৫ আগস্টে ছিলেন কারাগারে, তারপরও তিনি হত্যাকাণ্ডের আসামি!
আবুল কালাম আজাদ দীর্ঘ দিন বিদেশে ছিলেন। এখন তিনি ঢাকার উত্তরা এলাকার বাসিন্দা। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২৩ জুলাই নিজ বাসার সামনে থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে তুরাগ থানার পুলিশ। এরপর বিএনপি কর্মী পরিচয়ে মামলা দিয়ে তাকে পাঠানো হয় কারাগারে।
কারাগারে থাকা আবুল কালাম গত ৮ আগস্ট জামিনে মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু আন্দোলন চলাকালীন সময়ে গত ৫ আগস্ট উত্তরা এলাকায় আলমগীর হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় সম্প্রতি দায়ের হওয়া আরেকটি মামলায় তাকে আসামি করা হয়। ৬ অক্টোবর উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের হওয়া ওই মামলায় আবুল কালাম আজাদকে ২৫৪ নম্বর আসামি করা হয়। কিন্তু যখন এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেসময় আবুল কালাম আজাদ ছিলেন কারাগারে।
আবুল কালাম আজাদ টিবিএসকে বলেন, "ঘটনার কয়েক দিন আগে আমার স্ত্রীর অস্ত্রোপচার হয়। গত ২৩ জুলাই তার জন্য কিছু ওষুধ আনতে বাইরে গিয়েছিলাম। তখন বাসার সামনেই এক চায়ের দোকানে বসেছিলাম। সেসময়ই তুরাগ থানার পুলিশের এক গাড়ি ও মোটরসাইকেলে এসে জানায়, আমাকে ওসি স্যার ডাকছে। আমি ওষুধটা বাসায় দিয়ে আসতে চাইলে আমাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়নি। থানায় নিয়ে গিয়ে আমার নামে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়। এরপর ৮ আগস্ট আমি জেল থেকে ছাড়া পাই এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কয়েক দিন আগে জানতে পারি উত্তরা পশ্চিম থানায় ৫ আগস্টের একটি হত্যা মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে।"
প্রতিবেশীদের অনেকেই আবুল কালামকে সেদিন ধরে নিয়ে যেতে দেখেছেন। কারাগারে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তি কীভাবে উত্তরায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়ালেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন স্থানীয় বাসিন্দাদের মনেও।
দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডের (টিবিএস) সেদিনের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছে। ফুটেজে দেখা যায়, গ্রেপ্তারের রাতে নিজ বাসার ঠিক সামনেই চায়ের দোকানে বসে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। রাত সাড়ে ১০ টার দিকে সেখানে আসে তুরাগ থানা পুলিশের একটি গাড়ি এবং মোটরসাইকেল এসে আবুল কালামের সঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলে তাকে নিয়ে যায় পুলিশ।
সেদিন আব্দুল হান্নান মিয়ার চায়ের দোকানে বসে ছিলেন আবুল কালাম। আব্দুল হান্নান টিবিএসকে বলেন, "আবুল কালাম দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। তখন পুলিশের গাড়ি আমার দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়। এরপর দুইজন পুলিশ তাকে বলে চলেন ওসি স্যার দেখা করতে ডেকেছে। তারপর তারা আবুল কালামকে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তো জেলে ছিলেন আবুল কালাম। ৮ আগস্ট জেল থেকে ছাড়া পান তিনি।"
একই কথা জানালেন আব্দুর রউফ নামে পাশের এক মুদি দোকানিও। তিনি বলেন, "আমাদের সবার সামনেই আবুল কালামকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ।"
এদিকে টিবিএসের অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ৬ অক্টোবর দায়ের হওয়া ওই মামলার বাদী হিসেবে দেখানো হয়েছে হত্যাকাণ্ডের শিকার আলমগীর হোসেনের মা আলেয়া বেগমকে।
মামলার কপিতে বাদী আলেয়া বেগমের ঠিকানা লেখা আছে, উত্তরা ১৪ নং সেক্টরের, ১৪ নম্বর রোডের ৬ নম্বর বাসা। ওই ঠিকানায় গিয়ে জানা গেল সেখানে আলেয়া নামের কেউই থাকেন না। এমনকি জুলাই আগস্টের ঘটনায় সেই বাসাতে কেউই মারা যায়নি।
ওই বাসার কেয়ারটেকার আলমাস আলী টিবিএসকে বলেন, "এখানে আলেয়া নামের কেউ থাকে না। কোন দিন এই নামের কেউ ছিল না। আর আন্দোলনের সময় আমাদের বাসায় কেউ মারাও যায় নাই।"
৬ নম্বর বাসার অপর এক বাসিন্দাও টিবিএসকে নিশ্চিত করেছেন। সেই বাসার কেউ ৫ আগস্টে বা আন্দোলন কালে মারা যায়নি।
আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য মামলার এজহারে দেওয়া বাদীর মুঠোফোন নাম্বারেও ফোন দেওয়া হয়। কিন্তু তার মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়।
মামলার এজাহারে দেওয়া বাদীর জন্মনিবন্ধন নম্বর ও জন্ম তারিখ অনলাইনে যাচাই করলে দেখা যায়, সেটি ভুয়া। মামলার কাগজপত্রে বাদীর গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় লেখা রয়েছে, গ্রাম: আমিরাবাদ, পোস্ট অফিস আমিরাবাদ, থানা সোনাইমুড়ী, জেলা: নোয়াখালী।
টিবিএসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বাদীর দেওয়া গ্রামের ঠিকানায়। কিন্তু এলাকাবাসী জানান, এই নামে কেউ ওই গ্রামে নেই । আলমগীর হোসেন নামেও কেউ মারা যাননি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মো.গুলজার টিবিএসকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আলমগীর নামের কেউ মারা যায়নি।
জুলাই মাসে আবুল কালাম আজাদকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো তুরাগ থানার সাবেক উপ-পরিদর্শক আরাফাত মিঠুনও শিকার করেছেন গ্রেপ্তারের বিষয়টি।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "২৩ জুলাই আবুল কালামকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে পাঠানো হয়। এরপর থেকে তিনি কারাগারে ছিলেন। পরবর্তীতে ওই মামলাটি খারিজ করা হয়েছে।"
কারাগারে থাকা আবুল কালাম কীভাবে হত্যার আসামি হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এটা উত্তরা পশ্চিম থানা বলতে পারবে। আমি কিছু জানি না।"
উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের হওয়া ওই মামলার নথি থেকে জানা যায়, ৫ আগস্ট উত্তরার সাউথ ইষ্ট ব্যাংকের সামনে আলমগীর হোসেন নামের এক ব্যক্তি মাথায় গুলি লেগে মারা যান। পরবর্তীতে ৬ আগস্ট নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী গ্রামের বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হয়৷ এই ঘটনায় নিহতের মা আলেয়া বেগম বাদী হয়ে চলতি মাসের ৬ অক্টোবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
আলেয়া বেগমের দায়ের করা মামলায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনাসহ ২৮৮ জনের নাম উল্লেখ্য করে এবং অজ্ঞাতনামা ২০০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় ২৫৮ নম্বর আসামি করা হয়েছে আবুল কালাম আজাদকে।
আবুল কালামের অভিযোগ, "মাহফুজ নামের এক ব্যক্তি যুবলীগ নেতা পরিচয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই তাকে নানা হয়রানি করে আসছেন। তার ইন্ধনেই বা পূর্ব শত্রুতার কারণে হয়ত তাকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। যুবলীগ নেতা পরিচয় দেয়া এই মাহফুজ নাকি পুলিশকে দিয়ে অন্যের পায়ে গুলিও করিয়েছেন। টিবিএসের হাতে আসা একটি গোপন ভিডিওতে সেটা তিনি স্বীকার করেছেন নিজ মুখেই। ৫ আগস্টের পর থেকেই আত্মগোপনে রয়েছেন সেই মাহফুজ।"
স্থানীয়দের অভিযোগ, ওই এলাকায় মাহফুজের ছিল নিজস্ব একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। যাদের ব্যবহার করে এলাকায় বহু ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। টিবিএসের হাতে আসা একাধিক ভিডিওতে প্রমাণ মিলেছে তার।
আবুল কালামের অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় সেই মাহফুজের সঙ্গে।
মাহফুজ টিবিএসকে বলেন, "এসব অভিযোগ মিথ্যা। তার সাথে আমার পূর্বের ঝামেলা আছে ঠিকই। কিন্তু উত্তরা পশ্চিম থানায় হত্যা মামলায় আবুল কালাম কীভাবে আসামি হলেন সেটা আমার জানা নেই। ওই মামলার সাথে আমার কোন ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই।"
এই মামলার ঘটনা ও জেলে থাকা আবুল কালামকে আসামি বানানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার উপ-পরিদর্শক ( এসআই) আব্দুল হালিমের সঙ্গে।
এসআই আব্দুল হালিম বলেন, "মামলাটি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত শেষ না হলে কিছু বলা যাবে না।"
মামলায় জেলে থাকা আবুল কালাম কীভাবে আসামি হলেন সেটা জানতে চাইলে তিনি টিবিএসকে বলেন, "এটা বাদী বলতে পারবে।"
মামলায় উল্লেখ্য করা বাদীর ঠিকানাটি ভুয়া তাকে সেখানে পাওয়া যায়নি। এসব বিষয় তাকে জানালে তিনি বলেন, "সব কিছু অফিসার ইনচার্জ (ওসি) স্যার জানেন। তার কাছে জিগ্যেস করুন। আমি কিছু জানি না।"
পরবর্তীতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় উত্তরা পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ মো .হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। কিন্তু একাধিকবার মুঠোফোনে চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর মেলেনি।
সবশেষে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার রওনক জাহানের সঙ্গে ।
তিনি টিবিএসকে বলেন, "এমন ঘটনা ঘটে থাকলে, সেটা তদন্ত করা হবে। আমরা তো তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পত্র দেই নাই। আমার তদন্ত কর্মকর্তার এখানে কোন ত্রুটি নেই। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় তদন্তে তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া না গেলে তো চার্জশিটে তার নাম যাবে না।"
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক এই ঘটনার বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, "অতীতেও কোন কোন মামলায় এমন ভুয়া আসামি বানানো হয়েছে। এখনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। যা খুবই দুঃখজনক। এমন ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। তদন্তে এই ঘটনা প্রমাণিত হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।"