছিলেন, 'ন্যানোকে বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি হিসেবে ব্র্যান্ড করা মস্ত ভুল ছিল। মানুষ বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা গাড়ি চালাতে চায় না!'
২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বাইয়ের সন্ত্রাসী হামলার সময়ও রতন টাটা বড় ধাক্কা খান। টাটার মালিকানাধীন বিলাসবহুল তাজমহল প্যালেসও ওই হামলার শিকার হয়।
৬০ ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকাকালে তাজে ৩৩ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে হোটেলের ১১ জন কর্মচারী ছিলেন। রতন টাটা নিহত ও আহত কর্মচারীদের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এছাড়া নিহতরা জীবনের বাকি সময় ধরে যে বেতনভাতা পাওয়ার কথা ছিল, তাদের আত্মীয়দের সেই অর্থ পরিশোধ করেন। ২১ মাসের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হোটেলটি পুনর্নিমাণে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করেন তিনি।
কর্মজীবনের শেষের দিকে রতন টাটা এক তিক্ত বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। আগের চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রি অপসারিত হওয়ার পর ২০১৬ সালের অক্টোবরে কয়েক মাসের জন্য তিনি টাটা সান্সে অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসেন। এ ঘটনায় ম্যানেজমেন্টের মধ্যে তিক্ত দ্বন্দ্ব তৈরি হয় (সাইরাস মিস্ত্রি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর একটি গাড়ির দুর্ঘটনায় মারা যান)। পরে নটরাজন চন্দ্রশেখরনকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নটরাজন এর আগে ভারতের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি টাটা কনসালটেন্সি সার্ভিসের—যার বাজার মূলধন ৬৭ বিলিয়ন ডলার—প্রধান নির্বাহী ছিলেন।
পিটার কেসির ভাষ্যমতে, রতন টাটা একজন 'নম্র, সংযত ও লাজুক' মানুষ। তিনি প্রতিদিনের কর্মতালিকা লিখে রাখতেন।
রতন টাটা দূরদর্শী ব্যবসায়ী ছিলেন। ১৯৮৯ সালে পুনের একটি কারখানায় কর্মবিরতি ভাঙার জন্য পুলিশ ডাকার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন: 'আমরা সম্ভবত আমাদের শ্রমিকদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করিনি। আমরা ধারণা করেছিলাম, তাদের জন্য যতটা সম্ভব করছি, কিন্তু আমরা সম্ভবত তা করছিলাম না।'
রতন টাটা বিয়েথা করেননি। তবে চারবার বিয়ের পিঁড়িতে বসার দ্বারপ্রান্তে গিয়েছিলেন। নিজেই স্বীকার করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রেমিকা ছিল, তিনি ভারতেও এসেছিলেন। কিন্তু এখানকার জীবনে মানিয়ে নিতে না পারায় যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান।
রতন টাটার সাদাসিধে জীবনযাপনের অনেক গল্প প্রচলিত আছে।
যেমন ১৯৯২ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের কর্মীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। তাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, দিল্লি থেকে মুম্বাইগামী ফ্লাইটে তারা কাকে দেখে সবচেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়ে রতন টাটার ঝুলিতে।
কারণ জানতে চাওয়া হলে উত্তর আসে, রতন টাটাই একমাত্র ভিআইপি যিনি একা ভ্রমণ করতেন। তার সঙ্গে ব্যাগ ও ফাইল বহন করার জন্য কোনো সহকারী থাকতেন না। প্লেন ওড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি চুপচাপ নিজের কাজে ডুবে যেতেন।
বিমানে উঠে খুব কম চিনি দিয়ে ব্ল্যাক কফি চাইতেন রতন টাটা। কিন্তু পছন্দের কফি না পেলে তিনি কখনও ফ্লাইট অ্যাটেনডেণ্টের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন না।
টাটা গ্রুপকে নিয়ে লেখা বিখ্যাত বই 'দ্য টাটাজ: হাউ আ ফ্যামিলি বিল্ট আ বিজনেস অ্যান্ড আ নেশন'-এ গিরিশ কুবের লিখেছেন, টাটা সান্সের প্রধান হওয়ার পর তিনি জেআরডির কক্ষে বসতেন না। একটা সাধারণ ছোট কামরায় বসতেন। কোনো জুনিয়র কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার সময় কোনো সিনিয়র কর্মকর্তা এসে হাজির হলে রতন টাটা ওই সিনিয়র কর্মকর্তাকে অপেক্ষা করতে বলতেন।
কুকুরপ্রেম
রতন টাটার দুটি জার্মান শেফার্ড কুকুর ছিল—'টিটো' ও 'ট্যাঙ্গো'। এদের তিনি ভীষণ ভালোবাসতেন।'
'কুকুরদের প্রতি তার ভালোবাসা এতটাই তীব্র ছিল যে তিনি নিজের অফিস বোম্বে হাউসে পৌঁছালেই রাস্তার কুকুরেরা তাকে ঘিরে ধরত। তারা তার সাথে লিফটে পর্যন্ত চলে যেত। এই কুকুরগুলোকে প্রায়ই বোম্বে হাউসের লবিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত, যেখানে শুধু কর্মী বা আগে থেকে অনুমতি নেওয়া ব্যক্তিদের প্রবেশের অনুমতি ছিল।'
রতন টাটার সাবেক সহকারী আর ভেঙ্কটারমন বলেছিলেন, জার্মান শেফার্ড কুকুর 'টিটো' ও 'ট্যাঙ্গো' তার খুব কাছের। এরা ছাড়া কেউ তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়তে পারত না।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও লেখক সোহেল সেঠও রতন টাটার কুকুরপ্রেম নিয়ে একটি ঘটনা বলেছেন। ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জনহিতকর কাজের জন্য রতন টাটাকে বাকিংহাম প্যালেসে 'রকফেলার ফাউন্ডেশন লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট' পুরস্কার দেওয়ার কথা ছিল ব্রিটেনের যুবরাজ চার্লসের। কিন্তু অনুষ্ঠানের কয়েক ঘণ্টা আগে রতন টাটা আয়োজকদের জানিয়ে দেন, তিনি যেতে পারবেন না, কারণ তার কুকুর টিটো হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। চার্লসকে এ ঘটনা জানানোর পর তিনি বলেছিলেন, এটাই একজন আসল মানুষের পরিচয়।
নিঃসঙ্গ, সময়ানুবর্তী রতন টাটা
জেআরডির মতোই রতন টাটাও ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজ করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ঠিক সাড়ে ৬টায় তার অফিস থেকে বের হতেন। অফিসের কাজে বাড়িতে কেউ যোগাযোগ করলে তিনি বিরক্ত হতেন। বাড়িতে একাকী ফাইল ও অন্যান্য কাগজপত্র পড়তেন।
মুম্বাইয়ে থাকলে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতেন আলিবাগে নিজের ফার্মহাউসে। সেই সময় তার সঙ্গে কুকুর দুটি ছাড়া আর কেউ থাকত না।
দেখনদারির বাতিক ছিল না রতন টাটার। আর তিনি ছিলেন জেদি মানুষ। সোহেল সেঠ বলেন, 'তার মাথায় বন্দুক ধরলেও তিনি বলবেন, আমাকে গুলি করো, তারপরও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরব না।'
পুরনো বন্ধুর বোম্বে ডায়িংয়ের প্রধান নুসলি ওয়াডিয়া বলেন, 'রতন খুবই জটিল একটা চরিত্র। আমি মনে করি, ওকে কেউ কখনও পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। ও খুব গভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ঘনিষ্ঠতা থাকলেও আমার ও রতনের মধ্যে কখনোই ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল না। ও সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ।'
সাদাসিধে জীবন
ওই সময়ের অর্থনীতির সাংবাদিক ও রতন টাটার বন্ধুরা জানান, তিনি ছিলেন একজন বন্ধুত্বসুলভ, নিরহংকার ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। কখনও কোনো ঝামেলা করতেন না। যে-কেউ তার সাথে দেখা করতে পারত। তিনি নিজেই ফোন রিসিভ করতেন।
লেখক কুমী কাপুর লিখেছেন, রতন টাটার জীবনযাপন অধিকাংশ ভারতীয় বিলিয়নিয়ারের চেয়ে অনেক বেশি সংযমী ও সাদাসিধে ছিল।
কুমি কাপুর আরও লিখেছেন, একজন বিজনেস কনসালট্যান্ট তাকে জানান, রতন টাটার কোনো সেক্রেটারির ভিড় না দেখে তিনি অবাক হয়েছিলেন। রতন টাটার সমুদ্রমুখী বাড়িটিতে অভিজাত্যের ছাপ থাকলেও তাতে জাঁকজমকের বাড়াবাড়ি নেই।