হোয়াইট হাউজের প্রথম দিনেই যা করতে পারেন ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার রিপাবলিকান দল যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাশাপাশি, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদকে কেন্দ্র করে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা নিয়েছে।
আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণের পরপরই ট্রাম্প বিভিন্ন নির্বাহী আদেশ জারি করতে আগ্রহী। তার নির্দেশনা বাস্তবায়নে নীতিনির্ধারক এবং আইনজীবীরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন।
তবে, অনেক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অধিকার রক্ষা সংগঠন ও ডেমোক্র্যাটিক গভর্নররা।
অভিবাসন এবং সীমান্ত সংশ্লিষ্ট নীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার দ্বিতীয় মেয়াদে অভিবাসন নীতি নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পরিকল্পনা করেছেন।
তার প্রেস সচিব ক্যারোলিন লেভিট রোববার ফক্স নিউজকে জানিয়েছেন, "আমরা জানি যে তিনি দক্ষিণ সীমান্ত সুরক্ষিত করতে নির্বাহী আদেশে সই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।"
ক্যারোলিন আরও বলেন, "আমরা জানি, প্রথম দিনেই তিনি আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বেআইনি অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করবেন।"
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ট্রাম্প ইতোমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়েছেন। টম হোম্যানকে "বর্ডার জার" বা সীমান্ত বিষয়ক প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ক্রিস্টি নোমকে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির দায়িত্বে এবং স্টিভেন মিলারকে হোয়াইট হাউজে উপপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। স্টিভেন মিলার ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে কঠোর অভিবাসন নীতিগুলোর জন্য পরিচিত ছিলেন।
ট্রাম্প "রিমেইন ইন মেক্সিকো" [মেক্সিকোতে থাকুন] নীতিও পুনরায় চালু করতে পারেন। এই নীতি অনুযায়ী, ম্যাক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশীদের অভিবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করতে।
জো বাইডেন এটিকে 'অমানবিক' বলে উল্লেখ করেছিলেন। হোয়াইট হাউজে আসার পর শুরুতেই এটি বাতিলের চেষ্টা করলেও, আইনি জটিলতার মুখোমুখি হন। পরবর্তীতে ২০২২ সালে সুপ্রিম কোর্ট তাকে এই নীতি বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার অনুমতি দেন।
অন্যদিকে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিলে স্বয়ংক্রিয় নাগরিকত্ব প্রদানের ১৫০ বছরের পুরোনো নীতি বাতিলের পরিকল্পনাও করেছেন। তবে সাংবিধানিক সংশোধন ছাড়া এটি বাতিল করা সম্ভব নয়। এজন্য কংগ্রেস ও বিভিন্ন রাজ্যের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
৬ জানুয়ারি
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বিজয় ভাষণে ০২১ সালের ক্যাপিটল হামলায় অভিযুক্তদের শাস্তি মওকুফের বিষয়ে কিছু না বললেও, অভিযুক্তদের শাস্তি মওকুফ করা তার অগ্রাধিকার হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব ব্ল্যাক জার্নালিস্টের একটি প্যানেলে ট্রাম্প বলেন, যারা "নির্দোষ" তাদের ক্ষমা করার বিষয়ে তিনি চিন্তাভাবনা করবেন।
তার মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছেন, হোয়াইট হাউজে ফিরে এলে ট্রাম্প প্রতিটি মামলা আলাদাভাবে বিবেচনা করবেন।
ক্যাপিটল হামলার ঘটনায় ১,৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৭৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তিকে বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অনধিকার প্রবেশ থেকে শুরু করে পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর হামলা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ রয়েছে।
জ্যাক স্মিথ
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালের নির্বাচন এবং একটি আলাদা গোপনীয় মামলার কারণে আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে মার্কিন বিচার বিভাগের তদন্ত তত্ত্বাবধানের জন্য নিযুক্ত প্রবীণ প্রসিকিউটর ও বিশেষ কাউন্সেল জ্যাক স্মিথ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে ট্রাম্প নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন।
সূত্রগুলো এই সপ্তাহে সিবিএস নিউজকে জানিয়েছে, স্মিথ ট্রাম্পের শপথ নেওয়ার আগে পদত্যাগ করতে পারেন এবং ট্রাম্পের তাকে বরখাস্ত করার হুমকি এড়াতে চান। তার অফিস ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চলমান দুইটি মামলাও বন্ধ করতে যাচ্ছে।
ট্রাম্প স্মিথের নিয়মিত সমালোচনা করেছেন এবং তাকে "দুর্নীতিবাজ" এবং "অবশ্যই অন্যায়কারী" বলে অভিহিত করেছেন।
কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যরা স্মিথের কাজের তদন্ত করার হুমকি দিয়েছে এবং ইলন মাস্ক তার আইনি শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
এছাড়া, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর যে কোনো ফেডারেল অপরাধে নিজেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা পাবেন। তবে, কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এখনও এমনটি করেননি।
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি
২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বের হওয়াকে একটি অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট প্রথম মেয়াদে শপথ নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বের হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল।
২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চুক্তিতে যোগ দেওয়াকে তার প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। বাইডেন শপথ নেওয়ার প্রথম দিনেই যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় সদস্য করার জন্য একটি চিঠিতে সই করেন।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার দল পর পুনরায় চুক্তি থেকে বের হওয়ার আদেশ প্রস্তুত করছে। চুক্তি থেকে বের হলে, যুক্তরাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হবে না।
ট্রাম্প আরও বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তেল ও গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে চান। তিনি দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া ও ফ্র্যাকিং [প্রাকৃতিক গ্যাস বা তেল উত্তোলনের একটি প্রক্রিয়া] বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এছাড়া, ট্রাম্প বাইডেন প্রশাসনের বায়ু শক্তি ও বৈদ্যুতিক গাড়ির উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনাগুলোর সমালোচনা করেছেন, যা নতুন ট্রাম্প প্রশাসনের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু হতে পারে।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ
নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি ইউক্রেনে যুদ্ধ "একদিনে" শেষ করতে পারবেন। তিনি ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য অব্যাহত রাখার সমালোচনা করেছেন এবং যুদ্ধকে সম্পদ নষ্ট করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি যুদ্ধ শেষ করতে কীভাবে আলোচনা চালাবেন, তা স্পষ্ট করেননি। তবে তিনি বলেছেন, তিনি দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি করতে সাহায্য করবেন।
পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ৩০ মিনিটের ফোনালাপে কথা বলেছেন, যেখানে বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্কও অংশ নেন।
তবে একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, এটি ছিল একটি সাধারণ আলাপ এবং সেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের ফোনালাপের কথা অস্বীকার করেছে ক্রেমলিন। তবে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প পুতিনকে ইউক্রেনে যুদ্ধ বাড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিলেন।
বাণিজ্য ও অর্থনীতি
ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থনীতিকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তিনি গাড়ি, বাসস্থান, বীমা খরচ এবং সরবরাহ শৃঙ্খলা বিষয়ক সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেবেন। ট্রাম্প বলেন, "আমি মন্ত্রিপরিষদকে নির্দেশনা দিয়ে বলব, প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে বা তারও আগে ফলাফল দেখতে চাই।"
ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশে সই করবেন, যার মাধ্যমে প্রত্যেক মন্ত্রিপরিষদ সদস্য এবং এজেন্সি প্রধানকে মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় "যতটা সম্ভব সমস্ত উপায় ও ক্ষমতা ব্যবহার" করতে বলা হবে এবং ভোক্তা মূল্য কমানোর চেষ্টা করা হবে।
তার পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, চীন থেকে আসা পণ্যসহ আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করা। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন কর্মসংস্থান বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
তিনি ১০ আমদানি শতাংশ শুল্ক ও চীনা পণ্যের ওপর ৬০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া, অপরাধী ও মাদক পাচারের সমস্যা সমাধান না করলে মেক্সিকোতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন তিনি।
এই শুল্কগুলো সম্ভবত কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই কার্যকর হবে। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে ১৯৬২ সালের ট্রেড এক্সপানশন অ্যাক্ট-এর ২৩২ ধারা ব্যবহার করে শুল্ক আরোপ করেছিলেন।
ট্রাম্প সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান গ্যারি জেনসলারকে প্রথম দিনেই বরখাস্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জেনসলারের নিয়োগ দিয়েছিলেন বাইডেন এবং তিনি জলবায়ু সম্পর্কিত প্রকাশনা নীতি ও ক্রিপ্টোকারেন্সি বাজারের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব দেন।
ট্রাম্প ক্রিপ্টোকারেন্সির পক্ষে এবং তার নির্বাচনে বিটকয়েনের দাম ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ তার প্রশাসন ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি সহানুভূতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়