আধুনিক কার্গো টার্মিনালে আমূলে পাল্টাবে আশুগঞ্জ নৌবন্দর
নৌপথে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ নদীবন্দরে আধুনিক কার্গো টার্মিনাল নির্মাণ করা হচ্ছে। টার্মিনালটি সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বছরে কমপক্ষে ১৫ লাখ টন কার্গো হ্যান্ডেল করতে পারবে।
বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ২১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন এই প্রকল্পটি বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এর আওতায় ৭০ মিটার দীর্ঘ তিনটি জেটি, দুটি কাভার্ড স্টোরেজ (গুদাম), দুটি ওপেন স্টোরেজ, একটি সাবস্টেশন, একটি ইয়ার্ড এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিতে বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে এবং সরকারের জন্য উল্লেখযোগ্য রাজস্ব আয়ের সুযোগ তৈরি হবে। এটি গুরুত্বপূর্ণ এই নদীবন্দরকে একটি অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রে পরিণত করবে।
প্রকল্পের প্রায় ২৩ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে।
আশুগঞ্জ নদীবন্দরের আধুনিক কার্গো টার্মিনাল প্রকল্পের পরিচালক মো. আইয়ূব আলী বলেন, "প্রকল্প এলাকার কিছু ব্যক্তিগত স্থাপনা স্থানান্তরের কারণে শুরুতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে আমরা আশা করছি, আগামী বছরের আগস্টের মধ্যেই কাজ শেষ করতে পারব।"
তিনি আরও বলেন, "বর্তমানে বন্দরে মালামাল ওঠা-নামার কাজ অনিয়মিতভাবে চলছে। কিন্তু নতুন ব্যবস্থা চালু হলে এটি বিআইডব্লিউটিএর নিয়ন্ত্রণে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হবে এবং সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াবে।"
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অবকাঠামোগত সুবিধায় আশুগঞ্জ নদীবন্দর দেশের অন্যান্য বন্দরের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।
বর্তমানে বন্দরে মাত্র দুটি জেটি রয়েছে, যা চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া, কোনো গুদাম না থাকায় মালামাল খোলা আকাশের নিচে রাখতে হয়। ট্রাক ইয়ার্ডের অভাবে বন্দরের একমাত্র সড়কের ওপর ট্রাক পার্ক করা হয়। এর ফলে, প্রায়ই যানজট সৃষ্টি হয়।
প্রতি মাসে ছোট-বড় মিলিয়ে শতাধিক কার্গো জাহাজ ও বাল্ক ক্যারিয়ার আশুগঞ্জ নদীবন্দরে নোঙর করে। একটি জাহাজ থেকে মালামাল খালাস করতে ৪-৫ দিন সময় লাগে। এই সময়ে, সীমিত জেটির কারণে অন্যান্য জাহাজ নোঙর করে অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়।
জাহাজ বন্দরে আসার সাত দিনের মধ্যে মালামাল খালাস করা না হলে ব্যবসায়ীদের ভাড়া গুণতে হয়। এতে করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা।
আশুগঞ্জ নদীবন্দরের ব্যবসায়ী নাসির মিয়া বলেন, পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে প্রতিষ্ঠার এক যুগেরও বেশি সময় পার হলেও বন্দরের কাঙ্ক্ষিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। তিনি বলেন, "গুদাম না থাকায় মালামাল খোলা আকাশের নিচে রাখতে হয়। এতে করে রোদ-বৃষ্টিতে পণ্যের ক্ষতি হয়।"
আরেক ব্যবসায়ী শাহজাহান সিরাজ উল্লেখ করেন, কৌশলগত অবস্থানের কারণে আশুগঞ্জ উপজেলা এখন বন্দর নগরী হিসেবে পরিচিত। এটি সরকারের জন্য বিশাল রাজস্ব সম্ভাবনা তৈরি করেছে। তবে এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস, আশুগঞ্জ নদীবন্দরের নতুন কার্গো টার্মিনাল নির্মাণ শেষ হলে বন্দর এলাকায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। তারা দ্রুত নির্মাণকাজ শেষ করার জন্য কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন।
আশুগঞ্জ বন্দরের ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, "নতুন তিনটি জেটি যুক্ত হলে জাহাজ থেকে মালামাল অনেক দ্রুত খালাস করা যাবে। এতে করে সময় এবং অর্থ সাশ্রয় হবে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়লে এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগও বৃদ্ধি পাবে।"
কৌশলগত অবস্থান ও বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে এক দশকেরও বেশি সময় আগে আশুগঞ্জ নদীবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটি আন্তঃসীমান্ত নৌপথ বাণিজ্য সহজ করতে "পোর্ট অব কল" হিসেবে মনোনীত হয়েছে। এই বন্দরের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ভারতীয় পণ্য আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহার করে পরিবহণ করা হয়েছে।
মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত এই বন্দর প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার লেনদেন পরিচালনা করে। প্রধানত চাল, ধান, স্টিলের রড ও সিমেন্ট এই বন্দরের প্রধান পণ্য। ব্যবসায়ীরা সাধারণত জাহাজে পণ্য পরিবহণ করে সড়কপথে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন।
আশুগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন বলেন, "নতুন কার্গো টার্মিনাল বন্দরের কার্যক্ষমতা বাড়াবে এবং এই অঞ্চলে নতুন ব্যবসার সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।"