বিসিবির অদ্ভুত বোলার মিরপুর স্টেডিয়ামে আর কতদিন
মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়াম; মাঠটিকে বলা হয় 'হোম অব ক্রিকেট'। সঙ্গত কারণেই মিরপুর স্টেডিয়ামের আরেক নাম এটা, বলতে পারেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রধানতম 'ঘর'। স্টেডিয়ামটিকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জিরো পয়েন্টও ডাকা যায়। এখান থেকেই দেশের ক্রিকেট আবর্তিত হয়, দেশের ক্রিকেটের প্রধান এবং বড় বড় সিদ্ধান্ত এই স্টেডিয়ামে বসেই নিয়ে থাকেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কর্তারা।
বিসিবির কার্যালয় মিরপুর স্টেডিয়ামে, সেই সূত্রে এখানেই প্রতিদিন আসতে হয় দেশের ক্রিকেটের নীতি-নির্ধারকদের। অনুশীলন ক্যাম্প থেকে শুরু বাংলাদেশের বেশিরভাগ ম্যাচ এই মাঠেই অনুষ্ঠিত হয়। মিরপুর স্টেডিয়াম এককভাবে আয়োজন করেছে ২০১৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও ২০১৬ যুব বিশ্বকাপ। ২০১১ বিশ্বকাপেরও কয়েকটি ম্যাচ এখানে অনুষ্ঠিত হয়। এমনকি ঘরোয়া টুর্নামেন্ট বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগেরও (বিপিএল) বেশিরভাগ ম্যাচ মাঠটিতে আয়োজন করা হয়।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বড় একটা অংশজুড়ে মিরপুর স্টেডিয়ামের অবস্থান। কিন্তু এই মাঠেই এমন একটি স্থাপনা আছে, যা ভুলভাবে তৈরি করা। প্রধান ফটক দুই নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতেই ডানে একটি ভাস্কর্য দৃশ্যমান, একজন বোলার বোলিং করার ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই বোলারের অ্যাকশনটি ভুল। ভুল পায়ের অ্যাকশন বলা যেতে পারে, যেটাকে ইংরেজিতে বলা হয়, 'রং ফুটেড ডেলিভারি।' ২০১১ সালে স্থাপনাটি তৈরির সময় বিষয়টি নজরে এলেও সংশ্লিষ্ট কর্তারা পাত্তা দেননি। 'এটা হতেই পারে'- বলে বানিয়ে ফেলা হয় ভাস্কর্যটি।
এমন আলোচনায় আপনার মাথায় কয়েকজন বোলারের নাম আসতে পারে, যাদেরকে 'রং ফুটেড বোলার' বা ভুল পায়ের বোলার বলা হয়ে থাকে। নামগুলোর মধ্যে থাকতে পারে ল্যান্স কেয়ার্নস, মাইক প্রক্টর, সোহেল তানভীর, বিরাট কোহলি। কিন্তু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, তারা ভুল পায়ের বোলার নন। তাদের বোলিং অ্যাকশন একটু ব্যতিক্রম বা অন্যদের চেয়ে আলাদা। ১৩ বছর ধরে মিরপুর স্টেডিয়ামে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা ভাস্কর্যটি একজন ডানহাতি বোলারের। কিন্তু ডেলিভারি দেওয়ার সময় তার ডান পা সামনে।
ক্রিকেট বা বিজ্ঞান অনুযায়ী শরীরের ভারসাম্য ঠিক রাখতে এমন ডেলিভারি দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কোনো বোলার যদি ডান হাতে বোলিং করেন, ডেলিভারি দেওয়ার সময় তার ডান পা সামনে থাকা সম্ভব নয়। কারও বোলিং অ্যাকশন অসামঞ্জস্য বা 'বিদঘুটে' হতে পারে, কিন্তু বাঁহাতি বোলার তার বাঁ পা সামনে রেখে ডেলিভারি করতে পারবেন না, একইভাবে ডানহাতি বোলারদের ক্ষেত্রেও তাই। শারীরিক ভারসাম্য রক্ষার জন্যই এটা সম্ভব নয়।
ভুল পায়ে ডেলিভারি সম্পন্ন করা বোলারদের সাধারণত 'রং ফুটেড বোলার' বলা হয়। অর্থাৎ, ডেলিভারি দেওয়ার পর ভুল পা সামনে আসা। কিন্তু মিরপুর স্টেডিয়ামের ভাস্কর্যটিতে বোলিংয়ের অবস্থানে পরিষ্কার, ভুল পায়ে ডেলিভারি দেওয়া হচ্ছে। তবে ভুল পায়ে ডেলিভারি সম্পন্ন করা যাবে না, বিষয়টি এমন নয়; এমন উদাহরণও আছে। কিন্তু কোনো স্থাপনা নির্মাণে সবাই সঠিকটাই বাছাই করেন। ব্যতিক্রম কোনো কিছু যে উদাহরণযোগ্য নয়, তা সবারই জানা। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের স্টেডিয়ামে যে তাদের দেশের কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের ভাস্কর্য স্থাপন করা আছে, সেসবে এমন কোনো ভুল খুঁজে পাওয়া যায় না।
২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়। শুরুতে এটা রীতমিতো হাসির খোড়াকে পরিণত হয়, নিয়মিত মাঠে যাওয়া সাংবাদিকদের মধ্যেও এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে সে সময়, চলেছে হাসাহাসি। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এটা যেন চোখে সয়ে গেছে সবার, প্রতিদিন সামনে পড়লেও এটা আর হাসির উদ্রেক সৃষ্টি করে না, দেখতেও বেমানান লাগে না।
নকশা থেকে শুরু করে মিরপুর স্টেডিয়ামের বেশিরভাগ কাজ করেছেন প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান খান। তিনি জানিয়েছেন, বিসিবি কর্তাদের নকশা দেখিয়েই ভাস্কর্যটি তৈরি করা হয়। তবে ভাস্কর্যটির নকশা তার করা নয়, করেছিলেন প্রয়াত ভাস্কর মৃণাল হক। যদিও শুরুতে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে মাসুদুর রহমান বলেন, 'এটা আমারই করা, আমিই করিয়েছি, আমারই ডিজাইন।' ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পর স্মৃতি সতেজ করতে চাইলেন এই প্রকৌশলী। জানতে চাইলেন ভাষ্কর্যটি এখনও আছে কিনা।
এরপর মনে হলো তিনি দায় এড়াতে চাইলেন, আর্টিস্ট হিসেবে নাম নিলেন মৃণাল হকের। যদিও তার তত্ত্বাবধানেই ভাস্কর্যটি হয়, স্টেডিয়ামের সব স্থাপনাতেই ছিল তার কর্তৃত্ব। মাসুদুর রহমান বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বলেন, 'ওটা এখনও আছে! তখন করেছিলেন যিনি, আর্টিস্ট একটু ভুল করেছিলেন। তখন সবাই বলেছিলেন, এটা হতেই পারে, কোনো অসুবিধা নেই। ভাস্কর ছিলেন আমাদের প্রয়াত মৃণাল হক। বিসিবির সবাই দেখে সিদ্ধান্ত দেওয়ার পরই এটা করা হয়। সবাই গ্রহণ করায় এটা তৈরি করা হয়েছিল। এর বাইরে স্টেডিয়ামের পুরোটা আমারই ডিজাইন করা।'
মিরপুর স্টেডিয়ামের স্বত্বাধিকারী জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। এখানকার কোনো কিছুর সংযোজন-বিয়োজনে এনএসসির অনুমতি প্রয়োজন। নিজ অর্থায়নে এর আগে গ্যালারি সংস্কার করলেও এনএসসির অনুমতি নিতে হয়েছে বিসিবিকে। সংস্কার বা ভেঙে ফেলা, কিংবা নতুন করে স্থাপনা তৈরিতেও এনএসসির অনুমতি নিতে হবে দেশের ক্রিকেটের নিয়ন্তা সংস্থাকে। এনএসসি সচিব আমিনুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি শুনেই হেসে ফেলেন তিনি।
ক্রিকেট চাষের প্রধানতম জায়গায় এমন একটি স্থাপনা এতোদিন ধরে থেকে যাওয়ার ব্যাপারটি যে দৃষ্টিকটু, সেটা অস্বীকার করলেন না তিনি। যদিও এই মুহূর্তে ভাস্কর্যটি নিয়ে করণীয় কিছু বলেননি আমিনুল ইসলাম। টিবিএসকে তিনি বলেন, 'এটা নোটিশ করার মতো বিষয়। এ নিয়ে আমি বিসিবির সঙ্গে কথা বলব। আপনার সঙ্গে দ্বিমত নেই আমার, দ্বিমত করার সুযোগ নেই। ব্যাপারটি এতোটাই অকাট্য যে, দ্বিমত করার মতো যুক্তি আমি এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না। পরে পাবো কিনা জানি না, পাবো না সত্যি বলতে। কিছু কিছু বিষয়ে যুক্তি দেওয়া যায় না। কথা বলব আমি বিসিবির সঙ্গে।'
দীর্ঘদিন বিসিবির প্রধান নির্বাহীর পদে আছেন নিজাম উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সাচ্ছন্দ্য দেখাননি। এতোদিন ধরে টিকে থাকা ভুল একটি স্থাপনা কখনও দৃষ্টিগোচর হয়েছে কিনা, কিংবা পরির্তনের কথা কখনও ভেবেছেন কিনা; এমন প্রশ্নের উত্তরে টিবিএসকে তিনি বলেন, 'এটা নিয়ে এই মুহূর্তে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। এটা ২০১১ সালে করা হয়েছে। এতোদিন পরে এটা নিয়ে মন্তব্য করাটা যৌক্তিক হবে কিনা, আমি জানি না। এ নিয়ে আমার কথা বলাটা ঠিক হবে না। যারা বিশেষজ্ঞ আছেন, তাদের মতামত এ ব্যাপারে মূল্যবান হতে পারে।'
বিশেষজ্ঞ হিসেবে সাবেক এক ক্রিকেটারের সঙ্গে যোগাযোগ করে টিবিএস। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, 'দেখুন, প্রতিটি কাজের বাস্তবায়নে আপনার মানসিকতা প্রকাশ পাবে যে, আপনি কীভাবে ভাবেন বা পরিকল্পনা করেন। এটা বড় কোনো ভুল নয়, কিন্তু ছোটও নয়। ক্রিকেটের চর্চা যেখানে সবচেয়ে বেশি, ক্রিকেটের হোড কোয়ার্টার বলতে পারেন, সেখানে এমন একটি স্থাপনা থাকা উচিত নয়। এটা আমার কাছে দৃষ্টিকটু ব্যাপার। বাইরের দলগুলো এসে এমন কিছু দেখলে নিশ্চয়ই হাসে। ভুল হতে পারে, কিন্তু এতোদিন সেটা থেকে যাওয়াটা আরও বড় ভুল। এটা ভেঙে নতুন করে করা উচিত ছিল। এটা কঠিন কোনো কাজ নয়।'
গত আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিসিবিতে অনেক বদল এসেছে। শুরুতেই দুজন পরিচালককে সরিয়ে নতুন দুজনকে দায়িত্বে আনা হয়। এ দুজনের একজন ফারুক আহমেদ, যিনি বর্তমানে বিসিবির সভাপতি। টানা কয়েকটি বোর্ড সভায় অনুপস্থিত থাকায় পরবর্তীতে পরিচালক পদ হারিয়েছেন ১১ জন। বোর্ডের মতো মিরপুর স্টেডিয়ামেও লেগেছে সংস্কারের ঢেউ। অনেক স্থাপনা ভেঙে নতুন করে করা হচ্ছে। তবে ভাস্কর্যটি ভেঙে ফেলা বা নতুন করে তৈরি করার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সংস্কারের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা।
ত্রুটিপূর্ণ বোলিংয়ের ভাস্কর্যটি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে, যেটাকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্থায়ী দাগ বা প্রতিচ্ছবি বললেও হয়তো ভুল হবে না।