মহামারিকালে একজন শিক্ষিকার ভিন্ন পদ্ধতিতে পাঠদানের গল্প
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর অনেক দেশ-ই পুনরায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশে সংক্রমণের পরিস্থিতি বিবেচনা করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
দীর্ঘসময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সারাদেশের শিক্ষকরা দুটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন- নতুন এই পরিস্থিতিতে পাঠদানের পদ্ধতি এবং শিক্ষার্থীদের কীভাবে এই সময়েও শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা যায়।
শিক্ষাদানের নতুন পদ্ধতি
মহামারির পুরো সময় জুড়ে শর্মিষ্ঠা দেব তার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ রেখে প্রতিনিয়ত তাদের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের পাশাপাশি 'সোশ্যাল-ইমোশনাল লার্নিং' (এসইএল) এর কর্মসুচী শুরু করেছেন তিনি।
শিক্ষক ও শিক্ষকতা নিয়ে বিশ্বজুড়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান 'ইন্টারন্যাশনাল টাস্কফোর্স অন টিচার্স ফর এডুকেশন ২০৩০' এ উঠে এসেছে শর্মিষ্ঠা দেবের ভিন্ন পদ্ধতিতে পাঠদানের এই গল্প।
শর্মিষ্ঠা জানান, 'গবেষণায় দেখা গেছে, এধরণের কর্মসূচী শিক্ষার্থীদের দুশ্চিন্তা, হতাশা, মাদক সেবন ও আত্মহত্যা্র প্রবণতা কমাতে সাহায্য করে। এর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমে তাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়, ফলাফল ভালো হয় এবং উদার, সহানুভূতিশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করে।
মহামারির সময়ে দেশের গ্রমাঞ্চলে বাল্যবিবাহের সংখ্যাবৃদ্ধি ও শহরাঞ্চলে তরুণদের মধ্যে অপরাধ ও মাদক সেবনের প্রবণতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আশংকা প্রকাশ করেন ব্র্যাকের কার্যনির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ।
পূর্ববর্তী মহামারির শিক্ষা
কোভিড-১৯ এর সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালীন লিঙ্গ বৈষম্যমূলক ঘটনা সম্পর্কিত ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে বলা হয়, এই ঘটনাগুলো আফ্রিকার ইবোলা মহামারির সময়ের-ই প্রতিরূপ। ইবোলা মহামারির সময়ে স্কুল বন্ধ থাকাকালীন মৌলিক চাহিদা মেটাতে আফ্রিকায় বাল্যবিবাহ ও লেনদেনমূলক যৌন সম্পর্কের ঘটনা বৃদ্ধি পায়, বেড়ে যায় যৌন নিপীড়নের ঘটনাও। কিছু অঞ্চলে কিশোরীদের গর্ভধারণ বৃদ্ধি পেয়ে ৬৫ শতাংশেরও বেশি হয়।
টিচ ফর বাংলাদেশ ফিলোশিপ প্রোগ্রামের সদস্য শর্মিষ্ঠা তার ৩৩ জন ছাত্রীদের সাথে মহামারির সময় যোগাযোগ করেছেন, বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করেছেন। তাদের সাথে যোগাযোগের জন্য ফোনকল সহ ইমো, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেছেন, প্রতিনিয়ত তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর রেখেছেন।
তিনি লক্ষ করেন, শিক্ষার্থীরা তাদের বন্ধু-বান্ধব থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ায় এবং দৈনন্দিন কার্যক্রমে বড় ধরণের পরিবর্তন আসায় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব পড়েছে। লকডাউনের কারণে অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ায়, বাল্যবিবাহ ও নিপীড়নের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
মানসিক স্বাস্থ্য নিরীক্ষণ
শর্মিষ্ঠা তার ছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়ার জন্য তাদেরকে পাঁচটি পদ্ধতি অনুসরণের উপদেশ দেন- প্রার্থনা, স্বাস্থ্যকর খাবার, মেডিটেশন, শরীরচর্চা ও পরিমিত ঘুম। শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে শিক্ষদের সাহায্যের প্রয়োজন তার এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনার পর। শিক্ষকদের সাহায্যে তারা অবসাদ ও দুশ্চিন্তা মোকাবেলার শক্তি পায়, আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
ইউনেস্কো, টিচার টাস্ক ফোর্স ও ইন্টারন্যাশনাল লেবর অর্গানাইজেশনের একটি সাম্প্রতিক প্রকাশনীতে বলা হয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বাড়তি মনস্তাত্ত্বিক ও সোশিও-ইমোশনাল সাহায্য প্রয়োজন। শিক্ষকদের জন্য নির্দেশনামূলক এই প্রকাশনাটিতে আরও বলা হয়, লকডাউনের এই সময়ে শিক্ষার্থীরা নতুন অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। মৌলিক চাহিদার অভাবসহ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারের শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
শিক্ষার্থীদের আচরণ এবং দুশ্চিন্তা ও অবসাদ সম্পর্কিত প্রতিক্রিয়া মূল্যায়নের পরামর্শ দেয়া হয়েছে নির্দেশনাটিতে। 'বিল্ডিং ব্যাক ইক্যুয়াল: গার্লস ব্যাক টু স্কুলস গাইড' নামের এই প্রবন্ধে ছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে শিক্ষক, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষাখাতের কর্মকর্তাদের।
ছাত্রীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা
দীর্ঘসময় স্কুল বন্ধ থাকা ও মহামারির ভীতির কারণে অনেক শিক্ষাজীবন নিয়ে আশঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এরাম মারিয়াম জানান, 'এধরণের পরিবারকে সহযোগিতা করতে হবে, পুণরায় তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর জন্য রাজি করানোর লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। স্কুল খুললেই সব শিক্ষার্থী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসবে এই ধারণা নিয়ে কাজ করতে পারিনা।'
ইবোলা মহামারির পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রীদের পুনরায় স্কুলে ফিরে আসার হার অনেক কমে যায়।
শর্মিষ্ঠা ইতোমধ্যেই তার শিক্ষা কার্যক্রমে 'সোশাল-ইমোশনাল লার্নিং' সংযুক্তির লক্ষ্যে কাজ করছেন। মননশীলতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, রাগ নিয়ন্ত্রণ, দুশ্চিন্তা মোকাবেলা, সহানুভূতি চর্চা, সামাজিক সংবেদনশীলতা, বিভিন্ন মানসিক রোগের উপসর্গ চিনতে পারা- এসব তার নতুন পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত।