উৎপাদন খরচের তুলনায় ৪০৪% পর্যন্ত বেশি দরে চাল কিনছেন ঢাকার ভোক্তারা: ডিসিসিআই
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার ভোক্তারা উৎপাদন পর্যায়ের তুলনায় এক কেজি চিকন চালের জন্য ৪০৪ শতাংশ বেশি এবং মোটা চালের জন্য ২৬০ শতাংশ বেশি দাম পরিশোধ করছেন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, চাল, পেঁয়াজ, আলু, রসুন, ও হলুদের মতো কৃষিপণ্যের দাম উৎপাদনকারী, হোলসেলার (পাইকার) এবং খুচরা বিক্রেতার হাত ঘুরে ঢাকায় আসার পর খুচরা পর্যায়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে।
"খাদ্য মূল্যস্ফীতি: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির একটি বিশ্লেষণ" শীর্ষক এই গবেষণার ফলাফল গতকাল (১৭ অক্টোবর) রাজধানীর মতিঝিলে ডিসিসিআই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হয়। গবেষণাটি উপস্থাপন করেন ডিসিসিআইয়ের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি (গবেষণা ও উন্নয়ন) এ কে এম আসাদুজ্জামান পাটোয়ারী।
গত জুলাইয়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতেই মূলত গবেষণাটি করা হয়। এতে দেখা গেছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এক কেজি পেঁয়াজের দাম উৎপাদন খরচের তুলনায় ৩৬৫.১২ শতাংশ বেশি।
একইভাবে, আদার দাম ৩৩২ শতাংশ, আলুর দাম ১৯০ শতাংশ, লবণের দাম ২০০ শতাংশ, হলুদের দাম ৩১৬ শতাংশ এবং শুকনো মরিচের দাম ১১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে কম মূল্য বৃদ্ধি দেখা গেছে গরুর মাংসের ক্ষেত্রে, যেখানে দাম ৫.৭১ শতাংশ বেড়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এক কেজি মোটা চালের উৎপাদন খরচ ১৬.৬৭ টাকা (মাঠ থেকে প্রাপ্ত সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ দামের গড়)। উৎপাদকরা এটি ২৩.৭৫ টাকায় বিক্রি করেন, যা তাদের লাভ ও সংশ্লিষ্ট খরচসহ ৪২.৫০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি নির্দেশ করে।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা পরিবহণ, শ্রম, স্টোরেজসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করার পর মোটা চালের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেন ২৬.২৫ টাকা, যেখানে মূল্য বৃদ্ধি ১০.৫৩ শতাংশ। তবে পাইকার লাভ ও অন্যান্য খরচ সহ এই চাল খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করেন ৫০ টাকায়, যেখানে আরও এক দফা মূল্যবৃদ্ধি হইয়ে তা দাঁড়াচ্ছে ৯০.৪৮ শতাংশ।
খুচরা বিক্রেতারা ৫৬ টাকায় চাল কিনে মূল্য ১২ শতাংশ বাড়ান এবং অতিরিক্ত ৭.১৪ শতাংশ লাভ যোগ করে চাল ৬০ টাকায় বিক্রি করেন। পুরো প্রক্রিয়ায় মোট মূল্য ২৬০ শতাংশ বাড়লেও, এই অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পেছনে পাইকারদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
সরু চালের ক্ষেত্রে আরও উদ্বেগজনক তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। পাইকাররা এই পণ্যটি কেনার পর ২২০ শতাংশ পর্যন্ত লাভে বিক্রি করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, নয়টি আমদানি করা পণ্য– সয়াবিন তেল, গম, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, চিনি, গুঁড়ো দুধ এবং শুকনা মরিচের উৎপাদন থেকে খুচরা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির হার ১.৬৯ শতাংশ থেকে ৩২.৯৯ শতাংশের মধ্যে ছিল। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩২.৯৯ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে গমে এবং সর্বনিম্ন ১.৬৯ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে গুঁড়ো দুধে।
ডিসিসিআই নির্বাহী সচিব আসাদুজ্জামান পাটোয়ারী জানান, প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা, উৎপাদন ও আমদানির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব বর্তমানে খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ।
তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, কম সরবরাহ, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, উচ্চ পরিবহণ খরচ, বাজারের আধিপত্য এবং সীমিত দর কষাকষির ক্ষমতা থাকার মতো বিভিন্ন কারণ রয়েছে।
এছাড়া কৃত্রিম সংকট, এলসি খোলার সমস্যা, মৌসুমি পণ্যের মূল্যের তারতম্য, টাকার অবমূল্যায়ন, সরবরাহ চেইনের অদক্ষতা, অপর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা এবং উৎপাদকদের বাজারে সীমিত প্রবেশাধিকার সহ বিভিন্ন কারণেও দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়।
গত ২০ থেকে ২৯ আগস্ট দেশের ৮ বিভাগের ৪৯ জেলায় এ গবেষণা পরিচালিত হয়, যেখানে ৬০০ জনের নিকট হতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়; যাদের মধ্যে উৎপাদনকারী, আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা রয়েছেন। গবেষণায় ২১টি খাদ্যপণ্যের তথ্য সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে ১২টি দেশীয়ভাবে উৎপাদিত, ৫টি আমদানি করা এবং বাকি ৪টি দেশীয় ও আমদানিকৃত। বিভিন্ন পর্যায়ের উৎপাদক, আমদানিকারক, পাইকার ও খুচরা বিক্রেতার কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়লেও উৎপাদকরা ন্যায্য দাম পান না। তিনি বলেন, "কখনও দাম বাড়ানোর জন্য পরোক্ষ খরচ জড়িত হয়। স্যাটেলাইট প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষি পণ্য উৎপাদনের হিসাব করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা যদি স্টোরেজ, পরিবহণ এবং পণ্য প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে উৎপাদন খরচ কমাতে পারি, তাহলে দাম তুলনামূলকভাবে কমে আসবে বলে। পাশাপাশি প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ফসল ঘরে তোলার পর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দ্রুত নষ্ট হওয়া পণ্যের খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যেতে পারে।"
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি উল্লেখ করেন, সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের গুরুত্বের ওপর জোর দেওয়া জরুরি। বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ট্যারিফ ক্যালেন্ডার তৈরি করা যেতে পারে। এটি নির্ধারণ করবে, আমদানিতে কখন শুল্ক আরোপ করা হবে এবং কখন তা হ্রাস করা হবে; যাতে আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।