'টাকা নেই': গ্রিড ব্যর্থতা এবং আর্থিক সংকটের মধ্যে কিউবা সম্পূর্ণ পতনের মুখে
৭৬ বছর বয়সী মারিয়া এলেনা কার্দেনাস হাভানার ঔপনিবেশিক পুরনো শহরের আমারগুরা স্ট্রিটে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করেন। ভবনটির একসময় মর্যাদাপূর্ণ অতীত ছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে মারিয়া রাস্তায় খুঁজে পাওয়া লাকড়ি দিয়ে রান্না সারছেন।
তিনি বলেন, "আমরা কিউবানরা যেভাবে পারি, সেভাবেই সামলে নেই।" তার বাড়িটি ধসে পড়ায় তাকে এ আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হচ্ছে। এই সুন্দর শহরটির দরিদ্রদের জীবনে এ ধরনের ঘটনা অহরহই ঘটে।
কিউবার সরকার গত কয়েকদিন ধরে দ্বীপটির জাতীয় গ্রিড সচল করার চেষ্টা করছে। কয়েকবার চেষ্টা করার পরও দ্বীপটিতে এখনো সংকট কাটেনি। বিদ্যুৎ না থাকায় তীব্র গরমে ঘুমানো কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং পানি সরবরাহও ব্যাহত হচ্ছে।
কিউবার কমিউনিস্ট ব্যবস্থার কিছু সংস্কৃতি এখনও অবশিষ্ট রয়েছে। যার কারণে মিউনিসিপাল থেকে মারিয়ার জন্য খাবার পাঠানো হয়েছে। মারিয়া বলেন, "এখানে তিনটি পরিবার থাকে। আমি একাই থাকি। আমার পাশে আরেক নারীও একা থাকেন। সেখানে আরও দুটি শিশু, তাদের মা, খালা ও একজন বৃদ্ধ পুরুষ থাকেন।"
ব্ল্যাকআউটের এক সপ্তাহ পর দ্বীপটি আগের অবস্থায় ফিরেছে। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ বিভ্রাট রয়েই গেছে। প্রতিদিন ২০ ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। এ সংকট ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করছে।
আরেক বাসিন্দা ৫২ বছর বয়সী জুলিও সিজার রদ্রিগেজ বলেন, "আমরা কিউবানরা স্বভাবজাতই হাসিখুশি। যখনি পরিস্থিতি খারাপ থাকে তখনও আমরা হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু এবার পরিস্থিতি সত্যিই খুব খারাপ।"
গত ১৭ অক্টোবর থেকে এ সংকট দেখা দিতে শুরু করে। এক আদেশের প্রয়োজনীয় কর্মীদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ায় এ সংকট দেখা দিতে শুরু করে।
এ আদেশের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এটি সিস্টেমকে রক্ষা করতে পারেনি। বরং তার একদিন পরই দ্বীপটি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ডুবে যায়। দ্বীপটির প্রধান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর একটি আন্তোনিও গুইতেরাস বন্ধ হয়ে গেলে, একে একে সিস্টেমের অন্য বড় জেনারেটিং স্টেশনগুলোও ভেঙে পড়ে।
আন্তোনিও গুইতেরাসের একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী বলেন, "বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালু করা খুব কঠিন। এটি চালু করতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়।"
আন্তোনিও গুইতেরাস ১৯৮৯ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন এটি পুরোনো ও ক্ষয়প্রাপ্ত। ওই প্রকৌশলী আরও বলেন, "সত্য হলো, এটি নির্মাণের সময়ই ত্রুটিপূর্ণ ছিল।" তিনি জানান, ত্রুটিপূর্ণ নিরাপত্তা সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। সমস্যা দেখা দিলে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপকরা নিখোঁজ হয়ে যান। দীর্ঘদিন ধরে এসব সীমিত সিস্টেম নিয়ে কাজ করার গল্প বলেছেন সেই প্রকৌশলী।
তিনি বলেন, "এসবের একটি নির্ধারিত রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি ছিল। কিন্তু কখনোই সেসব অনুসরণ করা হয়নি। কিন্তু চাহিদা ছিল প্রচুর। তাই আমাদের বলা হতো মেরামত করেই যেভাবে সম্ভব এখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করো।"
কিউবার সরকার তাদের বিপর্যস্ত সিস্টেমের কথা স্বীকার করেছে। এর জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ৬২ বছরের পুরোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করছে। কিউবার প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ-ক্যানেল বলেন, "এসব 'আর্থিক ও জ্বালানি নির্যাতন' জ্বালানি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সম্পদ আমদানি করাকে কঠিন করে তুলেছে।"
কিউবার সরকার বেশিরভাগ সময়ই মিত্রদের দানের উপর নির্ভর করে এসেছে। তারা প্রথমে রাশিয়া এবং পরে ভেনেজুয়েলার উপর নির্ভর করে এসেছে। কিন্তু এসব দেশ নিজেরাই এখন বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আছে। যার কারণে তারা সরবরাহ ব্যাপক হারে কমিয়ে দিয়েছে। এক ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেন, "এটা যেন ডুবে যাওয়া জাহাজকে কর্ক দিয়ে ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।"
একটি টেলিভিশন ভাষণে কিউবার প্রধানমন্ত্রী ম্যানুয়েল মারেরো বলেছেন, উদীয়মান বেসরকারি খাতকে তাদের বিদ্যুতের জন্য আরও বেশি মূল্য দিতে হবে এবং ভবিষ্যৎ জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য সরকার নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের দিকে নজর দিচ্ছে।
দ্বীপটিতে প্রচুর সূর্যের আলো পাওয়া যায়। তবে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করার একাধিক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। কারণ জড়িত কোম্পানিগুলোকে অর্থ দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে বিদেশি এক ব্যবসায়ী বলেন, "সরকার নির্বোধ নয়। কিন্তু এসবের জন্য আসলে কোনো অর্থ নেই।"
পরিবর্তে, একটি চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। এর অংশ হিসেবে কিউবায় সৌর ফার্ম খোলার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করবে চীন এবং বিনিময়ে কিউবার নিকেল খনির সুবিধা ভোগ করবে তারা। কিন্তু এ অর্থনৈতিক সংকট থেকে বাঁচতে গত দুই বছরে কিউবার জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষ পালিয়ে গেছে। এ কারণে এ ধরনের প্রকল্প নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
জো বাইডেন বলেন, তিনি কিউবা সরকারের প্রতি 'কঠোর', কিন্তু তিনি এর জনগণের প্রতি পূর্ণ সমর্থন আছে। তবে ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের সর্বশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে মার্কিন অ্যাকাডেমিক উইলিয়াম লিওগ্র্যান্ড যুক্তি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে আরও সহায়তা করতে পারে।
তিনি লিখেছেন, "শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের সমর্থকদের ইচ্ছা সম্পর্কে সতর্ক হওয়া উচিত। শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তা মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে এবং এ পর্যন্ত দেখা যে কোনো কিছুর চেয়ে অনেক বড় একটি অভিবাসনের ঢেউ সৃষ্টি করবে। সামাজিক শৃঙ্খলার ভাঙন অপরাধমূলক সহিংসতার ঢেউকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।"
পূর্ববর্তী বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময়ের মতো এবার তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এবং সরকারি মন্ত্রীরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে "অশোভন" আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সম্প্রতি সাংবাদিকদের উপর নতুন করে ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা দেখা যাচ্ছে, যার ফলে অনেককেই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়েছে। বুধবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিউবার কারাগারে আটক চার জন – সাংবাদিক ফেলিক্স নাভারো এবং তার মেয়ে সাইলি নাভারো, তাদের পাশাপাশি বিক্ষোভকারী রবার্তো পেরেজ ফনসেকা ও লুইস রোবলেসকে 'বিবেক বন্দী' হিসেবে ঘোষণা করেছে।
এদিকে, এক সংকট থেকে আরেক সংকট জন্ম নিচ্ছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি পুরোনো পানির সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যর্থতার খবরও পাওয়া গেছে। ছয় লাখ মানুষ নিয়মিত পানি পাচ্ছেন না। ব্ল্যাকআউটের ফলে পাম্প ও পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এই সংখ্যা আরও বেড়ে গেছে। হাভানার অধিকাংশ এলাকা এখন পানিশূন্য।
দারিয়েল রামিরেজ পুরোনো শহরে তার সিঁড়ির পাশে বসেছিলেন। তার কাছে তেমন খাবার ছিল না। কারণ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে তিনি সঞ্চিত খাবার সবার মাঝে ভাগ করে দিয়েছিলেন।
এ ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের কারণে ভবিষ্যতের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, জানতে চাওয়া হলে রামিরেজ বিপ্লবের জাদুঘরের দিকে ইঙ্গিত করেন। ১৯৫৬ সালে ফিদেল ও রাউল কাস্ত্রোর ব্যবহৃত নৌকাকে নির্দেশ করেন তিনি। সেটি কমিউনিস্ট শাসনের কেন্দ্রীয় প্রতীক হিসেবে এখনও জাদুঘরটিতে প্রদর্শিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, "যদি এই পরিস্থিতি আবার ঘটে, আমাদের গ্রানমা ইয়ট প্রস্তুত করতে হবে। যাতে চড়ে আমরা সবাই পালিয়ে যেতে পারি।"