রমজানে মসুর ডাল, ছোলার মজুদ ও সরবরাহ মনিটরের আহ্বান ট্যারিফ কমিশনের
আন্তর্জাতিক বাজার দাম বেড়ে যাওয়ায় মসুর ডাল ও ছোলার মজুদ এবং সরবরাহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে মনিটর করার জন্য সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)।
মসুর ডাল ও ছোলা ছাড়া আসন্ন রমজান মাসে অন্যান্য সকল পণ্যের দাম স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে করছে বিটিটিসি।
গত ৯ জানুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লেখা এক চিঠিতে এ সুপারিশ করা হয়েছে।
একইসাথে রমজানে চাহিদা বৃদ্ধি পায় এমন সকল পণ্যের আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় বাজার দর, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে আমদানির প্রকৃত পরিমাণ ও এইসময়ে আমদানির জন্য কী পরিমাণ এলসি খোলা হয়েছিল এবং রমজান মাসের চাহিদার তথ্যসহ একটি বিশ্লেষণ প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ট্যারিফ কমিশন।
সেহরি ও ইফতারের সময় বাড়তি চাহিদার কারণে রমজান মাসে ছোলা, খেজুর, মসুর ডাল, ভোজ্যতেল, চিনির চাহিদা অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি থাকে। এর প্রত্যেকটি পণ্যই পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। যে কারণে এসব পণ্য যাতে রমজান শুরুর আগেই পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি হয়, সেজন্য সরকার ইতোমধ্যে শুল্ক-কর কমানো, এলসি মার্জিন কমানো, বন্দরে দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর বাইরে মুড়ি, মুরগি, ডিম, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, বেগুন, শশা, লেবুর চাহিদাও বাড়ে এই মাসে।
ট্যারিফ কমিশন জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে ২.৫১ লাখ টন মসুর ডাল আমদানি হয়েছে— যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬১ হাজার টন বেশি। এই সময়ে ৪৮,৯৮০ টন ছোলা আমদানি হয়েছে— যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৩১,৫৩৪ টন বেশি। পণ্য দুটির আমদানি বেশি হওয়ার পরেও মজুদ ও সরবরাহ মনিটর করার কথা বলেছে ট্যারিফ কমিশন।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৩.৮৪ লাখ টন। আগের বছরের তুলনায় ১.০৯ লাখ টন বেশি অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। আর এই সময়ে পামঅয়েল আমদানি হয়েছে ৭.১১ লাখ টন— যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৬৪ লাখ টন কম।
পাম অয়েলের মত চিনি আমদানিও কমেছে আগের বছরের তুলনায়। গত ১ জুলাই থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে মোট ৬.৬৪ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে— যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ টন কম।
ইফতারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আইটেম খেজুরের আমদানিও আগের বছরের তুলনায় কম হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫,৮৮৩ টন খেজুর আমদানি হয়েছে। আগের বছরের এই সময়ে ৯,৬২৮ টন খেজুর আমদানি হয়েছিল।
এদিকে মসুর ডাল, পাম অয়েল ও চিনি আমদানির জন্য গত নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে এলসি খোলাও আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কম হয়েছে। তবে ছোলা ও খেজুর আমদানির জন্য গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেশি এলসি খোলা হয়েছে। নভেম্বর ও ডিসেম্বরে খোলা এলসির পণ্য জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশে পৌঁছাবে। অর্থাৎ, রমজান শুরুর আগেই দেশে আসবে এসব পণ্য।
ট্যারিফ কমিশন বলছে, মসুর ডালের দাম গত বছরের তুলনায় না বাড়লেও বর্তমানে ছোলা বিক্রি হচ্ছে গত বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি দামে। আর পাম অয়েলের দাম ২৪ শতাংশ বেড়েছে। সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ১.৪৬ শতাংশ। তবে চিনির আমদানি কম হলেও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম কমার কারণে দেশের বাজারে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দাম ১২.২৮ শতাংশ কমেছে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছোলা ও মসুর ডালের চাহিদা থাকে এক লাখ টন করে। রোজাদারদের বেশিরভাগই তাদের ইফতারে ছোলা রাখেন। মসুর ডালের চাহিদা সৃষ্টি হয় হালিমসহ অন্যান্য ইফতার তৈরির উপকরণ হিসেবে। খেজুরের চাহিদা থাকে ৬০ হাজার টন। চিনি ও ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে ৩ লাখ টন। আর ৫ লাখ টন পেঁয়াজের চাহিদা সৃষ্টি হয় এই মাসে।
ট্যারিফ কমিশনের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মুড়িকাটা পেঁয়াজের উৎপাদন মৌসুম শুরু হওয়ায় পেঁয়াজের দাম কমছে। বাজারে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিমের চাহিদা কমেছে। এর ফলে স্থানীয় বাজারে ডিমের মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমতে থাকায় এবং ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক-কর কমানোয় পবিত্র রমজানে ভোজ্যতেলের দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে। আমদানি করা চাল বাজারে আসলে দাম কমবে। রমজানকে সামনে রেখে খেজুর আমদানির এলসি খোলা বেড়েছে। আশা করা যাচ্ছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর রমজানে খেজুরের দাম কম থাকবে।
তবে, মসুর ডাল ও ছোলার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় বাজারে এ দুটো পণ্যের মজুদ ও সরবরাহ মনিটর করা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে, রমজানে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের স্থানীয় বাজার স্থিতিশীল থাকবে বলে কমিশন মনে করছে।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের কমোডিটি মূল্য তথ্য সংক্রান্ত পিংক শিটের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, গত ডিসেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে এনার্জি, নন-এনার্জি, ফুড (অয়েল অ্যান্ড মিলস), আদার ফুড, পণ্যের কাঁচামাল ও ফার্টিলাইজারের দাম কমছে। কেবল ফুড (গ্রেইন্স) ভুক্ত রাইস, মেইজ ও বার্লির দাম ঊর্ধ্বমুখী।
এদিকে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের বিভিন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ফলে অনেক পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তার ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশের বাজারেও পড়বে। সার ও জ্বালানি তেলের দাম কমলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের উৎপাদন ও অন্যান্য পণ্যের সরবরাহ খরচ কমার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এজন্য বৈদেশিক মুদ্রার মান ধরে রাখতে হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, "প্রতি বছরই রমজানের আগে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল থাকবে বলে ট্যারিফ কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রমজান মাসের আগেই পণ্যমূল্য বেড়ে যায়— যা রমজানজুড়ে চলতে থাকে। সরকারের তথ্য-উপাত্ত আর বাজার পরিস্থিতি এক থাকে না।"